প্রত্যেকটি মানুষের রয়েছে নানাবিধ সম্পর্ক স্থাপণের মতা। যদি জীবনকে কেবল একটি সময় পরিক্রমা হিসেবে মনে করে নেই তাহলেও একটি বিষয় স্পষ্ট যে মানুষ তার সীমিত বা দীর্ঘ জীবনে নানাবিধ সমর্্পকের মধ্যে দিয়ে সচল থাকে।
কিছু কিছু সম্পর্ক মানুষের ইচ্ছানিরপে অবস্থাতেই বলবৎ থাকে। যেমন, যে পরিবারে বা পরিবেশে তার জন্ম সেই চারপাশ বা সেই পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক। জনপ্রিয় পরিবার মতাদর্শে এখন পর্যন্ত এই সম্পর্ককেই অবধারিত বলে মনে করা হয়ে থাকে। আসলে অবধারিত হওয়ার মধ্যে দিয়েই যেন এই সম্পর্কগুলোর পোক্ত অবস্থানটি স্পষ্ট হয়। আবার একইসাথে রয়েছে মানুষের পারিবারিক পরিমন্ডলের বাইরের সম্পর্ক। এই সম্পর্কগুলো সংখ্যাগত হিসেবে বা মাত্রাগত বিভিন্নতায় বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমরা সহজেই সম্পর্কের যে মাত্রাগত তুলনা করে থাকি সেটিরও রয়েছে অভাবনীয় অনেক নতুন নতুন মাত্রা। কিন্তু পরিবার কাঠামোর মতাদর্শ আমাদের মধ্যে এতটা গ্রথিত যে মাত্রাগত ভিন্নতায় অধিকাংশ েেত্র পরিবারগত সম্পর্ক একটি সহজাত উচ্চতর আসন লাভ করে এবং এরপর আমরা অন্যান্য সম্পর্কগুলোকে সাজাই। এটি সমর্্পকের বেশ মজার একটি ক্রমময়তাকে আমাদের সামনে হাজির করে।
শৈশবে আমাদের যখন জিগ্গেস করা হত- 'সোনামনি বলত তুমি কাকে বেশি ভালবাস আব্বুকে না আম্মুকে' তখনই সম্পর্ক, ভালোবাসাগত একটি তুলনা আমাদের সামনে ঝুলিয়ে দেবার একটি প্রচ্ছন্ন প্রচেষ্টা ক্রিয়াশীল থাকত। আমার মনে হয় এই তুলনামূলক দ্বৈততা বেশ অসচেতনভাবেই আমাদের পিতামাতা তাদের পিতামাতা তাদেরও পিতামাতা এভাবে চলে এসেছে, অথবা এটি একটি সচেতন প্রচেষ্টারই ভিন্ন রুপ হতে পারে। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটাই অধিকাংশ েেত্র একটি অন্ত:শীল স্রোতের মত যা এখন এতটা 'স্বাভাবিক' হয়ে উঠেছে যে এ নিয়ে প্রশ্ন করাও অবান্তর মনে হয়। কিন্তু এই পুরো বিষয়টা পাল্টে যায় একজন পিতামাতাহীন সন্তানের েেত্র। আমি এেেত্র প্রথমত নির্দেশ করতে চাইছি সমাজে এতিম/বাস্তুহীন/জারজ বলে পরিচিত মানুষগুলোকে যারা তাদের জৈব পিতামাতাকে নির্দিষ্ট করতে পারেনা।সম্পর্কের এই যে জৈব-নির্ধারণবাদী ধরণ তা কতটা পোক্ত (যেহেতু পোক্ততা অনেকের কাছে খুব মৌল বিষয়) তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অথচ এমন অনেকে আছেন যারা তাদের পিতামাতা বা কেউ একজনকে ছেলে-বেলায় হারিয়েছেন বা বড়-বেলায় হারিয়েছেন। ল্য করলে দেখা যায় যে এই সম্পর্ক বিন্যাস ও সম্পর্কের বৈচিত্র্য কোন একক অবস্থানকে নির্দেশ করে না। আমার মনে হয় এই সম্পর্কগুলোর মধ্যে যেমন মিলের জায়গা রয়েছে তেমনি রয়েছে অসাধারণ বৈচিত্র্য। আবার সন্তানের সাথে পিতামাতার সম্পর্কও কোন একটি সাধারণ সূত্র মেনে চলেনা। এটিও সন্তান ও পিতামাতা ভেদে বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম, বিভিন্ন প্রেীতে বিভিন্ন রকম, লিঙ্গভেদে বিভিন্নরকম, বয়স ভেদে বিভিন্ন রকম এরকম অগণিত বিভিন্ন রকম। সম্পর্কের একটি আদর্শায়িত রূপ সবসময়ই একটি সামাজিক, মতাদর্শিক, অর্থনৈতিক, উপলব্ধিভিত্তিক নির্মাণ। আবার এই নির্মাণেরও অনেক রকম বিদ্যমান।
কখনো মনে হতে পারে যে সম্পর্কর্ের েেত্র মানুষের নিজের করার তেমন কিছু থাকেনা যেন তার চারপাশই সবকিছু ঠিক করে দিচ্ছে। আবার কখনো এমনও মনে হতে পারে যে ব্যাক্তি নিজেই তার সব সম্পর্কের নিয়ন্তা। আমার কাছে এই দুই ধরণের স্থির অনড় অবস্থানকে খুব গোলমেলে মনে হয়। কারণ মানুষ কখনই এই দুই মাত্রার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনা। সে যেমন চারপাশ বা অবস্থান দ্বারা প্রভাবিত হয় তেমনি তার চারপাশ বা অবস্থানকে প্রভাবিতও করতে সম। যে কোন মানুষ তার সমগ্র জীবনে বহুবিচিত্র সম্পর্কের মধ্য দিয়ে যেমন যায় আবার কিছু কিছু সম্পর্ককে সে জড়িয়েও রাখে, কিছু কিছু সম্পর্ককে সে লুকিয়ে রাখে, কিছু কিছু সম্পর্ককে সে যাপণ করে, কিছু কিছু সম্পর্ককে সে ভুলে যেতে চায়, কিছু কিছু সম্পর্কের জন্য তার নিয়ত কষ্ট হয়, কিছু কিছু সম্পর্কের জন্য তার আনন্দও হয়। আবার ঠিক উল্টোটাও ঘটে, সম্পর্ক তাকে নিয়ন্ত্রণ করে, আশ্রয় দেয়, কখনো আনন্দ দেয়, সুবিধা দেয়, সুখ দেয়, স্বস্তি দেয়। কখনো সম্পর্ক কান্তিকর বা চাপ হয়ে উঠলে সে সম্পর্ক থেকে পালায়, কখনো নতুন বা অন্য সম্পর্কে যায় অথবা যে কোন ধরণের সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে পছন্দ করে। তবে এত্রে আমার একটি জিগ্গাসা হল আদৌ কোন মানুষের প েপুরোপুরি সম্পর্কহীন হওয়া সম্ভব কিনা। কেননা 'স্বাবলম্বিতার' চূড়ান্ত অবস্থানে তার যদি অন্য মানুষকেন্দ্রীক সম্পর্ককে উপাে করার অবস্থানও তৈরী হয় তাহলেও তার সম্পর্ক তৈরীর প্রবণতা কি স্তব্ধ হয়ে যায় কিনা। কেননা মানুষ অনবরত মানুষ ভিন্ন অন্য অনেক কিছুর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে। হতে পারে সেটি প্রিয় বই, প্রিয় ফুল, অপ্রিয় বাসস্থান, চিন্তা, উপলব্ধি এমন অজৈব জৈব অনেক কিছুই। আমার কাছে সম্পর্কের বৃহত্তর অর্থ অনেকটা এমন যে অপ্রিয়তা বা অপছন্দও আসলে একধরণের সম্পর্কই ।
মানুষ সম্ভবত সবচেয়ে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত হয় তার উপলব্ধি বা চিন্তার সাথে (যদিও এটিও স্থির কিছু নয়)। কোন কোন মানুষ তার চিন্তা বা কাজের সাথে এতটা সম্পৃক্ত বোধ করেন যে বাকি সব সম্পর্ক তার কাছে চিন্তা বা কাজের অনুসঙ্গ হয়ে ওঠে। তিনি এমনভাবে অভ্যস্তও হতে পারেন যে চিন্তা বা কাজ বহিভর্ূত সম্পর্ক তার কাছে মূল্যহীন হয়ে উঠতে পারে। আদতে কোন সম্পর্কর্র্ই উচ্চ বা নিম্ন নয়। তবে আমরা আমাদের পছন্দ অনুযায়ী সমর্্পকের বিভিন্ন মাত্রাকরণ ঘটিয়ে থাকি। একটি 'উচ্চনিম্ন' স্তরগত চিন্তার ফাঁকটা হল এই যে একজন প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবির চিন্তা, কাজের সম্পর্ক বা খুব সাধারণীকৃত স্বরে একজন মাঝির তার নৌকার সাথে সম্পর্ক আদতে এই দুটোর মধ্যে কোনটাই কোনটার চাইতে উচ্চ বা নিম্ন নয়। বরং বিশেষ ধরণের ধারণা কাঠামো এই শ্রেণীকরণ করে। আমার মনে হয় অধ্যয়নের বিষয় হওয়া উচিৎ কিভাবে কোন প্রক্রিয়ায় এই উচ্চ-নিম্ন নির্ধারিত হচ্ছে সেটিকে দেখার চেষ্টা করা। একইসাথে এটাও ভাবা খুবই জরুরী যে কোন ঔচিত্য বোধ থেকে এই ধরণের প্রস্তাবনা আসছে।
সম্পর্ক জালের একটি প্রায় অনুদঘাটিত অংশের নাম হল নারী-পুরুষ সম্পর্ক। এটি সম্পর্ক বিষয়ক অস্পষ্টতার বা জানতে না চাওয়ার সমপ্রসারণ কেবল নয়। ধরণে ও গঠনে এবং বিশেষত নারীর প্রতি নিপীড়ণের কারণে এটি একটি অনন্য নিজস্ব মাত্রা পেয়েছে, যা নারীবাদীদের কাজে দূর্দান্তভাবে উঠে এসেছে। পৃথিবীর বিভিন্ন সমাজে নারী পুরুষ সম্পর্কের যে আদর্শায়িত চিত্র বিদ্যমান, সেটি মূলত নারীর প্রতি একটি অবদমনমূলক পরিস্থিতিকে প্রতিষ্ঠিত ও চলমান রাখার েেত্র ক্রিয়াশীল। কিন্তু একই সাথে অনেক বেশি 'বাদীতা-গ্রস্থ' না হলে এটিও মনে রাখার আবশ্যক যে সমাজ ও প্রেীত ভেদে এর বৈচিত্র্য অসীম সংখ্যক। যে কোন সম্পর্ক একটি আদশর্ায়িত শক্তপোক্ত অবস্থানকে নির্দেশ করলে সেটির দিকে সন্দেহ নিয়ে না তাকানোর মত অবস্থান বোধহয় এখন আমাদের আর নেই। কিন্তু সতর্ক থাকা উচিৎ যে 'বাদীতাও' আমাদেরকে একটি মতাদর্শিক সম্পর্ক জালের মধ্যে আটকে ফেলতে পারে।
সম্পর্ক যেমন মানুষকে মুক্ত করে, নিশ্বাসের জায়গা দেয় তেমনি বদ্ধ করে, লোভী করে, বিবেচনাবোধহীন করে তুলতে পারে এবং সবচেয়ে বেশি করে যেটা পারে সেটি হল কোন কিছুতে অভ্যস্ত করে তোলা। যেকোন সম্পর্ক আমার কাছে অনেকটা বইয়ের মত, যা একই সাথে শিণীয় ও সুখকর তেমনি দূরহ ও বদ্ধও হতে পারে। কোন কোন সম্পর্ক জাল এতটা প্রতিষ্ঠিত যে সেটিতে আপনি বদ্ধ বোধ করলেও আপনার সেটিকে ছিঁড়ে বেরিয়ে যাবার কোন উপায় থাকে না। অনেকে আবার মূল্যবোধগত, রাজনৈতিক সমপ্রিতিগত, সুবিধাগত, মতাগত সম্পর্কে এতটা নিমজ্জমান থাকেন যে অপরাপর সম্পর্কগুলোকে উপো করেন। তখন বোধহয় আমাদের প্রয়োজন হয় নতুন সম্পর্কের অথবা সম্পর্কগুলোকে নতুনভাবে গঠন করার। মানুষ খুব সহজেই সম্পর্কের জালে জড়িয়ে পড়ে, পণ্যের সাথে ক্রেতার সম্পর্ক জাল কিভাবে সক্রিয় হয়ে উঠে বৃহত্তর পূঁজিবাদী জালে সবাইকে জড়িয়ে ফেলে সে বিষয়ে হয়ত অনেকের প্রশ্নই জাগেনা। একইভাবে বৃহত্তর আধিপত্যশীল শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের সম্পর্কের জাল, নানা উপলব্ধি নানাভাবে প্রতিরোধের অবস্থান নেয়। সবাই যে জালে জড়িয়েও পড়েন তা আবশ্যিকভাবে ঘটেনা। কিন্তু কোন েেত্রই কোন একক সম্পর্ক ক্রিয়াশীল থাকেনা, থাকে অসীম সংখ্যক সম্পর্ক জালের এক অসামান্য উপস্থিতি।
সচেতন না থাকলে যে কোন সম্পর্কই হয়ে উঠতে পারে কান্তিকর, অথবা জীবনের সূর্যাস্তে উপলব্ধি হতে পারে যে সম্পর্কগুলো কেমন বদ্ধ ছিল। আবার অন্যদিকে সৃষ্টি, কমর্, চিন্তা বিকাশের সহযোগী সম্পর্ককে নিয়ে অনেকে আনন্দিতও থাকতে পারেন। তবে সব সম্পর্কের মধ্যেই নিহিত থাকে সেটিকে ছাড়িয়ে যাবার সুপ্ত প্রতিভা, মানুষ যদি সত্যিই চায় ও সচেতন হয়ে ওঠে তাহলে সে সম্পর্কের জালের পরিবর্তে জালহীন সম্পর্ককে উপভোগ করতে পারে এবং ছাড়িয়ে যেতে পারে এদুটোকেই।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।

