স্বাধীনতার জন্য চরম উদগ্রীব ও উজ্জীবিত সবাই। দাসত্বের শৃঙ্খল মেনে না নেওয়ার পণ ছিল তাদের। তাদের বুকে লুকিয়েছিল স্বাধীনতার গেরিলা আগুন। এ কারণে একাত্তরের জনযুদ্ধে চরম মূল্য দিয়ে এলাকার দেশপেমিক লোকজন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। শ্রীরামসি গ্রামের স্কুলঘরে শান্তি কমিটির সভা আহবান করে গ্রামবাসীর উপর বাধ্যতামূলক উপস্থিতির আদেশ জারি করেছিল পাকিস্তানীরা। সভায় বিলম্বে উপস্থিতিদের মধ্য থেকে বাছাই করে গ্রামের বুদ্ধিজীবি, চাকুরিজিবী, তরুণ ও ছাত্রসহ ১০৪ জনকে আলাদা করে হাত পা বেঁধে, ব্রাশফায়ারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গ্রামবাসীর রক্তে রাঙ্গা হয়ে ওঠে বর্ষার জলথৈথৈ রূপালি হাওর। হত্যাকান্ড দেখে আতঙ্কে গ্রামের নারী পুরুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। লাশ দাফনের কেউ ছিলনা। গণহত্যার পর লোকজন গ্রামে ফিরে দেখেন লাশ নিয়ে চারদিকে শকুন, শেয়াল আর জীবজন্তুর ওড়াউড়ি। আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া মৃত্যুপুরীতে ফিরে পচা, অর্ধগলিত ও জীবজন্তু খাওয়া ৪/৫টি করে লাশ গর্তে মাটিচাপা দেন তারা। এত নৃশংসতা নরযজ্ঞ দেখে নির্বাক হয়ে পড়েন গ্রামের মানুষ।
একাত্তরের ৩১ আগস্ট বর্ষার বৃষ্টিøাত সকালে সুনামগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংগঠিত হয় শ্রীরামসি গ্রামে। পরপর তিনদফা হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ফিরে যাবার সময় নরপিশাচরা আগুনে ছারখার করে বাজার, বসতঘর ও বিভিন্ন স্থাপনা। বিবিসি বাংলা তখন এই গণহত্যার উপর বিশেষ সংবাদ প্রচার করে। গণহত্যাযঞ্জে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া ক’জন এখনো স্মৃতি মনে করে হু হু করে কাঁদেন, নিরবে চোখের জল ফেলেন। নৃশংস বর্বতার নমুনা দেখে শিউরে ওঠা লোকজন এখনো দলাপাকানো ঘৃণা ছুড়ে দেন পাক বাহিনীর দেশীয় দোসর, আল বদর রাজাকারদের মুখে। এই ঘটনার পর থেকেই এলাকার অনেকেই পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে নরহত্যার প্রতিশোধ নিতে জন্মযুদ্ধে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন।
নারকীয় হত্যাযজ্ঞ থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া শ্রীরামসী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক জোয়াহির চৌধুরী (৭৬) এর সঙ্গে কথা হয় একাধিকবার। স্মতিচারণ করতে গিয়ে লক্ষ্য করেছি তার চোখ জলে ঝাপসা হয়ে ওঠে। ফ্যাকাশে হয়ে যায় চেহারা। কেমন নষ্টালজিকতা পেয়ে বসে তাকে নিরব-নিথর করে দেয়। কথা বলার খেই হারিয়ে ফেলেন তিনি।
১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সকাল। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকাল তাই চারদিকে থৈথৈ জল। স্থানীয় রাজাকার আহমদ আলী স্কুলের দু’জন ছাত্রকে বাহক করে শ্রীরামসি উচ্চ বিদ্যালয়ে জড়ো হওয়ার নির্দেশ দিয়ে শান্তি কমিটির সভা আহবান করে। ধিরে ধিরে এলাকাবাসী জড়ো হতে থাকেন। পর্যাক্রমে শিক্ষক, সরকারি চাকুরিজীবি, ছাত্রসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার লোকজন জড়ো হন। তবে যারা দেরি করে বৈঠকে উপস্থিত হন তাদের আলাদাভাবে চিহ্নিত করে তাদের মধ্য থেকেই বেশিরভাগকেই হত্যা করার জন্য বাছাই করা হয়। পাক দানবরা প্রথমে স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছাদ উদ্দিনকে লাঞ্চিত করেই বৈঠকে উপস্থিতিদের মধ্য থেকে ধড়পাকরের নির্দেশ দিয়ে এলোপাথারি মারধর শুরু করে। প্রথম দফায় প্রধান শিক্ষক, স্কুলের আরেক শিক্ষক মাওলানা আব্দুল হাই, তহশিলদার, পোস্ট মাস্টারসহ ২৬ জনকে ব্রাশফায়ারের মুখে ফেলে। এই দলের ২৪ জন মারা যান। জোয়াহির চৌধুরী ও আলকাছ মিয়া নামের দুই তরুণ সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। পরবর্তীতে নৌকায় তোলে আরো ৫০ জনকে এলোপাথারি গুলি করে হত্যা করে। যারা নৌকা থেকে প্রাণে রক্ষার জন্য পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তাদেরকেও উপরে তোলে আবার পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছুক্ষণ পরে আরেকটু দূরে গিয়ে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আরো ৩০ জনকে হাত পা বেঁধে ব্রাশফায়ারের মুখে হত্যা করা হয়। শান্তি কমিটির নির্দেশে গ্রামবাসীকে স্কুলে জড়ো হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো কোমলমতি শিক্ষার্থী আব্দুল মালিক ও তোফাজ্জল হককেও তারা রেহাই দেয়নি, গুলি করে হত্যা করে। পৈশাচিকতা চালিয়ে ফিরে যাবার আগে গ্রামের কিছু লোককে বাধ্য করে শ্রীরামসি বাজার পুড়িয়ে দিয়ে যায়।
একসঙ্গে নারকীয়ভাবে গ্রামের এত নীরিহ লোককে প্রকাশ্য হত্যা ও অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গ্রামের লোকজন প্রাণে বাঁচার ভয়ে স্বজনদের লাশ রেখে পালিয়ে যান। প্রায় এক সপ্তাহ গ্রামে শেয়াল কুকুর শকুন ছাড়া কোন জনমানব ছিলনা। সপ্তাহ খানেক পর গ্রামবাসী ফিরে এসে দেখেন লাশ নিয়ে শেয়াল কুকুর শকুনের কাড়াকাড়ি। চোখের জলে জীবজন্তু খাওয়া গলিত পচা লাশই এক একটি গর্তে ৪/৫ জন করে বিনা কাফনে দাফন করেন। শোকে কাতর স্বজনহারা গ্রামবাসী শপথ নেন স্বাধীনতার।
বেঁচে যাওয়া লোকজন ও গ্রামের প্রবীণ মুরব্বিরা এই নারকীয় হত্যার পিছনে পাক বাহিনী ও তাদের দোসরা কয়েকটি কারণে ক্ষুব্দ ছিল বলে জানিয়েছেন। তারা জানিয়েছেন, ১৯৭০ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে টানানো তারকাখচিত পাকিস্তানী পতাকা তালেব হোসেনসহ কয়েকজন যুবক নিচে নামিয়ে পদদলিত করে স্বাধীন বাংলার স্লোগান দেন। এই খবরটি তখন স্থানীয় রাজারকার গোষ্টি পাকিস্তানী ‘একশন সেলে’ লিপিবদ্ধ করায়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দু’জন রাজাকার শান্তি কমিটির হয়ে চাঁদা ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির জন্য এলাকায় এলে তাদেরকে গণপিঠুনি দিয়ে বিদায় করে এলাকাবাসী। এই খবরটিও দেওয়া হয় পাকিস্তানী বাহিনীকে। এদিকে পাক বাহিনীর নিপীড়ন থেকে বাঁচতে এই এলাকাকে নিরাপদ ভেবে পার্শবর্তী এলাকার প্রায় শতাধিক হিন্দু নারী পুরুষ গ্রামে আশ্রয় নেন। এই খবরটিও পৌঁছে দেয় রাজাকাররা পাক বাহিনীকে। এসব কারণে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী চরম ক্ষুব্দ ছিল শ্রীরামসি গ্রামবাসীর উপর। এসব কারণে ১৯৭১ সালের ৩১ আগস্ট সুনামগঞ্জের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংগঠিত হয় বলে মনে করা হয়। তবে ন্যাক্কারজনক এই গণহত্যার পরই প্রতিশোধপরায় হয়ে উঠেন এলাকার মানুষ। তারা দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকবাহিনী খতমের শপথ নেন।
স্বাধীনতার ৪১ বছর পরও শ্রীরামসি গণহত্যার স্মৃতিবিজড়িত স্থানে ব্যক্তিউদ্যোগে কেবল একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ব্যতিত রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু করা হয়নি। আজতের গণহত্যা দিবসটি সম্পর্কেও কিছু জানেনা উপজেলা প্রশাসন। এ উদাসীনতা এ দীনতা কার।