রাজাকার শব্দটা ব্যবহার নিয়ে যে অযাচিত বিতর্কটা হচ্ছে এটা ফ্যাসিজমকেই শক্তিশালী করবে। যারা ইনায়া বিনায়া 'আমি রাজাকার' শব্দটার ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তুলছেন তাদের অনেককেই দেখেছি শাহবাগ প্রশ্নে ফ্যাসিজমের পক্ষ অবলম্বন করতে। অল্প বয়সে আমিও শাহবাগ আন্দোলনের স্পিরিটকে গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু এর রাজনৈতিক ও কালচারাল প্রজেক্টটা তখনো বুঝি নাই।
ওয়ান এলিভেন পরবর্তী বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ থেকে কার্যত সকল অপজিশন দূর করার কালচারাল প্রজেক্ট হিসেবে শাহবাগ কাজে লেগেছে। যুদ্ধপরাধের বিচার এটার জাস্ট আইনি অংশ৷ কিন্তু এর কালচারাল পার্টটা বিবেচনা করতে হবে।
শাহবাগ বাংলাদেশে কিছু কৃত্রিম পরিচয় নির্মান করে। কিন্তু সমস্যা হল এ পরিচয়ে কারা পড়বে সেটা ডিফাইন করার এখতিয়ার নেয় তারা। 'রাজাকার', 'জামাত', 'শিবির' - এ আইডেন্টিটিগুলোকে শুধু মত্রই একটি দলীয় পরিচয়ের বাইরে নিয়ে গিয়ে একটি গ্রুপ আইডেন্টিটিতে পরিণত করে। অর্থাৎ, কেউ রাজনৈতিকভাবে এখন আর জামাত, শিবির, রাজাকার হওয়ার দরকার পড়েনা, বরং যে কেউই 'রাজাকার', 'জামাত', 'শিবির' হতে পারে শুধু নির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে থকলেই।
এ বৈশিষ্ট্য গুলো নিম্নরূপ-
১. যে সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে এবং বিচার করবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে সে সরকারই একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি; তাই, এ সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলা মানেই মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যাওয়া এবং রাজাকার, জামাত, শিবির হয়ে ওঠা। শুধু তাই নয়, এই সরকারকে টিকিয়ে রাখছে যেসব এজেন্ট (ভারত একটি), তাদের বিরুদ্ধে বলাও একই আচরণের সামিল।
২. যে কালচারাল এলিটরা এই আন্দোলন করেছে, তাদের সাংস্কৃতিক বয়ানের বাইরে, তাদের প্রচারিত আইডেন্টিটির বাইরে যাওয়া মানেই, জামাত, শিবির, রাজাকার হয়ে যাওয়া।
৩. ইসলাম এবং ধর্মীয় সেন্টিমেন্টকেও মুক্তিযুদ্ধের সাথে যুক্ত করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের আইডেনটিটির প্রতিপক্ষ করা হয়েছে। যদি কেউ ইসলাম এবং ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট ধারণ করে তবে সেটা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আইডেন্টিটির বাইরে চলে যাওয়ার সামিল। পাকিস্তান বিরোধীতাকে ইসলাম বিরোধীতায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এখন, মূল ঝামেলাটা হয়েছে- যদি কেউ রজাকার, জামাত, শিবির হয় তবে তার সাথে সকল মানবাধিকার লঙ্ঘন করা জায়েজ এই সেন্টিমেন্ট সমাজে নির্মান করেছে শাহবাগ। এই পরিচয়কে একটা জুজু বানানো হয়েছে। ফ্যাসিজমকে ফ্যসিস্ট হয়ে ওঠার যত অস্ত্র তার মধ্যে এই অস্ত্রটি সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে৷
সকল অপজিশন বাংলাদেশ থেকে খেদানো হয়েছে এই পরিচয় দিয়ে বা এই পরিচয়ের সাথে সংযুক্তি দেখিয়ে। ডানপন্থী সকল শক্তিকে বশীভূত করা হয়েছে এই জুজুর ভয় দেখিয়ে। ফ্যাসিজম বামপন্থীদের মৌন সমর্থন আদায় করেছে এই জুজুকে কেন্দ্র করে। সাধারণ ছাত্রদের বহু আন্দোলন বানচাল করা হয়েছে এই পরিচয়কে ব্যবহার করে। নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালানো হলেও, অবৈধ হামলা-মামলা হলেও, সবাই চুপ থেকেছে শুধু সেই জুজুর সংযুক্তির কারণে।
শিবির হওয়ার জন্য আবরার ফাহাদকে শিবিরের রাজনীতির সাথে যুক্ত থাকতে হয় নাই, বরং উপরের বৈশিষ্ট্য গুলো ধারণ করতে হয়েছে। জাবিতে হিন্দুকে শিবির শুনতে হয়েছে শিবিরের সাথে সংযুক্তি থাকার খতিরে নয় বরং উপরের বৈশিষ্ট্যগুলোর কোন একটি ধারণ করার জন্য। বিশ্বজিৎ হত্যার শিকার হয়েছে অই একই কারণে।
একজন হিন্দুকেও যখন জামাত-শিবির-রাজাকার বলা হয় তখন এটা প্রমাণ করে জামাত-শিবির-রাজাকার এগুলো আর দলীয় পরিচয় না বরং গ্রুপ আইডেন্টিটি।
.
এখন, 'আমি রাজাকার' স্লোগান এই ঐতিহাসিক ভুল শোধরানোর একটা স্লোগান হয়ে উঠেছে। এই স্লোগান বাংলাদেশে ফ্যাসিজমের সবচেয়ে বড় টুলকে অকেজো করে দিচ্ছে।
'আমি রাজাকার' স্লোগান কখনোই বাংলাদেশে আসল রাজাকারদের নরমালাইজ করছেনা, কখনোই জামাত-শিবিরের পক্ষে জন সমর্থন তৈরি করছেনা। এত সোজা না এগুলা।
বরং যে জুজু পরিচয় দিয়ে সব করে ফেলা যায়, সে জুজু পরিচয়টাকে ভাঙছে। এই আন্দোলনের পর ধীরে ধীরে এই ফ্যাসিস্ট টুলের কার্যকারিতা কমে যাবে।
.
তাই, এই স্লোগানের মানে হল- আমি জনি তুমি কিছুক্ষণ পর আমাকে কী বলবা। আসো, আমি আগেই বইলা দিলাম আমি সেটা। পরবর্তী কথায় আসো, আসল আলাপে আসো। মানলাম আমি রাজাকার। বসো এবার কোটার আলাপ করি, অধীকারের আলাপ করি। আর কান খাড়া কইরা শোনো- আমি রাজাকার হইলেও তুমি স্বৈরাচার।
লিখাঃ জাহিদুল ইসলাম, আলোর শিক্ষণ, জাবি, অনুমতিক্রমে দেয়া
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুলাই, ২০২৪ সকাল ৭:৫৬