মেয়েটার কোন দোষ ছিল না।
দোষ ছিলনা ছেলেটারও।
একদিন হঠাৎ করে তারা খেয়াল করল, তাদের ভালবাসার খরস্রোতা নদীতে ভাটার টান পড়েছে।
আগের সেই স্পার্কটা কেন যেন এখন আর নেই।
সেলফোনে কথা বলার ডিউরেশন কমতে লাগল আস্তে আস্তে।
মুঠোফোনের মাউইথপিসে খাওয়া চুমুগুলো মধ্যে যেন আবেগহীন হয়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।
যার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনলেও এক সময় অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করত, এখন সেই নিঃশ্বাসের শব্দ শুধু কার্বন-ডাই-অক্সাইডের ঘর্ষণ ছাড়া আর কিছু মনে হয়না।
আস্তে আস্তে দু’টো ব্যাক্তিত্বের মাঝের কনফ্লিক্ট উঠল প্রকট হয়ে। ঠুনকো বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হতে লাগল।
কোন এক শ্রাবণের বৃষ্টির রাতে বর্ষণ হয়েছিল খুব।
সেদিন ঝগড়াও কম হয়নি।
ছেলেটাকে সেদিন অসহ্য মনে হল মেয়েটির। মেয়েটিই মানা করল, তাকে আর কখনো দেখতে না আসতে। আর কখনো ফোন না দিতে।
ছেলেটি কথা শুনেছিল। আর দেখা করতে যায়নি। ফোনও না।
এভাবে কখন তাদের সম্পর্কের মাঝে চিড় ধরল, তারা নিজেরাও বুঝতে পারল না।
যে মেন্টালিটির দূরত্ব আগে চোখে ধরা পড়েনি, ক্রমশ সে দূরত্ব অগম্য হয়ে গেল তাদের কাছে।
কেউ ফোন দিল না সেদিনের পর।
এর পরদিনও ফোনে কথা হল না।
এর পরের দিনও না।
এক সপ্তাহ পর মেয়েটি খেয়াল করল, ছেলেটির ফ্রেন্ডলিস্টের মাঝে সে আর নেই।
ব্যাপারটি খুব গায়ে লাগল তার।
মেয়েটি ভাবল, হয়তো তাকে দেখতে চায়না আর সে। সেদিনই ব্লক করল ছেলেটিকে।
যাও, এবার বুঝ ঠ্যালা!
এদিকে ব্লক খেয়ে ছেলেটার কিছুই হল না- এমন একটা ভাব করে বসে থাকল।
আমি থোরাই কেয়ার করি। দিলে ব্লক দিক গিয়ে। আমার কী!
ফ্রেন্ডদের বাসায় ডেকে আড্ডা বসাল। ফিফা, সিগারেট, বারবি কিউ, পিঙ্ক ফ্লয়েড, রেডিওহেড, কোল্ড প্লে। সেদিন খেয়ালই ছিল না মেয়েটার কথা।
পরদিন রাতে যখন একা আবার সে বিছানায়, হঠাৎ কী জানি নাই নাই মনে হল ছেলেটির।
এ নাইয়ের কোন সংজ্ঞা নেই।
মেয়েটি প্রথম রাতে অনেক কাঁদল। কাঁদল তার বালিশ, বিছানার চাদর, ছেলেটির দেয়া পুতুল।
পরদিন ভার্সিটিতে গেল না।
এর পরদিনও না।
তিনদিনের মাথায় ফেসবুকে আনব্লক করল সে ছেলেটিকে।
ধুর! আগের কথা ভেবে আর কী হবে!
ছেলেটির প্রোফাইলে গেল। ছেলেটি কভার ফটো চেঞ্জ করেছে। তার ক্লাসমেটদের সাথে।
কি সুন্দর দাঁত কেলিয়ে ফটো দিয়েছে গর্দভটা!! বেশ আনন্দেই আছে তাহলে!!
আচ্ছা, আমিও আনন্দে থাকব। ফ্রেন্ডদের দিয়ে ঘুরতে বের হব। ফোন দিল সে তার ছোটবেলার বান্ধবীকে। দুইজন মিলে হাজারো গল্প করল। ঘরের গল্প, পরের গল্প, সিরিয়ালের বরের গল্প।
আর শাপ-শাপান্ত করল ছেলেটির।
আবার সে রাতেই সিনিয়র এক ভাইয়ার সাথে ফেবুতে চ্যাট হল মেয়েটির। লোকটি তাকে বেশ কয়েকমাস ধরেই জ্বালাচ্ছিল। প্রথম প্রথম পাত্তা দেয়নি। কয়েকদিন পর প্রপোজ করায় হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল সে। কিন্তু, আজ ভাবল, কী আর ক্ষতি হবে একটু আধটু কথা বললে!! এভাবেই দুজনের মাঝে তৃতীয় মানবের আবির্ভাব ঘটল খুব আচমকা।
ছেলেটিও কয়েকদিন পর খেয়াল করল, সে আবার আনব্লকড। হলেও কী! সে আমারে ব্লক করসিল কেন!! ধুরো! আর জীবনেও অ্যাড পাঠাব না। যা খুশি করুক।
কিন্তু, রাতে আবার সেই নাই নাই, নাই নাই শূন্যতা। কী যেন একটা নেই। কেউ নেই আবদার করার। নেই রাতে ফোনে চুমু খাবার। সামান্য কথা কাটাকাটির পর ভোরে কারো জন্য মান ভাঙ্গানোর জন্য তার আকুতি-মিনতি শোনার কেউ নেই। কেউ নেই জ্বর হলে, জোর করে ওষুধ খেতে বলার। মুখ থেকে সিগারেট কেড়ে নেয়ারও কেউ নেই।
ছেলেটা ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আর ‘কার্নিভাল ওফ রাস্ট’ শুনে।
এদিকে মেয়েটা এর মাঝে বেশ কয়েকদিন কথা বলে ফেলল ওই সিনিয়র ভাইয়ের সাথে। লোকটাকে আস্তে আস্তে ভাল লাগতে শুরু করে। বেশ গোছালো একটু। তার আগের প্রেমিকের মত এত উড়নচণ্ডী না। উশকো খুশকো থাকে না চুল। হুটহাট কথা বার্তা বলে ফেলে না। পাগলামোও করে না। মাঝে মাঝে ফিলসফিক্যাল স্ট্যাটাস দেয়। এর কিছু বুঝে মেয়েটা। বাকিটা মাথার উপর দিয়ে যায়।
তবুও, কিসের যেন শূন্যতার উপস্থিতি টের পায় মেয়েটা।
এই লোকটার চোখ তো তার আগের প্রেমিকের মত বৈশাখের তুফান না তো।
এর চোখ বড় শান্ত, নির্লিপ্ত। শীতের সকালের মত।
এদিকে ছেলেটি ভাবে, মেয়েটি হয়তো তাকে আর মিস করে না। ওকে ছাড়া ভাল আছে। থাকুক। ভাল থাকার অধিকার তো সবার আছে।
আর তাছাড়া সে নিজেও একা ভাল আছে। কেউ খবরদারি করে না। রাত-বিরাতে কারো সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে হয়না। কারো এক পলক দেখার জন্য ভোরবেলা গিয়ে বাড়ির সামনে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হয়না। কাউকে বাসায় দিয়ে আসার সময় রিকশা না পেয়ে বৃষ্টির মাঝে ভিজতে হয়না।
কেউ পরীক্ষার আগের রাতে ফোন দিয়ে খারাপ মন ভালো করতে বলে না।
এখন কিছুদিন পর পর গিফট আর ডেট বাবদ টাকা খরচ হয়না তার। টিউশনির টাকাগুলো বেঁচে যায়। সেদিনই সে একটা দামি সানগ্লাস কিনল। আর একটা ফাস্ট ট্র্যাকের ঘড়ি।
জীবন হয় সুন্দর!!
মেয়েটি কিন্তু মিস করে ছেলেটাকে।
মাঝে মাঝে ফেসবুকে ছেলেটির সময়রেখায় ঘুরে আসে সে।
সিগারেট ধরেছে বদমাশটা। ধরুক গিয়ে! আমার কী!!
যে আমার খোঁজ নিবে না, তাকে আমি কেন যেচে ভাল কথা বলতে যাব। মরলে মরুক পাজিটা!
ছেলেটা সময় পেলেই মেয়েটার সময়রেখায় বসে থাকে। কভার ফটো ছাড়া আর কিছুই তো পাব্লিক করা থাকে না। এজন্য সে কিছুই দেখতে পায়না। তবুও বাম কোণায় এক ইঞ্চির ছোট বর্গাকার ছবিতে আটকে থাকে তার অতীত।
এভাবে, রাতে জুকারবার্গের বদৌলতে দু’জোড়া চোখ যে দু’টো টাইমলাইনে পরোক্ষভাবে একে অপরকে গভীরভাবে দেখতে থাকে, বাকি পৃথিবীর কেউ সেটা বুঝতে পারে না।
আস্তে আস্তে সময় পেরিয়ে যায়। কয়েকমাস কেটে যায়।
তাদের হৃদয়ের টানের নদীতে চর পড়ে।
সময়রেখায় তাকিয়ে থাকার ডিউরেশনও কমতে থাকে।
তবুও, এখনো মাঝে মাঝে একে অপরকে মিস করে তারা। সেলফোন হাতে নিয়ে মেয়েটা জন্মদিনে বসে থাকে একটা ফোন কলের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় থাকে, হয়তো আসবে কোন কল। বা বড়জোর কোন মেসেজ।
দুনিয়ার আপন-পর সবার কল আসে। মেসেজ আসে। কিন্তু, যার ডাকের অপেক্ষায় থাকে, তার ডাক আর শোনা যায়না।
এদিকে ছেলেটাও কিন্তু সে রাতে বার্থ ডে উইশ কোন এসএমএস লিখতে বসেছিল।
সেই এসএমএস কখনো সেন্ট হয়নি। সেলফোনের ড্রাফট ফোল্ডারেই পড়ে থাকল।
সময় পেরিয়ে যায়।
ছেলেটা কবি হতে থাকে।
মেয়েটা হয়তো বা প্রেমিকা হয় অন্য কারো।
রাত বাড়ে। হাজার বছরের পুরনো রাত। সাথে বাড়ে বয়স। বাড়ে ম্যাচুরিটি।
রাতজাগা ইনসোমনিয়াকের সুদীর্ঘ তালিকায় দু’টো নাম যোগ হয় ধীরে ধীরে।
দূরে কুকুরের ডাক শোনা যায়। হঠাৎ একটা ট্রাক চলে যায় রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে।
অন্ধকারে নিজ রুমে ডিম লাইটের আবছা নীল আলোয় শুয়ে শুয়ে এখনো দুজনেই ভাবে, আসলে ভুলটা কার ছিল?
আসলেই দোষ ছিল কার?
মেয়েটার কোন দোষ ছিল না।
দোষ ছিলনা ছেলেটারও।
দোষ ছিল সময়ের।
দোষ ছিল ভালবাসার...
১৩ ১১ ১৪
ফেসবুক লিঙ্কঃ Click This Link