গত কয়েকদিন ধরে দেশের বাইরে থাকায় চলতি ছাত্র আন্দোলন থেকে দূরেই ছিলাম বলতে গেলে। দেশে এসে পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারছি। প্রিয় একটি মুভির কিছু কথা বার বার মনে পড়ছে। গত কয়েকদিনের প্রেক্ষাপটে সামান্য পরিমার্জিত করে বলা যায়,
"Beneath this protest there is more than flesh. Beneath this protest, there is an idea.
And ideas are bulletproof."
এ কথা অনস্বীকার্য যে, খুব দ্রুতই এই কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। সম্ভবত সরকারের নীতিনির্ধারকেরাও এতটা আশা করেনি। সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সহ প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাই-বোনেরা যেভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কোটাধারী-কোটাহীন নির্বিশেষে এই আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন, তাতে আসলেও অবাক না হয়ে পারছি না! যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের ছাত্র জনতাকে দাবায়ে রাখতে কোন শক্তিই পারেনি। বাংলার ইতিহাসে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ৪৮, ৫২, ৫৪, ৬২, ৬৬, ৬৯, মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ কিংবা ৯০-৯১ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের রক্ত যে ছাত্র জাতির শরীরে বইছে- তাদের জেগে ওঠা ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র।
কোটা প্রথা সংস্কারের দাবি কিন্তু কয়েকদিনের নয়। আমরা সদ্য গ্র্যাজুয়েট যারা ৩৮তম বিসিএস দিয়েছি, এবং এ পদ্ধতির সাথে একটু হলেও পরিচিত, তারা অধিকাংশই এই বৈষম্যের ভুক্তভোগী। মেধার দীর্ঘমেয়াদী মূল্য আমরা কখনো পেয়েছি কি? জীবনের প্রতিটি স্টেজে উঠতে উঠতে ক্রমশ প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে নতুন করে। প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, এসএসসি, এইচএসসি, গ্র্যাজুয়েশন লেভেলে মোটামুটি ভাল মানের রেজাল্ট করেও এখন আবার নতুন করে প্রতিযোগিতায় নামতে হচ্ছে পুরো শূন্য থেকে। এর মাঝে যদি কোটাশূন্যতার কারণে কেউ সরকারি সুযোগ থেকে বাদ পড়ে তার দায়দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের উপরই বর্তায়। অন্তত এই অান্দোলনের পর সরকারের উচিত ব্যাপারটা সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া। বিশেষ করে কোটার শতকরা হার কমিয়ে মানানসই পর্যায়ে নিয়ে আসা। একথা বলাই বাহুল্য, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্যসন্তান। সরকার যদি তাঁদের বিশেষ সুবিধা দিতেই চান, তাহলে দিক, তাতে কারোই কোন আপত্তি নেই। নারী কিংবা আঞ্চলিক কোটার ক্ষেত্রেও কথাটা প্রযোজ্য। কিন্তু হারটা একটু সংশোধন করা সময়ের দাবি। আবার, অনেকে আছেন, যারা এই কোটার সুবিধা নিয়ে একের পর এক পরীক্ষায় সুযোগ নিয়েই যান। কেউ কেউ কয়েকদিন আগে ব্যাংকের নিয়োগে কোটার সুযোগ নিয়ে চাকরি পেয়ে আবার একই কোটাপদ্ধতির সুযোগ নিয়ে বিসিএস এ অংশ নেন। যার ফলে, তেলা মাথায় তেলই ঢালা হচ্ছে। আর কোটাহীন মেধাবীরা ঘা সয়েই যাচ্ছে। ফলে, মেধার বৈষম্য আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে ক্রমাগত।
মোদ্দা কথা, 'Divide and Rule' এবং দমনমূলক নীতি বা ধ্বংসাত্মক উপায় নয়, বরং আলোচনায় বসে দাবিগুলো শুনে এই পদ্ধতির সংস্কার করা উচিত। এদিকে খেয়াল রাখতে হবে, এই আন্দোলন যাতে অন্য খাতে কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ফাঁদে পা না বাড়ায়। 'কোটা বাতিল নয়, সংস্কার'- এ কথাটিও সরকারের কানে ঢুকিয়ে দেয়া উচিত। ছাত্রজনতার দাবি কোন সরকারই নাকোচ করতে পারেনি, পারবেও না- এই আশা রাখি। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কোনকালেই বাঙালি চুপ ছিল না, এবারো হয়তো থাকবে না। রাবার বুলেট, টিয়ার গ্যাস, জলকামান, কারাগার কোন কিছুই তাঁদের দমাতে পারেনি।
পরিশেষে, জহির রায়হানের ভাষা আন্দোলন নিয়ে রচিত 'আরেক ফাল্গুনে' উপন্যাসের চেতনা হঠাৎ মনে পড়ছে,
"ছেলেমেয়েদের জেলখানায় ঢোকানোর সময় নাম ডাকতে ডাকতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন ডেপুটি জেলার সাহেব। একসময়ে বিরক্তির স্বরে বললেন, উহ্, এত ছেলেকে জায়গা দেবো কোথায়। জেলখানা তো এমনিতেই ভর্তি হয়ে আছে।
ওর কথা শুনে একজন বললো,
'এতেই ঘাবড়ে গেলেন নাকি?
আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হবো'।"
কোটাপদ্ধতির যদি আশু সংস্কার নাহয়, তবে আসছে দিনগুলোতে যে আমরা দ্বিগুণ হবনা- তার নিশ্চ্যতা কী?
১০.০৪.১৮
#ReformQuotaBD
#Quota_reformation
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১০:৫৮