somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পাঞ্জাবী চরিত

২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৮:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘না তাহলে আপনার অমনোযোগও কম নয়; আমি গোড়া থেকেই আপনাকে ফোনে "আমার করা ডিজাইনে" বলে আসছিলাম .. কী করা জগত নিঠুর .. আধা মনোযোগেই কিয়ামত চলে আসবে।'

জন্মদিনের উপহার হিসেবে পাঞ্জাবী-র প্রসঙ্গ আসার আগেই তিনি ফোনে বলেছিলেন,
‘তাহলে জায়গাটা কোথায়? হুমম ধানমন্ডি।’
‘যদি এক ঘন্টার জন্য থাকতে চাই, কোন সময়ের মধ্যে আসতে হবে?
আমি জানিয়েছিলাম,
‘রাত আটটা থেকে দশটা’
তিনি বললেন,
‘ঠিকাছে, তবে সাথে কোন উপহার থাকবেনা’।

জন্মদিনের দাওয়াতে ‘উপহার’ থাকবে না। এই আগাম প্রস্তুতি আমন্ত্রণকারীকে জানিয়ে দেবার বিষয়টি এখনো মধ্যবিত্ত কেতায় ততটা জনপ্রিয় হয়নি। তবে ছ’ বছর পর ঢাকায় ফিরেছি, হতেও পারে।

অনুমান করি যে বিষয়টা অনেকের কাছে খটকা হিসেবেই গণ্য হবে। কেউ কেউ আগ বাড়িয়ে এমনটাও ভাবতে পারেন যে,

‘আরে ভাই দাওয়াত দিয়েছি, উপহার নিয়ে মাথাব্যাথা আছে নাকি?’
‘অহেতুক জটিলতা’।

আরো একদল এমনও ভাবতে পারেন,

‘কি এক আদিখ্যেতা, একটা দেখানো দেখানো ব্যপার, আমি আলাদা হুমম!’।

হুয়ায়ুন আহমেদের পাঠকরা অবশ্য এই কথপোকথনে মিসির আলি-কেও দেখতে পেতে পারেন, এক অনাড়ম্বর অনড় খটমটেপনা।

তবে সেই হুমায়ুনও আর নেই, আর সেইসব ‘চরিত্র’ নিয়ে উত্তেজনাও আগের মত নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে মানস চৌধুরী একজন ‘ক্যারেকটার’। এবং আপনার শিক্ষা জীবনে; এমনকি জীবনেও এমন মানুষেরা দূর্লভ। এটা ঠিক হওয়া যায় না। হতে হয়।

তো সেই সেপ্টেম্বর থেকেই পাঞ্জাবী নিয়ে আমাদের আলাপচারিতা। মানস চৌধুরী যে পোশাকে এবং পরিবেশনে অনন্য তা মোটামুটি একটা সাধারণ জ্ঞান। কথা হলে স্যারকে প্রায়ই বলি,
‘ক্লাসের বদলে, আপনি মঞ্চ অনেক এনজয় করতেন’।
উত্তরে স্যার হাসেন।

তো জন্মদিনের উপহার হিসেবে তিনি ঠিক করলেন আমাকে দুটো পাঞ্জাবী দেবেন। ফলে কিছুদিন আমরা পাঞ্জাবীর সাইজ এবং আড়ং এর সাইজ নাম্বার নিয়ে কোস্তাকুস্তি করলাম। তাতে ঠিক হলনা। মানে স্যারের। স্যার তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি কাপড় কিনে পাঞ্জাবী বানিয়েই দেবেন। আসলে স্যার হয়ত আগেই সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিলেন। আমার ভেতরের মন তখন প্রায় হাঁসফাঁস করছিল; মনে মনে বলছিলাম,

‘স্যার এটাতো টিউটরিয়াল না,আমার জন্মদিনের উপহার’
শরমে আর বলা হয় নাই।

স্যার লেগেই থাকলেন এবং একদিন জানালেন, মোহাম্মদপুরের আসল বাসস্ট্যান্ড মোড় সংলগ্ন, “ইসলামিয়া টেইলার্সে” মাপ দিয়ে আসতে। সেখানে আছেন স্যারের পরিচিত, অত্যন্ত যোগ্য নিষ্ঠাবান আবুল কাশেম সাহেব। তিনি দীর্ঘদিন ধরেই স্যারের পাঞ্জাবী বানিয়ে আসছেন এবং সেই ভদ্রলোকের বানানো পাঞ্জাবী স্যারের পছন্দ হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।

এরইসাথে এখনো মাপে হয় এমন একটি পাঞ্জাবী নিয়ে গেলে যে খুব ভালো হয়, সে কথাও তিনি জানালেন। সেদিন স্যারের সাথেও দেখা হল এবং প্রস্তুতি হিসেবে আমি একটি পাঞ্জাবীও সাথে নিয়ে গেলাম। বলা তো যায়না দেখা হবার পর যদি আবার প্রশ্ন করে বসেন,
‘পাঞ্জাবী কই?’

দেখাটেখা শেষ হবার পরে বেশ কষ্ট করেই সেই ভদ্রলোক আর তাঁর দোকানকে খুঁজে পাওয়া গেল। মাগরিবের নামাজ শেষ করে সবে ফিরেছেন।স্যারকে ফোনে জানালাম। তিনিও কথাটথা বললেন। আমি ভাবলাম যাক শেষ হল। তবে কাশেম সাহেবের সাথে কথা শেষ করতেই বুঝলাম,পাঞ্জাবী নিয়ে হলেও, ওনার মানস চৌধুরীর সাথে নিয়মিত কথা হয়। আর এই কথোপকথনের ছাপ কাশেম সাহেবের কথাতেও বেশ বোঝা যাচ্ছিল।

আমার তখন পাঞ্জবী জমা দিয়ে একটা মুক্তি মুক্তি ভাব। মনে ২য় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হবার আনন্দ।

মনেমনে ভাবছি ‘আর্গুমেন্ট মনে হয় ঠিকই আছে, ফুকোর একটা লোকালাইজড ইন্টারপ্রিটেশন…স্যার মনে হয় ধরতে পারবেন’। পরক্ষণেই মনে হল ‘আরে আমি তো পাঞ্জাবী দিতে এসেছি।’

এরও বেশ কয়েকদিন পরের কথা।

এবার স্যার বললেন,

‘আপনার জোড়া পাঞ্জাবি + ১ টা এখন আমার জিম্মায়। প্রিফার্ড ঠিকানা পাঠান আমি পোস্ট করে দিচ্ছি। পোঁটলা পেয়ে দুঃখ পেলাম যেহেতু ডিজাইনটা আমার বলা রাখেননি। কাশেম ভাইকে ফোন (আমি না গিয়ে শ্যালিকার ড্রাইভারকে পাঠিয়েছিলাম) দেয়াতে তিনি দৃঢ় গলায় দাবি করলেন যে আপনি তাঁকে স্যাম্পল দেয়ার সময় কেবল মাপ নয়, ওই ডিজাইনে বানাতে বলেছেন। তিনি সত্য বলে থাকলে হতাশ হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। আর তিনি কাল্পনিক বললে আপনারই নিজ দায়িত্বে তাঁর সাথে ফোন করে ঝগড়া করা ও ডিজাইনবদল করা ছাড়া অনেক রাস্তা থাকে না।’

ফেইসবুকে স্যার যখন এই কথাগুলো বলছিলেন তখন ধ্বক! করে উঠেছিল। আমাদের তো এখন আর সহজে ধ্বক! করে ওঠা হয় না। আমরা জেনে গেছি সব। জন্মদিন হবে, এক একজন বিভিন্ন ব্র্যান্ড থেকে দাম দিয়ে উপহার কিনে আনবেন। সেই উপহারে, উপহার প্রদানকারীর এবং গ্রহণকারীর সামাজিক মর্যাদা আর সক্ষমতার বিষয়টা থাকবে।
সবই মাপ করা।

একজন মানুষ এত যত্ন করে এত চিন্তা করে, এত মনোযোগ দিয়ে তাঁর ডিজাইনে তাঁর ছাত্রের জন্য পাঞ্জাবী বানাতে দিয়েছেন, সেই ভালোবাসা, সেই অনন্যতা হারিয়ে যাবে।

ভীষণ খটমটে এই মানুষটার উপন্যাসে “নায়ক” আত্মহত্যা করে। তিনি অভিমান করেন,তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণের ছটায় সেটা কোণায় বসে থাকে। কিন্তু সেটা তো আছে।

আজ সেই শুভদিন। আম্মা হাসতে হাসতে হলুদ রংয়ের একটা প্যাকেট নিয়ে হাজির।

আমি বললাম ‘কি?’
তিনি বললেন, ‘তোমার পাঞ্জাবী মনে হয়’
আমি বললাম, ‘কে?’
তিনি বললেন,‘কে আবার মানস পাঠিয়েছে’
একটা হলুদ প্যাকেটের বামদিকে লেখাঃ
ড. মানস চৌধুরী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, সাভার, ঢাকা।

প্যাকেটটার দিকে তাকালাম, রংটা হলুদ। হিমুর রং। হুমায়ুন নেই, কিন্তু মানস চৌধুরী আছেন।
অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার।

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০২১ রাত ৮:১৮
৩টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×