somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

‘মা’ এর কথা

০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৯৮৬ সনের ফেব্রুয়ারীতে সারে বার টাকা খরচ করে “চিত্রবাংলা” সাপ্তাহিক এ একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম “বহুদিনের বহু প্রতিক্ষিত ‘মা’ এর অপেক্ষায় আছি”। মা’র মৃত্যুর পর তাঁর অভাবের তীব্রতা আমাকে কেন এতটা উতলা করত তা জানিনা ! আরও অনেক ভাই-বোনের মধ্যে শুধু আমার ভিতরেই মা পাওয়ার ব্যতিক্রমী এ চিন্তা স্বভাবতই পরিবার এবং পরিবারের বাইরের কেও-ই মেনে নেয়নি। টিপ্পনী, বাঁকা চাউনি আর কত প্রকারের মন্তব্য যে আমাকে শুনতে হয়েছে ...। যাক যথারীতি বিজ্ঞাপনটি ছাপা হল। সে বছরেরই কোন এক বিকেলে ডাকপিয়ন এসে সরকারী খামের একটি চিঠি আমাকে দিল। বুঝতে পারছিলাম না কোথা থেকে এল। ওপরে প্রেরকের ঠিকানা লেখা নেই। অত্যন্ত কৌতুহল নিয়ে চিটিটা খুললাম। আশ্চর্য ! আমার ‘মা’ হওয়ার প্রস্তাব সুদুর যশোরের নড়াইল থেকে ! বার- বার, বহুবার চিঠিটা পড়লাম। মনের গভীরে ভীষন আলোড়ন আর সীমাহীন গতিতে কল্পনা ! সে কল্পনা কত যে ডালপালা, পাতা, শিরা উপ-শিরা ছাড়িয়ে মহাশূণ্যের কোথায়, কতদুর পর্যন্ত যে ছড়িয়ে পড়ল। টিউশনি, খাওয়া, ঘুম সব ধর্মঘটে গেল। অদম্য আগ্রহ নিয়ে মা’কে লিখতে বসবো ভাবছি, কিন্তু কি লিখবো ! যাক্- গভীর রাতে সাড়ে বার টাকায় পাওয়া অচেনা মা’কে প্রথম পত্র লিখতে বসলাম। কি লিখেছি মনে নেই ...। তারপর উত্তর এল, উত্তর গেল। উত্তর একটা এলো তো দু’ টো গেল। ডাকপিয়নের সাথে ভাব হলো ভীষন। নিয়মিত মা’র চিঠি না এলে ভালো লাগতো না কিছুই। ‘মা’র কথা সবার কানে গেলেও আমার একটি মাত্র বন্ধু ছাড়া আর কারও অন্তরে তাঁর তেমন স্থান হলো না। মা’র ঝাপসা একটা ছবি পেলাম। টেবিলের ড্রয়ারে আলাদা করে সযতনে মা’র চিঠিগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি। মাঝে মধ্যে পুরোনো চিটিগুলো পড়ি। স্নেহ- ভালোবাসা মাখা মা’র হাতের লেখা প্রগাঢ় শ্রদ্ধা নিয়ে চেয়ে দেখি। মনের মধ্যে শত - সহস্র প্রদীপের আলো জ্বলে। মনের বাগানে লক্ষ-কোটি ফুল-প্রজাপতির মেলা। বাইশ বছর বয়সের সেই আমি ছোট শিশুর মত মায়ের আচলের ছায়ায় মায়ার সময় কাটাই । এ পৃথিবীতে তার চেয়ে প্রিয় আমার আর কেউ রইল না।
প্রায় ছয়মাস এক রকম আচ্ছন্নের মত সময় কাটলো। আমার সমস্ত কাজ, সমস্ত চিন্তার জগৎ জুড়ে ‘মা’ রইল কপালের চন্দন হয়ে। গর্ভে জন্ম না নিয়েও এমন করে ‘মা’ কে ভালোবাসা কোন অভিনয় ছিলনা, ছিল না কোন ছলনা কিংবা অতি ছেলেমানুষী। আমার শূণ্য হৃদয়ের সে আবেগ অনুভূতি নিস্পাপ এ সম্পর্ককে বিবেক বর্জিত বলেও কখনও ভাবেনি।
দেখার প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে অনেক গুলো লেখার পর অবশেষে সে বছরের আগস্টের শেষে অনুমতি পেলাম মা’কে দেখতে যাওয়ার। আমার চাঞ্চল্য, স্পৃহা কিংবা উগ্রতা সবকিছুকে সীমা ছাড়িয়ে গেল। অপূর্ব এক পাওয়ার পরিপূর্ণতার আশায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে পত্র লিখলাম মা’মনিকে। আমার এ যাওয়া যে কি যাওয়া আর এ যাওয়ার কেমন যে ফল-প্রাপ্তি ঘটবে এ দোলচালে শুধূই মন নিষ্পেশিত হচ্ছিল। তবে ‘মা’, তাঁর বাড়ী কিংবা পারিপার্শি¦ক যেকোন পরিস্থিতির জন্য শুধুমাত্র লজ্জা ছাড়া আর কোন বিরুপ চিন্তাই আমার মনে ঠাই পাচ্ছিল না। যাত্রার আগের রাতে মানসিক উত্তেজনা আর অদ্ভূত এক কষ্ট। ভোর ছ’টায় দ্রুতি পরিবহনের গাড়ীতে ছুটে চললাম যশোরের উদ্দেশ্যে। মা’র জন্য কিছুই নেয়া হয়নি শুধুমাত্র সুন্দর একটি চিরুনী ছাড়া।
দুপুরে যশোর পৌছে গাড়ী বদলে নড়াইলের বাসে চড়লাম। যতই ‘মা’র নিকটবর্তী হচ্ছি, আমি হয়ে যাচ্ছি মোহাচ্ছন্ন। আমার বিশ্বের মধ্যাকর্ষনের কেন্দ্রবিন্দু যেন ‘মা’। শেষমেশ নড়াইল-এ নেমে ভ্যানে চড়ে রওনা হলাম মাইজপাড়া, গড়ের ঘাটের উদ্দেশ্যে। সে সময়ে প্রচন্ড গরমে আমি অর্ধেক সেদ্ধ হয়ে গেলেও মা শীতল পরশ যেন আমার অন্তরে সুশীতল বারিপাত করছিল। নৌকায় একটা ছোট্ট শাখা নদী পার হয়ে মা’র বাড়ির ঘাটে পৌছালাম। ঘাটে বাসন-পেয়ালা মাঝা-ঘষা চলছিল। আমাকে দেখে কাজের মানুষ তার কিছু পানিতে ভাসিয়ে দৌড়ে সংবাদ দিতে পাড়ের ওপরে উঠে গেল। বাড়ীর উঠোনে দাড়িয়ে আমার সতৃঞ্চ নয়ন শুধুই মা’কে খুজছিল। এক মামা এলেন, ঘরে বসিয়ে কথা-বার্তা বল্লেন। ঘরের আশে-পাশের হরেক রকমের মানুষের ফিসফিসানি আমার কানে ভেসে আসছে--- অমুকের ছেলে আসিছে, দেইখে যা--- মৃদু হাসি, চুড়ির শব্দ। সবমিলিয়ে এক অদ্ভুত শিহরণময় পরিবেশ। আমি অপেক্ষা করছি মা’মনির। বেশ সময় পরে ‘মা’ আমার এলেন। প্রায় বোধ শক্তিহীন আমি ভালো করে ‘মা’কে দেখার আগেই তাঁর পায়ের মাটি কপালে ছোঁয়ালাম। ঘন্টা খানেক পর কিছুটা ধাতস্ত হয়ে কথার ফাঁকে ফাঁকে মা’কে দেখলাম মহাবিশ্বের মহাবিশ্বয় নিয়ে। অল্প-স্বল্প কথাতে জেনে গেলাম ‘মা’ আমার ইংরেজিতে অনার্স পড়ছেন। ছেলেমানুষী/খেয়ালের বসে আমাকে ছেলে বানানোর ঘটনায় তাঁর এ পরিণতি। তবে মা’র লেখায় বা আচরণে সন্তান সম সেনহো-ভালোবাসার বিন্দু মাত্রও কমতি ছিল না। যাক কল্পনা আর বাস্তবের মা’কে নিয়ে সে সময় মুহুর্তে মুহুর্তে আমার হৃদয়ে তাঁর অস্থিত্বের ভাংগা-গড়া চলছিল।
চারদিন কাটালাম মা’র কাছে। নানা-মামাদের আদর-স্নেহ, আমর মা’র স্বর্গীয় ভালোবাসায় পরিপূর্ণ সে দিন গুলো আজও আমার ফেলে আসা অতীতের শ্রেষ্ঠতম দিন।
চলে আসার সময় বার বার মনে হচ্ছিল মা’র কাছে আমার আত্মার সবটুকু শ্রদ্ধা-ভালোবাসা রেখে যাচ্ছি। কিন্তু এই ‘মা’ কি চিরদিনের জন্য আমার থাকবে !
ফিরে এসে লিখতে গিয়ে কলম ধরলেও লেখা আর আগের মতো এলো না। কেবলি মা’কে পর পর মনে হতে লাগলো। আর সত্যিইতো ‘মা’ আমার একদিন পর হয়েই যাবে।
লেখা-লেখি কমে গেল। ৮৬ -তে গ্রাজুয়েশন করে আমি বরিশাল, পরবর্তীতে খুলনায় চাকরীতে ৪/৫ বছর কাটালাম। ভাবনা থেকে ‘মা’ কিন্তু কখনও সরে যায়নি। বরং একাকীত্ব, নির্জনতায় আমার সদ্য হারানো অতীত যেন জোনাকীর মতো জ্বলছিল। কি ভেবে হঠাৎ একদিন মা’কে লিখলাম- ‘মা’ তুমি কত কাছে ! উত্তর এলো। রিভিউ মিটিং-এ ঢাকা আসার আগে একদিনের জন্য মা’কে দেখতে গেলাম। নানা, মা খুশী। মা’র লেখা-পড়া শেষ। তাঁর সামনে অজানা ভবিষ্যত। আমার ভিতরে চাপ চাপ অভিমান আর বিষাদ।
বিগত ত্রিশ বছরে দিনে, সপ্তাহে, মাসে- বছরে শত-সহস্র বার মা’কে কতইনা ভেবেছি। সহকর্মী-বন্ধু-বান্ধব- কে মা’র ইতিবৃত্ত শোনাতে গিয়ে কতবার চোখ জলে ভিজে গিয়েছে। কিন্তু ভোলা হয়নি জীবনে ঘটে যাওয়া এ অপরিনামদর্শী কাহিনী..।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:১৯
১২টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×