অফিসে আসার পথে প্রায়শই বনানী ১১ হয়ে চেয়ারম্যান বাড়ী ছুঁয়ে টিএনটি মাঠের পাশের সরু রাস্তাটা ব্যবহার করি। বনানী আর মহাখালীর সংযোগ সড়ক হিসেবে এই রাস্তায় দামী গাড়ীর সাথেসাথে, ঝকঝকে পরিষ্কার মানুষেরও দেখা মেলে। আমার কাছে এই রাস্তাটা একটা করিডোর হিসেবেই মনে হয়। মধ্যবিত্ত মহাখালী পার হয়ে এযেন বনানীর স্বর্গ।
সেই করিডোরের যত্ন যে খুব হয় তা কিন্ত না। রাস্তা পানি জমে, মাঝখানে ভাঙ্গা, দুপাশে অশোভন দোকানের সাঁরি। মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত দুজগতের অফিস পাড়াগুলোতে তাশরিফ (পশ্চাৎদেশ) রাখার চেয়ারগুলো যখন জীর্ণ হয়ে যায়, ক্ষয়ে যায় তখন সেগুলো মেরামত করে আবার বিক্রীর জন্য সাজিয়ে রাখা হয় এসব দোকানে।
দুপাশে জীর্ণ মোটর সাইকেলের গ্যারাজ, ছোট্ট একটা মাজার, সস্তার নাস্তার দোকান এবং সিটি কর্পোরেশনের বিরাট একটা ময়লার ডিপো এবং অতিকায় ও অনুদানে পাওয়া হলুদ রংয়ের ময়লার ট্রাক প্রায়ই রাস্তা বন্ধ করে দেয়। পাশে দেয়াল, তার ওপারে মাঠ। বিখ্যাত টিএনটি মাঠ।
মধ্যবিত্ত বাইকার বলে, গাড়ীর এসি এবং এয়ারকন্ডিশের আড়ালে লুকানো সম্ভব হয়না বলে বিকট গন্ধের মাঝে আটকে থাকতে হয় কখনো কখনো। মধ্যবিত্ত আর উচ্চবিত্তের দুই পরিধির মাঝখানে এই করিডোরে পথচারী মানুষ, রিকশা, গাড়ী, বাইক এর ভিড়; কখনো কখনো হাতিরও দেখা মেলে।
এই রাস্তা পার হতে সকল চালককেই নানান কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়; করিডোর পার হবার একটা বিশেষ তাড়া যেন, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত চালকদের। রাস্তাটা নিজের বলে মনে হয় না, যদিও সময় বাঁচায়, আর তাই নিজের নিজের পরিধিতে ঢুকে পড়ার একটা চাপ যেন বিরাজমান থাকে।
রাস্তা সরু হবার কারণে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত সকল চালকের কৌশল মাঝেমাঝে হিউম্যান ফেনোমেনার কাছে পরাস্ত হয়। আজ যেমন পথটার মাঝামাঝিতে একটা বাচ্চা বই হাতে বামদিক থেকে ডানদিকে হেঁটে যাচ্ছিল। হাতে বই ধরা ছিল বলেই কিনা, বেশ অন্যমনষ্ক ছিল। না বাম না ডান কোনদিকে না তাকিয়ে কোন এক স্বপ্নের মধ্যে যেন ছিল। প্রচন্ড জোরে ব্রেক করার ফলে বাচ্চাটার কিছু হয়নি। সে নির্বিঘ্নে রাস্তা পার হয়ে ওপাশে যাবার পরই হই হই টা টের পায়। মালগাড়ীতে ফল বেচা বিক্রেতার পাশেই একজন ভদ্রলোক ডিফেন্সে বলে উঠলেন, "বাচ্চা মানুষ তো, বোঝে নাই"।
আমি উচ্চকন্ঠে বললাম, আমিও শিক্ষক, "ওর ভয় পাওয়া দরকার। ভয় পেলে ওর মনে থাকবে রাস্তার বিষয়ে সতর্ক থাকবে"।
ছেলেটার চুল ছোট ছোট করে কাটা, দাঁত ফোকলা। ওপাশে দাঁড়িয়ে ও বলল,
"আমার ভুল হয়্যা গেছে"। সেই ভদ্রলোকও আবার জানালেন যে শিশুটি ক্ষমা চেয়েছে।
এই বলাটা কোন শিশুর বলা না। এই বলাটা হল উচ্চ শ্রেণীর ধমকে সদা টতস্থ থাকা নিম্ন শ্রেণীর মুচলেকা। যাকে সারাক্ষণ এই শ্রেণী-মাতবরির সাথে মোকাবেলা করতে হয়। যেই "নির্বিকারত্ব/অসচেতনতা" কে দেখে আমার মধ্যবিত্ত সংবেদন লাফিয়ে উঠেছিল, তা আবার বিবেচনা করলাম। ৬/৭ বছর বয়ষ্ক একটা শিশুর নিজের মত করে ভাবনার জন্য একটা নিরাপদ সড়ক আমরা তৈরি করতে পারিনি। তার অন্যমনষ্ক অথবা ভিন্ন জগতে মনষ্ক হবার হবার কোন নিরাপদ জায়গা আমরা দিতে পারিনি। আর আমরাই কিনা বড় বড় কথা বলি।
হ্যা রাস্তা পার হবার বিষয়ে ওর আরো সতর্ক হওয়া দরকার ছিল, কিন্তু ওর আর ভয় পাওয়ার দরকার নেই। শ্রেণীর দাপট এই করিডোরের মানুষকে এমনিতেই এপোলোজেটিক করে রেখেছে।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-র কথায় আবার জানা হল যে এই দেশকে উপনিবেশ হিসেবে ট্রিট করা হয়। এই করিডোরও সেই উপনিবেশেরই ছোট উপনিবেশ। এখানে ছোট ছোট জমিদাররা যাতায়ত করেন এবং তাঁদের সামনে পড়লে, ভুলচুক হলে উপনিবেশিতরা ক্ষমাপ্রার্থী হয়।
এই আমি যখন জাপানে কোন শিশু রাস্তা পার হতে যেয়ে ভুল করলে নিজেই সুমিমাসেন করতাম, কিংবা তার মা বাবা বা অভিভাবক ক্ষমা চাইতো। কিন্তু শিশুটিকে কখনোই ধমকাতাম না। তেমনি এই উপনিবেশ এ এই ধমকানী যেমন শ্রেণীর তেমনি আত্মরক্ষারও। শিশুটিকে মনে করিয়ে দেয়া, দেখো তোমার যত্ন নেবার কেউ কিন্তু নাই, তুমি আরো সাবধানী হও কিন্তু।
বড়বড় বাগড়ম্বররা আমাদের উঠতে বসতে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় দেখায়। দালান আর পিলার দেখিয়ে বলে এইটা উন্নয়ন। সরি, এইটা উন্নয়ন না। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার দেশের শিশুরা নির্বিঘ্নে নিজের জগতে ডুব দেবার জায়গাটা পাচ্ছে। ঘরে বাইরে শিশু হবার সুযোগ পাচ্ছে ততক্ষণ এটা উপনিবেশ, একটা দরিদ্র আর নিষ্ঠুর করিডোর।
শরৎ চৌধুরী, ঢাকা, ৪ঠা অগাস্ট।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:৫১