বোটানিক্যাল গার্ডেনে ঢোকার গেটটার পাশেই প্রবীণ হিতৈষী সংঘের একটা ক্লাবমত রয়েছে। মত; এইকারণে বললাম যে একটা প্লটকে চারপাশে চাটাই আর টিন দিয়ে ঘিরে বেশ একটা প্রাইভেট স্পেস তৈরি করা হয়েছে। সেই স্পেসের মাঝে আবার নারীদের জন্য পর্দা দেয়া আরেকটা জায়গা এক্সক্লুসিভ। সেখানে তারা ব্যায়াম করেন। ক্লাবমত বলার আরো একটা কারণ হল, ভেতরে দুটো ব্যাডমিন্টন কোর্ট রয়েছে, মূলত শীতকালীন আয়োজন এবং একইসাথে সান্ধ্যকালীণও। তখন সেটা অপেক্ষাকৃত তরুণদের জায়গা। তবে আবারো; যারা নিজেদের ততটা বয়ষ্ক মনে করেন না তারা যৌবনের শান দিতে ব্যাডমিন্টন কোর্টে হাজির হন। তবে সেই সময়টা এখনো শুরু হয়নি, হবে হবে করছে। আর এইসব আবাসন সোসাইটির মূল পরিচয় হয়, মালিক-ভাড়াটিয়া, তিন কাঠা বা পাঁচ কাঠার প্লট এসবের মধ্য দিয়ে। শৈশবে যেমন চড়ুইভাতিতে কে কোন খাবার আনছে, কার বাসায় রান্না হচ্ছে, কে ক্ষমতাবান এসব দিয়ে কতৃত্ব নিশ্চিত হত এখানেও সেসবই।
তো ঢাকার ব্যস্ততায় সকালের বা বিকেলের স্বাস্থ্য-চর্চায় নিবেদিত গোস্ঠীদের মাঝেও শ্রেণী বিভাজন আছে। মনে করেন একদা কর্মরত প্রতিষ্ঠান-ভিত্তিক শ্রেণী বিভাজন, মন্ত্রী, সচিব, ব্যাংক, বিঃবিঃ শিক্ষক কিংবা ব্যবসায়ীদের নিজস্ব প্লে গ্রাউন্ড। সেগুলোর লাক্সারী এবং এক্সেস এর ভিন্নতা থাকলেও গল্পটা মোর অর লেস একই, শেষ বয়সের গুলতানি, স্বাস্থ্য, সাফল্য, ধর্ম, রাজনীতি, ইউটিউবে জীবনের জ্ঞান কিংবা একটি বা দুটি বইয়ের আলাপ। যেমন যেমন শ্রেণী, ইতিহাস, আর যাপিত জীবন তেমন তেমন গল্প। আজকের গল্পের যে কোন আগামাথা নেই তা নিশ্চয়ই এতক্ষণে আপনাদের কাছে স্পষ্ট। ফলে, সামনেও আর কিছু প্রত্যাশা করবেন না এই বিষয়ে আশ্বস্ত হয়েই লিখছি।
বোটানিক্যাল গার্ডেনের হন্টন দলের মাঝে; মধ্যেরও অধিক বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশি। আজই যেমন একজন অভিযোগ করছিলেন. রূপনগরে ৯তলার দালানে পানি আসছে না। পাশ দিয়ে যাওয়া এক আন্টি বলছিলেন, “মেয়েটাকে এবারে নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যেতে হবে, একটা ভাল ছেলে পাওয়া গেছে”।
একদমই তরুণরা সেখানে কমই। আর যারা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই তারা; তীব্র তারুণ্যে যে এখনো আছেন তা নিয়ে লড়াইরত। জমি, প্লট কিংবা টাকা বা সঙ্গের অভিসার নিয়ে কথা বলেন, সেটাও প্রবলবেগে হাঁটতে হাঁটতে। আর কোণায় কোণায় কসরতের জমায়েত। কেউবা ইয়োগা, কেউ বা হু হা, কেউবা স্কোয়াটের দীক্ষা দিয়ে চলেছেন, মানে মোড়ে মোড়ে স্বাস্থ্য গুরুরা রয়েছেন। আর জীবনের কি টান। আহ! বেঁচে থাকার কি আকুলতা।
আরেকটা জায়গা হল এই প্রাক্তণ স্যার ম্যাডামদের জন্য স্বাস্থ্য টেস্ট নিয়ে বসে থাকা কিছু মানুষ। ডায়াবেটিক, ওজন আর ব্লাড প্রেশার প্যাকেজ বিশ টাকা। খাঁটি মধু আর দুধ বিক্রী। সবখানেই একটা সাজসাজ রব, বিশেষত কোভিডের পর যখন থেকে গার্ডেন খোলা হয়েছে। তো হন্টনদলের পোশাকের ভিন্নতা রয়েছে। গড়ে সমস্ত বয়স্ক নারীদের পোশাক ভীষণ আবৃত। পুরুষেরা তুলনামূলক কম। এই যে শেষ বয়সের সাথে বিশ্বাস এবং চর্চার যে বদল তা দেখে আমার খুব ভাবতে ইচ্ছে হল যৌবনে এরা কেমন ছিলেন?
তো যৌবনের কথা যখন উঠলই, তখন বলতেই হবে যে হন্টন দলে প্রেমিক বা দাম্পত্য যুগলের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এঁদের আমরা কাপল বলি বরং। আজ যেমন দেখলাম পুকুরের সাথে তিন থাকের যে ছোট টাওয়ার টা আছে সেখানে এক যুগল বেশ আনন্দে ব্যায়াম করছেন। আর গেট লাগানো অবস্থায় কীভাবে তারা ওখানে গেলেন তা নিয়ে যখন চিন্তা করছি তখনি চুলে কলপ দেয়া আধা-টাকমাথার একজন দেখিয়ে দিলেন কসরৎ টি। আমি এই “স্বাস্থ্য” নিয়েও মাথা গলিয়ে, শরীর বেঁকিয়ে ঠিকই যেতে পারলাম। দৃশ্যটা নিশ্চয়ই বিষ্ময় এবং কৌতুককর ছিল। হবারাই কথা। সেই কাপল এবং পাশের থাকে আরো দুই বন্ধু নোটিস করলেন তা বেশ বোঝা গেল। বেশ বুঝছিলাম,আমার; কাপলদের থাকে মানে স্পটে যাওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে একটু শংকায় পড়েছেন তারা দুজনাই। আমি আর গেলাম না।
এই শহরে কাপলদের দুদন্ড ঘনিষ্ঠ বা কেবল উচ্ছাস প্রকাশের কোন অবকাশ আছে কি? সমাজ তাদেরকে জোরেশোরে ঠেলতে থাকে, চাপাতে থাকে, অপরাধী করতে থাকে। কোন তরুণের খুশি আর তরুণীর উচ্ছাস দেখলে তাদের গা জ্বালা করে। আমার তখন প্রশ্ন এল এই কাপল যখন বিয়ে করে বুড়ো হবে তারা কীভাবে জাজ করবে সেসময়ের তরুণদের? আবার তরুণ মাত্রই উদার নন, উনাদের পরিসীমা বোধও খুব তীব্র, "আশ্চর্য্য এই লোকটার সাথে কেন এই মেয়েটা? এই আন্টির সাথে কেন এই তরুণটা?" মানে সবারই একটা দল দল আর দলের সীমানা বোধ।
যৌবনের আরেকটি দল হলেন স্বাস্থ্য সচেতন একক পরিবার। মানে একটি সন্তান নিয়ে বাবা মা দুজনাই নিয়মিত স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখছেন। দৃশ্যটা সুন্দর। টিভিসি আর পোষ্টার থেকে তুলে আনা। আর এর পেছনেও যে নব্য উদারনৈতিক অর্থনীতির চাপ সেটাও কি আড়াল হয়? এই যে স্বাস্থ্য বিপ্লব, পাড়ায় পাড়ায় মোড়ে মোড়ে সফলতার চাবিকাঠি এরোবিক্স, তায়াকোন্দো, জুম্বা আর জিম। কি বলছে আপনাকে? সফল হতে হলে, ঈর্ষনীয় হতে হলে, আসলে টিকে থাকতে হলেই আপনার স্বাস্থ্যই আপনার চাবিকাঠি। নাহলে জীবনের সব জমানো টাকা দিতে হবে আইসিউতে। জাপানে যেমন; যৌবন প্রলম্বিত হয়েছে বেশ, আর্ন্তজাতিক শ্রমবাজারে সুখে, শান্তিতে, সাফল্যে থাকতে হলে সেই ছোটবেলা থেকে স্বাস্থ্যে থাকতে হবে। পরে আবার এই স্বাস্থ্য নিয়েই কান্নাকাটি। পরিস্থিতি এমন যে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হতে বুড়োরা আর মরছেন না। তরুণরা আর যৌনতায় যাচ্ছেন না। বিয়েতে আর আস্থা নেই। একা থাকাই আনন্দের, শান্তির! এ এক মজার খেলা।
আর এদিকে দলেদলে যৌবন গেল কর্ম, সঙ্গ, যৌনতা, আইডিয়োলজিতে, মধ্যবয়স যাচ্ছে, টাকায় আর হিসাবে আর অভিসারে আর দায়িত্বে। আর বার্ধক্য যাচ্ছে হিসাব মেলাতে মেলাতে। হাহাহাহাহাহা। কি দারুণ আকুলতা।
মা কয়েকদিন আগে জানালেন, “ঐ যে ডায়াবেটিক-ওজন-ব্লাডপ্রেশার মাপা লোকটা; তিনি চলে গেছেন।”
না না হারিয়ে যাননি, মারা গেছেন। এই শহরে সবে একটা ঠাঁই তৈরি করতে করতেই শেষ হয়ে গেলেন। এখন তাঁর তরূনী স্ত্রী সমাজের সকল নিয়ম মেনে, আবৃত হয়ে স্বামীর জায়গায় বসেছেন। সংসার তো চালাতে হবে।
গতকাল বন্ধু যখন জানাচ্ছিলেন, “ঐ যে ঐ সাকিব যার বাসায় আমরা হাঁসপার্টি করলাম, শীতকালে। তার মা চলে গিয়েছেন। আন্টি অনেকদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন”। তখনি মসজিদে ঘোষনা হচ্ছিল, “জনাব সাকিব ভাইয়ের মা…মরহুমার জানাজা…”।
অনেকদিন যোগাযোগ নেই, সাকিবকে আর ফোন করা হয়নি। রাজীব ভাইকে খোঁজখবর করেছি উনার মৃত্যুর পরে, ইনবক্সে লিখেছিলাম, “আপনি ঠিক আছেন তো?”। হয়ত কয়েকদিন পর ফেইসবুকে নতুন ফিচার আসবে, “মৃতরা চলে গেলেও তারা চলে যাননি, তারা রয়ে গেছেন, এই এ্যাপটি ব্যবহার করলে…”
এইসব ছাইপাশ ভাবতে ভাবতে যখন বাসার পথে উঠেছি, কিছুদূর যেতেই দেখি পুলিশের গাড়ী। দোতালা একটা বাসা। বাসাটার বয়স হয়েছে। যাওয়া আসার পথে প্রায় আড়ালে থাকে। হয় না? কিছু কিছু বাসা থাকে লুকিয়ে। একদম চোখের সামনে কিন্তু মনে থাকেনা. মনে পড়েনা। সেরকম একটা বাসা।
পুলিশের গাড়ীটাও ঝরঝরে।
তো পুলিশ দূর থেকে দেখেই পরিচিত মানুষের মত বললেন, “কেমন আছেন?”
আমার এমন হয়, জন পরিসরে “স্বাস্থ্যের”-ও কিছু ফজিলত আছে, সালাম আর এক্সেস পাই সহজেই। কেউকেটা ভাবে।
আমি বললাম “ভালো। কি হয়েছে?”।
উনার অবস্থাও সকালের মতই অপ্রস্তুত। বাঁ-চোখে কেঁতুর আর পোশক ইন করা নেই। উনি বললেন,
“এই তো। গলায় ফাঁস লাগিয়ে।”
পাশের আরেকজন পুলিশ বললেন, “মনে আছে সেইবার,আপনারে কি অকথ্য গালিগালাজ করছিল, কিন্তু আপনি কিছু বলেন নাই”।
প্রথমজন পরম মমতায় বললেন, “কি আর বলব, নেশা করা মানুষ, নেশা করলে মানুষের কিছু ঠিক থাকে নাকি?”
আমি দ্বিতীয়জনকে বললাম, “আচ্ছা বয়স কত হবে?”
প্রথমজন বললেন, “হবে পয়ত্রিশ চল্লিশ”
দ্বিতীয়জন সাদা পাতার উল্টোপাশে লিখলেন, “৩৫-৪০”
পাশ থেকে একজন জানালেন, “কাল রাত থেকে অনেক চিল্লাচিল্লি করছে, বউ মনে হয় বাচ্চা নিয়ে চলে গেছে।”
“বোনটা যে কি ভালোবাসতো, কালকে বলছে, ঠিক আছে, ঠিক আছে আমি থাকবো না, তারপরও তুই ঠিক হ”।
দ্বিতীয়জন বললেন, “ঘরের ভেতরে কিছু ঠিক নাই, সবকিছু গুড়াগুড়া, ভাঙ্গা, আহারে”।
প্রথমজন দ্বিতীয়জনের সাথে আলাপে বলছেন, “হ্যা হ্যা লাশের গাড়ী লাগবে,ঐ গাড়ী আসতে বলেন” । আর নাম লেখেন, “নবারন”।
দ্বিতীয়জন খসখস করে খাতায় লিখলেন,”নবারন”।
আমি বললাম, “ঘটনা কখন হয়েছে?”
দ্বিতীয়জন বললেন,”এই তো মনে করেন আধাঘন্টা আগে”
আমি বললাম, “আরে আধাঘন্টা আগে তো আমি এই পথ দিয়েই গিয়েছি, কিছু টের পাইনি”
দ্বিতীয়জন সস্নেহে বললেন, “আপনে কীভাবে টের পাবেন?”
পাড়া-প্রতিবেশী আর পুলিশের পরম গুঞ্জনের মধ্য দিয়ে আমি বাসার দিকে হেঁটে আসলাম। দুই পাশে দালান নির্মাণের কাজ সশব্দে চলছে।
আম্মা এখনো খবরটা জানেনা।
এই যে স্বাস্থ্য সচেতন আমি, হাঁটছি হন্টনের দল। ঐ যে বয়ষ্ক বৃদ্ধ ক্ষুধার তাড়ণায় ফাঁসিতে ঝুললেন; আমি টের পাইনি, ঐ যে রাজীব ভাই ঘুমের মাঝে
চলে গেলেন আমি টের পাইনি, ঐ যে ঐ যে ঐ যে ঐ যে…আমরা টের পাবোনা।
মানুষরে যদি টের পাওয়ার ক্ষমতা দিলে তবে তার মত বোকা প্রাণীরে একবার অন্তত মৃত্যুর অভিজ্ঞতা দিয়ে তারপর না-হয় জীবন দিতে হে
পরোয়ারদিগার।
১৩ই অক্টোবর ২০২১, সকাল ৯:৪০, নবারন ফাঁসিতে ঝুলেছেন সকাল ৭:০০, পল্লবী, ঢাকা, বাংলাদেশ। শরৎ চৌধুরী।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই অক্টোবর, ২০২১ সকাল ১০:২২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



