বাবা কখনই আমার উপর রাগ করেন না । সবেতেই সায় ।
'বাবা আজ না বল্টুদের গাছে গুলতি মেরেছি । জানো ঐ গুলতি না বল্টুর মাথায় লেগেছে । ভাগ্যিস কেউ দেখেনি'
বাবা কিচ্ছু বললেন না, একটু বকলেন না পর্যন্ত ! শুধু ঠোটের কোনে মুচকি একটু হাসলেন ।
আমার ধারণাটা অবশ্য ভুল, বল্টু ঠিকই টের পেয়েছে এইটা আমার কাজ । দৌড়ে আসার সময় হয়তো দেখেও থাকবে । বিকেলে বল্টুর মা এসে যাচ্ছেতাই বলে গেল, মুখের ভাষার সে কি ছিরি ।
চাচীআম্মা আমায় আচ্ছামত পেটালেন, তবুও বাবা কিচ্ছু বললেন না । এত গরমেও কাশ্মীরি শাল গায়ে বসে রইলেন । আমার অবশ্য তেমন একটা লাগেনি, বলতে গেলে লাগেনা আরকি । ভেবে নিই মা আমাকে কোলে নিয়ে ছোটবেলার মত আদর করছে, তাহলে মারের ম টাও কাছে আসতে পারে না ।
আজ প্রায় তিন বছর হচ্ছে আমরা চাচার বাড়িতে । আমরা বলতে আমি আর বাবা । মা সেই কবেই বিদেশে চলে গেছে । চাচীআম্মা মাঝে সাঝে ই নোংরা নোংরা কথা বলেন মাকে নিয়ে, 'এ কেমন মেয়েছেলেরে বাবা, ঘরে বাচ্চা ফেলে পরপুরুষের সাথে পালায় । ছ্যা ছ্যা ছ্যা, কি নোংরা কি নোংরা । এসব বেশ্যাপনা কি না করলেই চলত না । কি সুখের সংসার খানাই না ছিল । ঐ নোংরা মেয়েছেলে দিল তো সব শেষ করে, ছ্যা ছ্যা ।'
আমি ওসব কথায় কান দি না । বাবা বলেছে মা আমায় খুব ভালবাসত, তাই আমার ও উচিৎ তাকে ভালবাসা । তাই আমি ওসব শুনি না । মাঝে মাঝে অবশ্য দু একটা কথা কানে এলে এক আধটু কান্না পায়, তবে আমি সামলে নিই । চোখের কোন দুটো টেনে ধরি । চোখের জল চোখেই গড়িয়ে যায় আর কান্না পায় না । এটা অবশ্য আমি বাবার থেকে চুপিচুপি শিখেছি । বাবা যখন কাদত তখন এভাবে সামলে নিত । মজার না ?
বাবা সারাটাক্ষণ চেয়ারে বসে থাকেন । ঐ চেয়ারটেয় যে কি আছে সেটাই বুঝে উঠতে পারলাম না । পাশের বাড়ির সোবহান চাচা তো এই বসে থাকতে থাকতেই প্যারালাইজড্ হয়ে গেলেন । বাবাকে কত করে বললাম, 'ওঠ ওঠ, সোবাহান চাচাকে দেখলে না কেমন হয়ে গেছে ওরকম কিন্তু তোমার ও হবে, হ্যাঁ । উঠে পড়'
তার কি আর আমার কথা কানে যায়, ঐ বসেই রইলেন । মাঝে মাঝে বড্ড অভিমান হয়, 'আমি ছোট বলে কি আমার কথা শুনতে নেই !'
'দেখ ওরকম হলে কিন্তু বলতে পারবে না আমি সাবধান করি নি, হ্যাঁ'
বলেই ছুটে বল্টুর সাথে খেলতে যাই । বল্টুটা কেন জানি খুব ভালো । কাল চকলেট দিয়ে সব মিটমাট করে নিয়েছে, বাবা পচাঁ খুব পচাঁ ।
বাবা বই পড়তে খুব ভালবাসতেন । এইত এখন ও কোলের ওপর কবিতার বই রেখে বসে আছেন । আমিও পড়তে শিখে গেছি, সুর করে সংকল্প কবিতাখানা বেশ পড়তে পারি । বাংলা স্যার তো বলেই দিয়েছেন, সামনের অনুষ্ঠানে আমাকে দিয়ে কবিতা পড়াবেন । বাবার পুরোনো ট্রাংকে বেশ কটা কবিতার বই আছে । আমি মাঝে মাঝে চুপিচুপি বের করে পড়ি, বাবা দেখলে আর নিস্তার নেই ।
'হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের.........'
ধ্যাত্তোর এ কি লিখেছে, হাজার তো ঐ একের পরে তিনটে শূণ্য আর পৃথিবী নাহয় বুঝলাম, কিন্তু ঐ সিংহল টা আবার কোন প্রাণী হে ?
আমার ছোট্ট মাথায় এই কবিতা দিয়ে কোন কাজ নেই, এর থেকে আমার সংকল্প ঢের ভাল ।
আজ চাচীআম্মা আমায় খুব মেরেছে, পিঠে একদম কালসিটে দাগ পড়ে গিয়েছে । অপরাধ প্লেট ভেঙ্গে ফেলেছি । আমার অবশ্য তেমন লাগেনি, মহাষৌধ আছে না । এরপর বল্টুর সাথে খেলেছি । সন্ধ্যেয় সংকল্প কবিতা পাঁচ বার লিখেছি । এখন রাত আটটা বাজে, বাবা এখন ও সেই বসেই আছেন । কোলে কবিতার বই, গায়ে কাশ্মিরী শাল আর ঠোঁটটে মুঁচকি হাসি ।
আমার না হুট করে খুব কান্না পায় । অভিযোগ করতে ইচ্ছে হয়, 'জানো বাবা চাচীআম্মা আজ আমাকে খুব মেরেছে, বল্টু বলেছে পিঠে ইয়া মোটা মোটা দাগ উঠেছে । আমার না একটুও লাগেনি । মাকে নোংড়া মেয়েছেলে বলেছে তাও খারাপ লাগেনি । জানো বাবা তোমাকে খারাপ বলেছে, তোমাকেও মেরেছে । এই দেখ তোমার কাঁচগুলো কেমন ভেঙ্গে গিয়েছে । আমার খুব খারাপ লেগেছে । তোমার খুব লেগেছে না বাবা ? ও বাবা তোমার খুব লেগেছে না ? বাবা তুমি বেড়িয়ে এস না কাঁচের ওপাশ থেকে । তুমি শুধু একটাবার বেড়িয়ে এস, দেখ আমি চাচীআম্মার কি করি । ও বাবা বাবা'
আমি চোখের কোন টেনে ধরি, আজ আর চোখের জল বাঁধ মানে না । এক ফোঁটটা দু ফোঁটটা করে গড়িয়ে পড়ে ভাঙ্গা কাঁচের ফ্রেমের ওপর ।
সে জল মুচঁকি হাসতে থাকা লোকটার ছবির চোখের কোন বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, ধীরে খুব ধীরে ।