somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মেমসাহেবদের চোখে ভারত

২২ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ধারণা করা হয় ‘মেমসাহেব’ শব্দটির উদ্ভব উনিশ শতকের মধ্যভাগে। ম্যাডাম এবং সাহেব মিলে হয়েছে মেমসাহেব। বহুকাল ধরে মেমসাহেবদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের খলনায়িকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ব্রিটিশ রাজের নানা নেতিবাচক কাজ বিশেষত বর্ণবাদের জন্য দায়ী করা হয়েছে মেমসাহেবদের। গত দু’দশকের গবেষণায় এ ধারণায় কিছু পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। ভারতে আসা ইংরেজ নারীরা সাধারণভাবে তাদের পুরুষদের অধীনস্ত ছিলেন। এ অধীনস্ততা স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের আচরণে প্রভাব রেখেছে। একদিকে অনেক ব্রিটিশ মেমসাহেব যেমণ সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা আর বর্ণবাদকে প্রয়োগ করে জীবনযাপন করেছেন তেমনি এর বিপরীত চিত্রও ছিল। অনেক মেমসাহেব সরাসরি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এবং বর্ণবাদের সমালোচনা করেছেন। পাশাপাশি ভারতীয় সমাজ, প্রকৃতিসহ বিভিন্ন বিষয় তারা পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং নিজেদের মতো করে নানা মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করেছেন। এসব বর্ণনা থেকে একদিকে যেমণ তৎকলীন ভারতীয় সমাজের নানা চিত্রকে জীবন্ত হয়ে উঠতে দেখা যায় ঠিক তেমনি এই মেমসাহেবরা ভারতকে কীভাবে দেখেছেন সেই মূল্যায়ণটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

বর্ণবাদ
ভারতবর্ষে আসা ইংরেজদের মধ্যে বর্ণবাদী মানসিকতার কথা তুলে ধরেছেন কনস্টান্স ফ্রেদেরিকা গর্ডন কামিং (১৮৩৭-১৯২৪ খ্রি.)। কামিং ভারতে এসেছিলেন ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে। ভারতীয় এক তরুণ কামিংয়ের পাশের আসনে বসায় তাকে সেখান থেকে উঠিয়ে নেন এক ইংরেজ পুরুষ। কামিং প্রথমে তাকে উঠিয়ে নেয়ার কারন বুঝতে পারেননি কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারেন ইংরেজ পুরুষটির বর্ণবাদী মানসিকতা। কামিংয়ের কথায় সেই ভারতীয় তরুণ ছিল অত্যন্ত সুদর্শন, এতটাই যে সে কোন শিল্পীর জন্য আদর্শ মডেল হতে পারতো। ঘটনাটি থেকে কামিং বুঝতে পারেন ইংরেজরা যেমণ ভারতীয়দের সঙ্গে বর্ণবাদী আচরণ করেন তেমনি ভারতীয়রাও এ আচরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কামিং লিখেছেন, ‘আমাকে সরিয়ে নেয়ায় প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু সেই ভারতীয় তরুণকে দেখে মনে হল পুরো ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। তার জাতি আমাদের হাতে এভাবে অপমান হতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।’
ব্রিটিশ পুরুষদের মধ্যে তাদের শেতাঙ্গ নারীদের নিয়ে বর্ণবাদী ধারণা ছিল বেশ প্রবল। ইংরেজ পুরুষরা স্থানীয় ভারতীয় নারীদের বিয়ে করে বা রক্ষিতা রেখে যৌন সম্পর্কে জড়ালেও তারা শ্বেতাঙ্গ নারীদের সঙ্গে ভারতীয় পুরুষদের সম্পর্কের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।

ব্রিটিশ রাজের সমালোচনা
ভারতে আসা ব্রিটিশ নারীরা তাদের ভারত শাসনের সমালোচনা করেছেন। ভারত সফরে আসা ইংরেজ নারীরা ব্রিটিশ রাজের শাসন প্রক্রিয়া এবং ইংরেজদের আচরণের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করতেন। আর এসব পর্যবেক্ষণ থেকে তারা বিভিন্ন সময় ঔপনিবেশিক শাসন এবং বর্ণবাদী আচরণের সমালোচনা করেছেন। হেলেন ম্যাকেনজি ছিলেন কলিন ম্যকেনজি (১৮০৬-৮১ খ্রি.) নামক এক বিশিষ্ট সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী। কলিন ছিলেন কট্টর ধার্মিক। তিনি ভারতে মিশনারীদের কর্মকান্ডকে সমর্থন করতেন। হেলেন ম্যাকেনজি ভারতে ব্রিটিশদের শাসন এবং আচরণের সমালোচনা করে লিখেছেন, ‘ইংরেজদের চিরাচরিত দাম্ভিক আর উদ্ধত আচরণ ইউরোপের মতো ভারতেও তাদের অজনপ্রিয় করে তুলেছে। যেহেতু ইংরেজরা ভারতের প্রায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে তাই ভারতীয়দের প্রতি সকল অবিচার এবং তাদের দুর্দশার জন্য দায়ী ইংরেজদের কর্মকান্ড।’
অ্যানা হ্যারিয়েটা লিওনোয়েনস (১৮৩৪-১৯১৪ খ্রি.) ভারতের ব্রিটিশ প্রশাসনকে এই দেশ এবং মানুষের সংস্কৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ মনে করতেন। তিনি লিখেছেন, ‘যেসকল কর্মকর্তাকে কেন্দ্র করে পুরো ভারতীয় সাম্রাজ্য পরিচালিত হত তারা বেশিরভাগই ভারতীয় ভাষা, জাতি, ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার, শতাধিক প্রদেশের জীবনযাত্রার রীতিনীতি সম্পর্কে অজ্ঞ।’
ক্রিস্টিনা সিনক্লেয়ার ব্রেমনার ব্রিটিশ রাজের সমালোচনা করেছেন রাজনৈতিক ভাষায়। তিনি লিখেছেন, ‘বর্তমান ভারতে ব্রিটিশ শাসন দুনিয়ার অন্যতম মহত্তম বিষয় এবং ভারতে ইংরেজদের পরাজয় সভ্যতার জন্য একটি বিরাট ক্ষতির কারণ হবে। কিন্তু তাসত্তেও এ ব্রিটিশ শাসন ভারতকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। ব্রিটেন ভারতের জন্য শান্তি নিশ্চিত করেছে কিন্তু তার বিনিময়ে সে ভারতকে মূল্য পরিশোধে বাধ্য করছে। এ মূল্য এতই বেশি যে তা অতীতে ভারতে ঘটা যে কোন বহিঃশত্রু আক্রমণ ও লুটপাটের তুলনায় অনেক বেশি। ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহ ভারত থেকে ৩২ কোটি পাউন্ডের সম্পদ লুট করে পারস্য ফিরে গিয়েছিলেন। আর ভারতে থেকে ব্রিটেনে সরিয়ে নেয়া সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি। একে বলা যায় সম্পদের অফুরন্ত এক ঝরণাধারা।
কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন যে ভারত ১০০ পাউন্ড মূল্যের পন্য ইংল্যান্ডে রপ্তানি করে পায় মাত্র ৭০ পাউন্ড, ভারতের দুর্ভিক্ষপীড়িত রাজ্যগুলোতে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছে তখন মুক্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে সেখানকার শস্য রফতানি হয়ে যাচ্ছে। না, অস্বীকার করতে পারবেন না। ভারতের ওপর ইংল্যান্ডের পূর্ণ কর্তত্ব দেশটিতে বাধ্যতামূলক বাণিজ্যের সৃষ্টি করেছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ইংরেজ গভর্ণররা হতবাক হয়ে দেখতেন দুর্ভিক্ষপীড়িত রাজ্য থেকে কীভাবে খাদ্যশস্য জাহাজে বোঝাই হয়ে পাচার হচ্ছে আর কংকালসার, অনাহারক্লিষ্ট মানুষগুলো সেই শস্য বোঝাই করতে সহায়তা করছে।

নারী শিক্ষার বিরোধিতা
উনিশ শতকে ভারতীয় সমাজে নারীদের সামাজিক অবস্থার নিম্মগামিতা দেখা যায়। সমাজের অভিজাত পরিবারগুলোর কণ্যারা শিক্ষা থেকে একবারেই বঞ্চিত ছিলেন। শিক্ষা মেয়েদের জন্য অসম্মানের বলে বিবেচিত হত। বাইজি মেয়েরাই কেবল কিছুটা লেখাপড়া জানতেন। বলা হত শিক্ষা নারীদের চরিত্র নষ্ট করে। লেখাপড়া শিখলে মেয়েরা প্রেমিককে চিঠি লিখবে। আর মেয়েরা শিক্ষিত হলে বিয়ের পর তাদের স্বামীরা মারা যাবে।
জুলিয়া মেইটল্যান্ড (১৮০৮-১৮৬৪ খ্রি.) ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন বড় ব্যবসায়ী জেমস থমাসের স্ত্রী। স্বামীর পেশার সূত্রে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে আসেন। তিনি ভারতে ছিলেন তিন বছর। ভারতে থেকেছেন মাদ্রাজ এবং ব্যাঙ্গালোরে। স্বামীর মৃত্যুর পর ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে যান। এরপর তিনি বিয়ে করেন চার্লস মেইটল্যান্ডকে। ভারতে অবস্থানকালে জুলিয়া তার মায়ের কাছে অনেকগুলো চিঠি লিখেছিলেন। এসব চিঠিতে তখনকার দক্ষিণ ভারতের জীবন্ত বিবরণ পাওয়া যায়। জুলিয়ার সেই চিঠিগুলো ‘লেটারস ফ্রম মাদ্রাজ, ডিউরিং দ্য ইয়ারস ১৮৩৬-৩৯, বাই আ লেডি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
জুলিয়া তার চিঠিতে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে স্থানীয় ভারতীয়দের বিরোধীতার একটি ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন। এক সরকারি কর্মকর্তার তত্তাবধায়নে মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয়দের মতামত জানার জন্য একটি সভা ডাকা হয়েছিল। সভায় জুলিয়া উপস্থিত ছিলেন। স্কুল প্রতিষ্ঠা হলে স্থানীয় মেয়েরা শিক্ষা গ্রহণ করতে আসবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে একজন বলেন, ‘না, মেয়েদের শেখার কী আছে?’ সভায় অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু শেষমেষ উপসংহার হয় এই যে মেয়েরা লেখাপড়া শিখলে তার আত্মীয় স্বজনদের জন্য তা দুর্ভাগ্য বয়ে আনবে। বিশেষত সেই মেয়ের মা-বাবা মারা যেতে পারেন। এসব শুনে জুলিয়া বলেন, ‘আমি লিখতে পড়তে শিখেছি কিন্তু আমার বাবা-মা তো বেঁচে আছেন, দিব্যি ভালোই আছেন। সব ইউরোপিয় মেয়েরাই লেখাপড়া শেখে কিন্তু এজন্য তাদের কোন আত্মীয়-স্বজনেরই কোন ক্ষতি হয় না।’ জুলিয়ার কথার জবাবে সেই স্থানীয় বললেন, ‘ওহ! ইউওরাপিয়দের কোন ক্ষতি হয় না, হয় শুধু ভারতীয়দের।’
আবার কিছু উদ্যোগও প্রত্যক্ষ করেছেন জুলিয়া। রাজা রামমোহন রায়ের এক বন্ধুর সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। জুলিয়া জানিয়েছেন, রামমোহন রায়ের সেই বন্ধু তার ছেলের সঙ্গে সঙ্গে তিন মেয়েকেও শিক্ষিত করে তুলছেন। মেয়েদের তিনি মাতৃভাষা, ইংরেজি এবং সংস্কৃত শেখাচ্ছেন। আর মেয়েরা তাদের ভাইয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পড়াশোনা করছেন। কিন্তু মেয়েদের শিক্ষিত করার ব্যাপারে সেই মানুষটিকে নিজের আত্মীয়স্বজন এমনকি স্ত্রীর কাছ থেকেও যথেষ্ট বিরোধিতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল।
সে সময় নারী শিক্ষা বিরোধিতার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা বেশ শক্তিশালী ছিল আর তা হল- শিক্ষা নারীদের জন্য অসম্মানজনক। এ বিষয়টিকে উল্লেখ করেছেন জেনি (মিসেস মার্কাস) ফুলার। জেনি ফুলার (১৮৫১-১৯০০ খ্রি.) ছিলেন একজন খ্রিস্টান মিশনারী। তিনি তার মিশনারী স্বামীর সঙ্গে বোম্বাই এ বসবাস করতেন। ভারতীয় নারীদের দুর্দশাজনক অবস্থা নিয়ে সাপ্তাহিক খ্রিস্টান পত্রিকা বোম্বাই গার্ডিয়ানে আঠারোটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৯০০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
জেনি ফুলার লিখেছেন, “কয়েক শতক ধরে নারী শিক্ষার বিষয়টির ওপর একাধিপত্য রয়েছে কেবল বাইজি মেয়েদের। ভারতে শুধুমাত্র এই নারীদেরই পড়তে এবং প্রকাশ্যে গান গাইতে শেখানো হয়। বাইজিদের কাজ হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় সম্মানিত ঘরের মেয়েদের শিক্ষা দেওয়াকে অসম্মানের কাজ বলে মনে করা হত। এদেশে নারী শিক্ষার প্রচেষ্টা শুরুর কালে বিরোধিরা যে যুক্তিটি সবার আগে তুলে ধরতেন সেটা হল-‘শিক্ষিত হওয়া মেয়েদের জন্য অসম্মানের।’”
অ্যানি উড বেসান্ট ইংল্যান্ডে ট্রেড ইউনিয়ন, শিক্ষা এবং নারীদের ভোটাধিকারের পক্ষে কাজ করেছেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতে আসেন। ভারতেও তিনি নারী শিক্ষার প্রসারের উদ্যোগে যুক্ত ছিলেন। ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি বেনারসে সেন্ট্রাল হিন্দু কলেজ গার্ল’স স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১৮-১৯২০ মেয়াদে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। অ্যানি উড বেসান্ট লিখেছেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে ধর্মীয় ও সাহিত্য জ্ঞানে একজন ভারতীয় নারীর মন পূর্ণ হতে পারে, তিনি যথেষ্ট সংস্কৃতিমনা হতে পারেন কিন্তু তারপরও তিনি লিখতে ও পড়তে জানেন না।’

পতিব্রতা ভারতীয় নারী
ভারতীয় ঐতিহ্যে হিন্দু নারীরা তাদের স্বামীকে দেবতা বিষ্ণুর প্রতিমূর্তি হিসেবে পূজা করেন। স্বামীর প্রতি ভারতীয় হিন্দু নারীদের এই মনোভাব এবং বিশ্বস্ততা ইংরেজ মেমসাহেবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। স্বামী বিবেকানন্দ দ্বারা প্রভাবিত মার্গারেট নোবেল যিনি পরবর্তীতে একজন হিন্দু সন্ন্যাসী হয়ে সিস্টার নিবেদিতা নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন, স্বামীর প্রতি হিন্দু নারীদের প্রাচীন দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশংসা করেছেন। সীতা এবং সাবিত্রি- চরিত্র দুটির গুণকীর্তন করেছেন অনেক ইংরেজ নারী। মার্গারেট আরকোহার্ট কলকাতায় মিশনারীর দায়িত্ব পালন করতেন। কলকাতার বিবাহিত নারীদের জীবন নিয়ে তার একটি প্রসিদ্ধ গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে- ‘আ স্টাডি অব দ্য হিন্দু পর্দানশীন অব কলকাতা (১৯২৫)’। তিনি লিখেছেন, ঐতিহ্যবাহী হিন্দু নারীরা তাদের স্বামীদের দেবতাজ্ঞান করতেন। তারা স্বামীদের পা ধুইয়ে দিতেন, তার থালায় খাবার দিতেন প্রসাদ রূপে। মার্গারেট আরও লিখেছিলেন যে সেসময়ের প্রজন্ম সেই প্রাচীন রীতি নীতিকে অবহেলা করতে শুরু করেছিল। ‘মানে হচ্ছিল হিন্দু সমাজে সংশয়বাদের ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। এ ঢেউ অনেক নারীকেও আক্রান্ত করেছিল যারা আর ধর্মনিষ্ঠার পুরনো রুটিন বজায় রাখছিলেন না। কিন্তু যে কোন মুহূর্তে একজন নারী পুরনো দিনের রীতি দিয়ে আকৃষ্ট হয়ে পড়তে পারেন এবং দ্বিধাগ্রস্ত এমনকি আবেগী হয়ে সেসব রীতিনীতি পালন করতে পারেন।’
হিন্দু নারীদের এই পরম পতিব্রতা চরিত্রকে ইংরেজরা তাদের দেশে জেন্ডার রাজনীতিতে ব্যবহার করেছিলেন। পশ্চিমে সেসময় গড়ে ওঠা নারীবাদী আন্দোলন এবং নারী স্বাধীনতার দাবিকে মোকাবেলা করতে গিয়ে ভারতীয় নারীদের পতিব্রতা দিকটিকে তুলে ধরা হয়েছিল। ফ্লোরা অ্যানি স্টিল (১৮৪৭-১৯২৭ খ্রি.) ভারতের নারীত্ব, আত্ম-উৎসর্গ করার মডেলকে প্রশংসা করে লিখেছেন, ‘পশ্চিমের নারীদের কাছে পূর্বের নারীদের যতটুকু শীক্ষনীয় আছে ঠিক ততটুকুই পূর্বের নারীদের কাছে শীক্ষনীয় আছে পশ্চিমা নারীদের।’
অ্যানি উড বেসান্ট লিখেছেন যে পশ্চিমা সমাজের সমতার ধারণার কোন স্থান নেই ভারতীয় সমাজে। ভারতীয় পরিবার, সমাজ কিংবা জাতি কোথাও সমতার ধারণা নেই। নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন এখানে নারী-পুরুষ উভয়ই হেসে উড়িয়ে দেয়। বেসান্ট লিখেছেন, স্বামীকে সর্বক্ষেত্রে ভালবাসতে, সেবা করতে এবং মান্য করতে শেখানো হয় ভারতীয় নারীদের। ভারতীয় হিন্দু নারীদের কাছে স্বামী মানে দেবতা।
নারীদের এই বিশ্বাস এবং সংস্কৃতিকে পশ্চিমা সভ্যতার ছত্রভঙ্গ এবং আত্মকেন্দ্রিক জীবনের সঙ্গে তুলনা করেছেন বেসান্ট। তিনি লিখেছেন, ‘প্রশ্ন করা যেতে পারে যে হিন্দু নারীত্ব ধারণা কি পশ্চিমা দেশগুলোর জন্য মানানসই? স্পষ্টভাবে বলা যায় যে পশ্চিমা সমাজে এ ধারণার বিস্তার অসম্ভব। এই কোমল, সদয়, অমায়িক, আবেগময়তা এবং নির্মল গৌরব ও শিষ্টাচারের সঙ্গে ছত্রভঙ্গ পশ্চিমা জীবন এবং পশ্চিমা সভ্যতার আত্মকেন্দ্রিকতা মানিয়ে নিতে পারবে না।”

পর্দা পার্টি
পর্দা পার্টি ছিল সেসময়ের ভারতের এক বিশেষ পার্টি। এ পার্টি ছিল ইংরেজ মেমসাহেব এবং স্থানীয় বনেদি ঘরের নারীদের এক বিশেষ সম্মিলন। উনিশ শতকের শেষভাগেও ভারতে পর্দাপ্রথা বেশ কঠোর ছিল। তাই মেমসাহেবরা স্থানীয় নারীদের জন্য পর্দাঘেরা পার্টির আয়োজন করতেন। এসব পার্টিতে পুরুষদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। ক্যাথরিন মায়ো (১৮৬৭-১৯৪০ খ্রি.) লিখেছেন, ‘আমি একটা পর্দা পার্টিতে উপস্থিত ছিলাম। এ পার্টি হল পর্দানশীন নারীদের যেখানে শুধু নারীরাই অংশ নিতেন। ভারতীয় নারীরা এসেছিলেন পর্দাঘেরা গাড়িতে। বাড়ির সকল পুরুষ চাকরদের তখন বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’ ক্যাথরিন মায়ো বর্ণিত সেই পর্দা পার্টিতে ভারতীয় নারীরা পর্দা নিয়ে আলোচনায় বসেছিলেন। কেউ কেউ পর্দার পক্ষে কথা বলেছিলেন আবার কেউ এর বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন। পার্টিতে অংশ নেয়া এক ভারতীয় তরুণী বলেছিলেন, ‘আমাদের পর্দা আপনাদের কাছে কঠিন কিছু মনে হয়। কিন্তু আমাদের কাছে এটা কিছু না। আমরা গৃহে এক নিরিবিলি, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ জীবনযাপন করি। কিন্তু বাইরে পুরুষদের মধ্যে আমরা ভীত থাকি।’
কিন্তু ভিন্নমত প্রকাশ করেন পার্টিতে আসা এক মধ্যবয়সী ভারতীয় নারী। ক্যাথরিন মায়োকে তিনি নীচু স্বরে বলেন, ‘আমি আমার স্বামীর সঙ্গে ইংল্যান্ডে গিয়েছিলাম। ইংল্যান্ডে নারীদের সম্মান করা হয়। তাই আমার স্বামী আমাকে পর্দা ছাড়াই সেখানে ঘুরতে দিয়েছিলেন। তাই আমি বেশ স্বাচ্ছন্দে রাস্তা, দোকান, গ্যালারি এবং বন্ধুদের বাড়িতে ঘুরেছি। কেউ আমাকে বিরক্ত করেনি বা কারো আচরণে আমাকে ভীত হতে হয়নি। সেখানকার ভদ্রমহিলা এবং ভদ্রলোকদের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এটা ছিল অসাদারণ- একবারে যেন স্বর্গ! কিন্তু এখানে তার কিছুই নেই। এখানে আমাকে জেনানায় থাকতে হয়, কঠোরভাবে পর্দায় থাকতে হয়। স্বামী আর নারী ব্যাতীত অন্য করুর মুখ দেখতে পাই না। আমরা কিছুই দেখি না। কিছুই জানি না।’

ভারতীয় নারী- ইংরেজ পুরুষ
ভারতে ব্রিটিশ রাজ প্রতিষ্ঠা হওয়ার প্রাথমিককাল থেকেই এ দুই ভিন্ন জাতির মধ্যে সম্পর্কের একটি বিশেষ দিক ছিল শ্বেতাঙ্গ ইংরেজ পুরুষদের সঙ্গে ভারতীয় নারীদের যৌনসম্পর্ক। ভারতে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠার শুরুর দিকে এ ভূখন্ডে আসা ইংরেজ নারীদের সংখ্যা ছিল অনেক কম। এসময়ে ইংরেজ পুরুষরা স্থানীয় ভারতীয় নারীদের বিয়ে করতেন অথবা তাদের কঙ্কুবাইন হিসেবে রাখতেন। কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগে এসে ভারতীয় রক্ষিতা রাখার ব্যবস্থাটির প্রয়োজনীয়তা কমতে থাকে এবং একসময় প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। এর কারণ ছিল প্রচুর ইংরেজ নারীদের ভারতে আগমন যারা এখানে ইংরেজ পুরুষদের স্ত্রী হিসেবে বাস করতেন। এসময় নাগাদ প্রচুর ইংরেজ তরুণ ভারতে এসে ধনী হয়ে যায়। ফলে তারা ব্রিটিশ নারীদের বিয়ে করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এ সময় ইংল্যান্ডে যেসব নারী কাঙ্খিত বর খুঁজে পেতেন না তারা দলে দলে ভারতে আসা শুরু করেন। ব্রিটিশ লেখক, গবেষক অ্যানি ডি কর্সি তারা ‘দ্য ফিশিং ফ্লীট : হাজবেন্ড হান্টিং ইন দ্য রাজ’ গ্রন্থে লিখেছেন যে ভালো জোড়া না মেলাতে না পারা ইংরেজ তরুণীদের জন্য উনিশ শতক নাগাদ ভারত এক বিরাট বিয়ের বাজার হয়ে উঠেছিল। ইংরেজ তরুনীরা আসতেন জাহাজে। বিয়ের জন্য ভারতে আসা ইংরেজ তরুনীদের বহন করা জাহাজগুলোকে বলা হত ফিশিং ফ্লীট।
আঠারো শতকের শেষভাগ পর্যন্ত ভারতীয় নারীদের বিয়ে করা বা রক্ষিতা হিসেবে রাখা ছিল ইংরেজ পুরুষদের সাধারণ চর্চা। অবশ্য শ্বেতাঙ্গ নারী পাওয়ার পর বিবাহিত ভারতীয় নারীকে কিছু ক্ষতিপূরণ সহকারে বিদায় করে দেয়া হত।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে সাধারন ব্রিটিশ সেনাদের বিয়ে করার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এর পরিবর্তে তারা সেনাদের ভারতীয় রক্ষিতা বা সাময়িক স্ত্রী রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দিত।
মেরি মার্থা শেরউড (১৭৭৫-১৮৫১ খ্রি.) লিখেছেন, ‘ভারতে অবস্থানকালে ব্যারাকের প্রত্যেক শ্বেতাঙ্গ পুরুষ সাময়িকভাবে একজন কালো (ভারতীয়) নারীকে স্ত্রী হিসেবে রাখতে পারতেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এসব নারীরা ব্যারাকের কাছে কুড়েঘরে বাস করতো। তারা শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের চাকরের মত কাজ করতো।’ মেরি আরও জানিয়েছেন এসব নারীরা সেই ইংরেজ পুরুষদের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতেন। তাদের সন্তান পালন করতেন। আর একদিন এই ইংরেজ পুরুষরা তাদের অথৈ সাগরে ফেলে নিজের দেশে ফেরত যেত। আর সেই শিশুদের আশ্রয় মিলত অনাথ স্কুলে। কিন্তু মায়েদের আশ্রয় নেয়ার কোন জায়গা থাকতো না। কারণ শ্বেতাঙ্গ পুরুষের সঙ্গে মিলনের ফলে সে তার জাত হারিয়েছে। তাই আরেকজন শ্বেতাঙ্গ পুরুষের সমায়িক স্ত্রী হওয়া ব্যাতীত তার কোন উপায় থাকতো না।
সাময়িক বিয়ে বা রক্ষিতা রাখার বাইরে ভারতীয় নারীেেদর স্থায়ী বিয়ে করার নজিরও আছে অনেক। উনিশ শতকের আগ পর্যন্ত এটা বেশ সাধারণ ঘটনাই ছিল। কিন্তু এরপর থেকে এ প্রবণতা কমতে থাকে। ১৮১০ থ্রিস্টাব্দে লেখা নিজের ডায়েরিতে মেরি মার্থা শেরউড একজন ইংরেজ ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। এই ডাক্তারের বয়স তখন প্রায় সত্তরের বেশি। তিনি তরুণ বয়স থেকেই ভারতে ছিলেন। বিয়ে করেন এক ভারতীয় নারীকে। এ দম্পতির সন্তান ছিল সাতজন। সন্তানদের সবারই গাত্রবর্ণ কৃষ্ণকায়।
এমা রবার্টস এবং ফ্যানি পার্কস উভয়ই ১৯৩০ এর দশকে বর্ণনা করেছেন কর্ণেল গার্ডনার এর বিয়ের কথা। কর্ণেল গার্ডনার বিয়ে করেছিলেন এক মুসলিম শাহজাদীকে। এ দম্পতির সন্তানদের নাম খ্রিস্টান এবং মুসলিম উভয় ঐতিহ্য অনুসারে ছিল। কর্নেল গার্ডনারের স্ত্রীর নাম ছিল নওয়াব মাতমুনজেল উল নিসা বেগম। মাতমুনজেল উল নিসা ছিলেন ক্যাম্বের শাহজাদী।

এত গরম!
ভারতের উষ্ণতা ভালোই ভুগিয়েছে ইংরেজ মেমসাহেবদের। ভারতের গরম তাদের জন্য বেশ কষ্টদায়ক ছিল। ভারতবর্ষের গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়া ইংরেজ নারীদের জন্য কতটা অসহ্য ছিল তার এক জ্বলন্ত সাক্ষ্য হয়ে আছে ফ্যানি পার্কসের মন্তব্য। ফ্যানি পার্কস (১৭৯৪-১৮৭৫ খ্রি.) ভারতে এসেছিলেন ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে। তিনি ছিলেন ভারতে কর্মরত এক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তার মেয়ে। ফ্যানির স্বামী ছিলেন এলাহাবাদের এক সিভিল সার্ভেন্ট। ফ্যানি ভারতে ছিলেন ২৪ বছর। তার ভারত বৃন্তান্তকে সে সময়ের ভরতকে বুঝতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। ফ্যানি কোন এক জুন মাসে লিখেছেন ‘ভেজা বাতাস আমার ওপর ভারী হয়ে চেপে বসেছে, অবসাদগ্রস্থ মনে হচ্ছে নিজেকে। কিছু খাওয়া বা পান করার উদ্যমও আর অবশিষ্ট নেই। গরমে ঘুমানো প্রায় অসম্ভব। সন্ধ্যা সাতটায় উত্তপ্ত বাতাসে ঘোড়া নিয়ে বের হলাম এবং দগ্ধ, প্রায় অচেতন অবস্থায় বাড়ি ফিরলাম। ২৮ ঘন্টার মধ্যে সেই মুহূর্তটাই আমার একমাত্র আরামের, তখন আমি ইংল্যান্ডে ঘরে তৈরি এক গ্লাস বরফ দেয়া ব্ল্যাককারেন্ট ওয়াইন নিয়ে বসি। এটাই এখন আমার কল্পনার সবচেয়ে বড় বিলাসিতা...সারাদিন কোন কাজ এগোয় না, নির্জীব আর ক্লান্ত : এই ভারত এক জঘন্য দেশ!...আমার দুর্ভাগ্য যে পিতৃভূমি থেকে এই মরকের দেশে আমাকে সাময়িকভাবে বসবাস করতে হচ্ছে!
অগাস্টা কিং ছিলেন এক ইংরেজ সরকারি কর্তার স্ত্রী। ১৮৭৭ থেকে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দ সময়কালের ভারতের বর্ণণা এসেছে তার লেখায়। ইতালির ওপর তার লেখা একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল। অগাস্টা কিং লিখেছেন যিনি ভারত, “যিনি আফ্রিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়া সফর করেছেন, তিনি এসব অঞ্চলের আবহাওয়ার কিছু অদ্ভুত প্রকৃতি সম্পর্কে জানেন। একই ডিগ্রী তাপমাত্রায় অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে ভারতে গরম অনেক বেশি অনুভূত হয়। এর প্রমাণও আছে, থার্মোমিটারে ভারত এবং অস্ট্রেলিয়ার তাপমাত্রা এক হলেও অস্ট্রেলিয়ায় মানুষ এবং কুকুরকে জীবিত রাখতে ভারতের মতো পাংখা (পাখা) ব্যবহার করতে হয় না। ভারতের সমভূমিকে উপনিবেশে রূপান্তরিত করা সব সময়ই অসম্ভব। কারন ভারতের গরমের কারনে এখানকার দ্বিতীয় প্রজন্ম এবং শৈশব কাটানো ইংরেজরা ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে পড়েছেন। গরমে তাদের দেহ ও মন ধ্বংস হয়ে গেছে। থার্মোমিটারে রেকর্ড করা তাপমাত্রা দিয়ে ভারতের গরমের ভোগান্তি বোঝানো যাবে না। এখানে গরমের ভোগান্তির জন্য বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা দরকার।”
ভারতের আবহাওয়া ব্রিটিশ নারী-পুরুষ কারুর জন্যই সুবিধার ছিল না। বলা হত, সকালে সুস্থ-সবল একজন ব্রিটিশ পুরষ রাতে মারা যেতে পারতেন।

ভারতীয় আয়া:
ভারতে থাকা শ্বেতাঙ্গ নারীদের সন্তান লালন-পালনে সহায়তা করতেন ভারতীয় নারীরা। যাদের আয়া নামে সম্বোধন করা হত। অবশ্য অনেক ভারতীয় পুরুষও ইংরেজ শিশুদের দেখাশোনা করতেন। অনেক ইংরেজ নারী যেমণ এই আয়া বা শিশু লালন-পালনকারীদের প্রশংসা করেছেন তেমনি অনেকে এই ভারতীয় আয়াদের দেখেছেন অত্যন্ত ঘৃণার দৃষ্টিতে। মেরি মার্থা শেরউড (১৭৭৫-১৮৫১ খ্রি.) ছিলেন এক গ্রাম্য পাদ্রীর মেয়ে। মেরির স্বামী ছিলেন ইংরেজ কর্মকর্তা। মেরি ভারতে ছিলেন ১৮০৬ থেকে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে। তিনি সেনাদের এতিম সন্তানদের শিক্ষাদানে সহায়তা করতেন এবং শিশুদের জন্য ধর্মীয় উপদেশমূলক গল্প লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মেরি মার্থা শেরউডের শিশু সন্তানকে দেখভাল করতেন এক ভারতীয় পুুরুষ। মেরি তার শিশুর প্রতি সেই পুরুষের ভালোবাসার অকুন্ঠ প্রশংসা করেছেন। শিশুটির জ্বরের সময় সেই ভারতীয় তার বিছানার পাশে পরম মমতা আর উদ্বেগ নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন। মেরি লিখেছেন, ‘সে এক কোমল মনের মায়ের মতো আমার সন্তানের পাশে বসে অপেক্ষা করতো । তার সেই নরম, সুরেলা গলায় ‘বাব জী, বাবা জী’ ডাক আমি কোনদিন ভুলবো না।’
কিন্তু হেলেন ম্যাকেনজি এককথায় ঘৃণা করতেন ভারতীয় আয়াদের। এ দম্পতি ভারতে ছিলেন ১৮৪৬ থেকে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে। হেলেনের মতে তাদের সন্তানদের জন্য ইউরোপিয় আয়া রাখা উচিত। হেলেনের কথায়, ‘মায়েরা যদি সন্তানকে সব সময় নিজের কাছে না রাখতে পারেন তাহলে এদেশে সন্তানরা একবারে ধ্বংস হয়ে যাবে। ... আমি মনে করি সন্তানরা কথা বলা শুরু করলে সামর্থ্যবান সবারই ইউরোপিয় নার্স রাখা উচিত।’ ভারতের মানুষ নিয়ে হেলেন অত্যন্ত নেতিবাচক ধারণা পোষণ করতেন। তিনি লিখেছেন, ‘আজ আমরা একটি সুন্দরী বালিকাকে উচ্চস্বরে গান গাইতে দেখলাম। মি. ম্যাকেনজি আমাকে বললেন যে, সেই বালিকার গানের কথাগুলো এতটাই খারাপ আর জঘন্য যে লন্ডনের সবচেয়ে খারাপ মানুষগুলোও এগুলো সহজে গাইবে না। স্কুলে শিশুদের যেসব কবিতা সেখানো হয় সেগুলো উচ্চারণ করা যায় না।’

মশা, সাপ, পোকামাকড় :
ভারতের পোকা-মাকড় এবং সাপ ছিল অনেক ইংরেজ নারীর চক্ষুশূল। এ বিষয়ে জীবন্ত এক বর্ণনা লিখেছেন জুলিয়া শার্লোট মেটল্যান্ড। জুলিয়া ছিলেন এক জেলা জজের স্ত্রী। তিনি ভারতে ছিলেন ১৮৩৬ থেকে ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে। তিনি শিশুদের জন্য কিছু গল্পও লিখেছেন। জুলিয়া শার্লোট মেটল্যান্ডের জবানী-‘এখানে অনেক লম্বা লম্বা সাপ আছে, সাত ফুট লম্বা আর আমার বাহুর মতো মোটা! এসব সাপে বিষ নেই, তবু আমি সব সময় এসব সাপ মেরে ফেলার ব্যবস্থা করেছি কারণ সাপ খুবই ভয়ানক জীব। বিষধর না হলেও সাপ খুব বাজে জীব, কোন সাপের প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই। কিন্তু সাপের চেয়েও ভয়ানক জীব আছে এখানে যেমণ- বৃশ্চিক, শতপদী আর সবুজ বাগ। বিরাট আকারের উড়ন্ত বাগ! এরা কামড় দেয় না কিন্তু চারপাশের বাতাস দুর্গন্ধে ভরিয়ে দেয়। রাতে যখন বাতাস থাকে না তখন এরা মানুষের কাপড় ও চুলের মধ্যে ঢুকে পড়ে- ভয়ানক! ভারতে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি এই সবুজ বাগগুলোকে। এই বিশ্রী বাগগুলোকে আমি প্রথম চিনেছিলাম যখন এদের একটি এসে আমার কাধে বসেছিল। সুড়সুড়ি লাগায় হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়ে অসতর্কতার ফলে বাগটি পিষ্ট হয়ে যায়। জীবনে যতদিন আমি বেঁচে থাকবো সেই দুর্গন্ধ আমি কখোনো ভুলবো না! আয়া যত দ্রুত সম্ভব আমার কাপড় খুলে দিল। আমি তখন অজ্ঞান প্রায়, বুঝতেও পারিনি আয়া কী করছে। এগুলো কতটা ভয়ানক সে সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণাই নেই! এই সবুজ বাগগুলোকে আমি বলি ‘প্রাচ্যের বিলাসিতা’।
মশাকে ভারতের অভিশাপ বলে মনে করতেন ক্রিস্টিনা সিনক্লেয়ার ব্রেমনার। ব্রেমনার ভারতে ইংরেজ রাজের সমালোচনা করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ইংল্যান্ডে নারীদের শিক্ষা এবং বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকারের আদায়ের পক্ষে কাজ করেছেন। সেসময় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত ছিল যে মশারা নাকি শুধু ভারতে নতুন আসা মানুষদের তাজা মিস্টি রক্ত খায়। আর ক্রিস্টিনা সিনক্লেয়ার ব্রেমনার লিখেছেন ভারতের মশারা নারীদের ওপর আক্রমণ করতে বেশি পছন্দ করে। তিনি লিখেছেন, ‘এমনটা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে মশারা পুরুষদের আক্রমণ করে না। পুরুষদের রক্তে থাকে তামাক আর হুইস্কির বিকট স্বাদ আর বিপরীতক্রমে নারীদের ত্বক অনেক কোমল, তাই মশারা তাদের দানবীয় শক্তি উৎসর্গ করতো নারীদের জীবন অতিষ্ট করে তুলতে।’
ক্রিস্টিনা সিনক্লেয়ার ব্রেমনারকে বলা হত শীতকালে ভারতে মশা কামড়ায় না। কিন্তু শীতেই মশার কামড়ে তার মুখ ফুলে উঠতো। ব্রেমনারের কথায় মশা সৃষ্টির সময় তার উপস্থিত থাকার সুযোগ থাকলে তিনি এই অশুভ শক্তি সৃষ্টির বিরোধিতা করতেন। আর যদি তার এই প্রার্থনা ব্যার্থ হত তাহলে তিনি চাইতেন যেন মশা শুধু ভারতীয় আর পুরুষদের কামড়ায়।
ভারতে মশা নিয়ে ক্রিস্টিনা সিনক্লেয়ার ব্রেমনার কতটা বিরক্ত ছিলেন সেটা বোঝা যায় যখন তিনি মশাকে ভারতের সত্যিকার অভিশাপ বলে বর্ণনা করেন। ক্রিস্টিনা সিনক্লেয়ার লিখেছেন, ‘ওহ ভারত! তোমার অভিশাপ কংগ্রেসওয়ালা নয়...বাল্য বিবাহ নয়, নারীদের দাসতুল্য অবস্থাও নয়, ভারতের সত্যিকার অভিশাপ হল মশা।’

তথ্যসূত্র :
Memsahibs Abroad : Writings by Women Travellers in Nineteenth Century India, ed. Indira Ghose, Oxford University Press, New Delhi, 2008.
Memsahibs’ Writings : Colonial Narratives on Indian Women, ed. Indrani Sen, Orient BlackSwan, New Delhi, 2012.
Courcy, Anne De, The Fishing Fleet : Husband-Hunting in the Raj, Phoenix, London, 2013.
Sen, Indrani, Women and Empire : Representations in the Writings of British India (1858-1900), Orient Longman, Hyderabad, 2005.
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ২:২৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×