স্থানঃ প্রবর্তক মোড়
দুই বন্ধু (আমি আর অমি ) বসে চা খাচ্ছি । অমি বেচারা চায়ের সাথে পেইনও খাচ্ছে । আমার ২.৩০ থেকে ক্লাস । তার কেনাকাটা সংক্রান্ত কাজে সাহায্য করার খেসারত দিচ্ছে আমার সাথে আকাইম্মা বসে থেকে । চা খাওয়া শেষ । এ টপিক থেকে ও টপিক ঘুরে এসে অমি আমাকে জিজ্ঞেস করলো “ ওই! তোর HSC এর পয়েন্ট যেন কত? আমি তাকে আমার ঐতিহাসিক রেজাল্টটা বলার পর পাশ থকে একজন মধ্য বয়স্ক লোক,মুখে অল্প কাঁচা পাকা দাড়ি ; এতক্ষন বসে ছিল হয়ত খেয়াল করিনি, বলে উঠলো “আমার ছেলেমেয়ের চেয়েও তো কম” ।
আমি বুঝে উঠতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম । “মানে”? লোকটি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললো “আপনার রেজাল্ট আমার ছেলেমেয়ের চেয়েও কম”।
আমি ঠিক লজ্জা নয়, অনেকটা কৌতুহলেই জিজ্ঞেস করলাম, কত পয়েন্ট? A+? তিনি বললেন A+ তো পাইছেই A+ চেয়ে বেশি পাইছে । ততক্ষনে বুঝে গেছি তিনি রিকশা চালান । জানলাম তার এক ছেলে সরকারি প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছে কদিন আগে, মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সে তৃতীয় বর্ষে পড়ে আর ছোট ছেলে চট্টগ্রাম কলেজে HSC দ্বিতীয় বর্ষে । বাংলাদেশে অনেক রিকশাওয়ালা বাবার সন্তান সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছে,অনেক কষ্টে সংসার চালিয়েছে কিংবা চালাচ্ছে এসব আমরা ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি ।তার মধ্যে দুর্ভাগ্যক্রমে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাও আছেন । আমাদের আরো দুর্ভাগ্য যে এ সংখ্যাটা নেহাতই কম নয় । এসব কথা যেকোন বাবা মায়েরই পড়ালেখা ফাঁকি দেয়া সন্তানদের উদ্দেশ্যে বলা প্রিয় টপিক । বিশেষ করে দুই প্রধান পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল দেয়ার পর পেপারে কয়েক মাস এসব যা নিয়ে লিখা হয় তা আমাকে বাবা শুনিয়ে শুনিয়ে পড়তেন । কিন্তু সামনাসামনি কখনো দেখা হয় নাই বলে অনেকটা কৌতুহলেই তাকে একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকি । যা শুনেছি তা ধারাবাহিক ভাবে বলতে গেলে এমনটি দাঁড়ায় … ‘ লোকটির নাম সুলতান ।গ্রামের বাড়ি রাজশাহী । বর্তমানে চকবাজারে থাকেন । ১৯৮০ সালে ইন্টার পাশ করার পর চট্টগ্রাম আসেন চাকরির উদ্দেশ্যে । পেয়ে ও যান । কিন্তু ঘুষের টাকা না দিতে পারায় তার সে চাকরি আর আশার মুখ দেখেনি । কিন্তু কদিন পর তিনি এমন একজনের সাথে পরিচিত হন যে তাকে নিজ খরচে ‘ওমর গনি এম ই এস কলেজে’ ভর্তি করিয়ে দেন । পরবর্তি চার বছর সে লোকটার বাসার গ্যারেজে রাতে ঘুমাতেন । বিএ পাশ করার পরও তিনি কোন চাকরি না পেয়ে হয়তো সে ক্ষোভেই রিকশাকে বেছে নেন জীবন সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে । সেই থেকে আজও রিকশা চালান । তার ছেলেমেয়েদের কখনো প্রাইভেট পড়াতে দেননি ।ভোর থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত পড়িয়েছেন । কখনো কখনো নিজে বুঝিয়ে দিয়েছেন ।“রাতে ঘুমানোর আগে ছেলেমেয়েদের মাঝে মাঝে বলতাম “ DREAM HAS NO LIMIT !”
তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনার ছেলে তো চাকরি পাইছে । তবুও রিকশা চালান কেন ? তিনি বললেন এ বছরের পর আর চালাবেন না , বয়স হচ্ছে, এখন মাঝে মাঝে রিকশা টানতে কষ্টও হয় । ছেলেমেয়ে এবার তার দেখভার করবে । কথাবার্তার মাঝে আরো জানতে পারলাম তিনি রাতে দুইটা টিউশনি করান । তার স্ত্রী হাউজিং সোসাইটির একটা বাসায় কাজ করে । যে রিকশাটা এখন চালান তা তার নিজের । তার মেয়ে কে ল’ তে পড়ানোর স্বপ্ন ছিলো । আমি তার ছেলেকে পড়িয়ে সে স্বপ্ন পূরনের জন্যে বললাম । তার জীবনে কিছু মানুষের অবদানের কথাও বললেন । আরো অনেক কিছু ।
সব কথপোকথনের একসময় শেষ আসে ।এ ক্ষেত্রেও তাই । তিনিও একসময় রিকশাটা চালিয়ে দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলেন । আমি ভাবলাম এ রকম ঘটনা আমি আগেও অনেক শুনেছি,পড়েছি । এইতো মাত্র কদিন আগেই খুব কাছের একজনের মুখেও এরকমই একটা ঘটনা শুনেছি এবং তা ভুলে যেতেও সময় লাগেনি । কিন্তু এ লোকটাকে ভুলতে আমার কষ্ট হবে তার ঐ কথাটার জন্যে … “রাতে ঘুমানোর আগে ছেলেমেয়েদের মাঝে মাঝে বলতাম “ DREAM HAS NO LIMIT !”
জীবন যুদ্ধে আপাত জয়ী একজন রিকশাচালকের মুখে এ কথাটুকু আমার জীবনে তাকে একটি চিরস্থায়ী স্মৃতিতে পরিনত করে দিলো । আমি জীবনে খুব কম স্বপ্ন দেখেছি । এমনকি, বড় হয়ে কি হবো ? এ স্বপ্নও কখনো দেখিনি আমি । কেউ জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থেকেছি । কখনো কখনো হ্যাবলার মত বলেছি “ এখনো ঠিক করিনি” ।
কিন্তু আজ এ কথা শুনার পর মনে হলো , স্বপ্ন তো দেখতেই পারি আমি । সীমাহীন সে স্বপ্নের সীমানা হয়তো চিরকালই অধরা । কিন্তু হাতটা তো আমরা বাড়াতেই পারি !
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৯:৩৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


