'এক'
ব্যাক্তিগতভাবে আমি রফিক ভাবীকে খুবই অপছন্দ করি। রফিক ভাবী মানে রফিক ভাইয়ের বউ। আমাদের পাশের ফ্লাটে থাকে। সমাজবিজ্ঞানের প্রফেসর সামাদ সাহেবের সাথে আমার বিশেষ খাতির আছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করার জন্যে আজ বাড়িতে ঢেকেছিলেন। যেয়ে বসতেই কুশলাদি বিনিময় না করেই একগাদা কাগজপত্র হাতে তুলে দিয়ে ঘোষনা দেবার মত করেই বললেন, "বুঝলেন জামান সাহেব, দুবছরের গবেষণা শেষে এই সিদ্ধান্ত নিলাম যে বাঙলার স্ত্রীরা তাদের স্বামীর দোষ, গুণে পরিণত করতে যে সময়টা ব্যায় করে তার আর্ধেক সময়ও নিজের দোষ ঢাকতে ব্যাবহার করে না"।
নিতুর সাথে বিয়ের দুবছর পেরিয়েছে, কোন দোষ করে পার পেয়েছি কি না তা আজও মনে করতে পারি না, সেই কথাটা ভেবে সামাদ সাহেবের সাথে তুমুল তর্ক করে মাত্র বাড়ি ফিরলাম।
দরজার মুখেই রফিক ভাবির সাথে দেখা। আমাকে দেখেই হইহই করে ছুটে আসলেন।
"এই যে জামান সাহেব, আপনি কি বলেন তো, বউকে কেউ সাদা শাড়ি উপহার দেয়?! এই দেখেন কালকে ও নিয়ে এসেছে, সুন্দর না?"
আমার মুখ কালো হয়ে গেল। আসাদ সাহেবের দু বছরের ফলাফল ব্যার্থ করে দিয়ে নিতু ঠিকই আমার দোষ ঢাকার বদলে প্রকাশ করে দিয়ে বসল। আমি কোনমতে মাথা ঝাঁকিয়ে ঘরে ঢুকলাম।
সোফায় বসে ভাবতে লাগলাম, কি যেন মনে পড়ছে পড়ছে করেও পড়ছে না।
ও হ্যা কিছুক্ষণ আগে রফিক ভাবির পরনের শাড়িটা আগেও দেখেছি তার গায়ে। কাল রাতে মৃদু কান্নার শব্দও আসছিলো তাদের ফ্লাট থেকে। এই কষ্টেরর কান্নাটাকে আনন্দের কান্না হিসেবে দেখানো আর খুব সম্ভবত রফিক সাহেবের এই বউ পেটানো স্বভাবটাকে লুকোনোর জন্যেই ভাবির ছলনার আশ্রয় নেয়া।
হায়রে মেয়েমানুষ, এখন দেখছি সামাদ সাহেবের গবেষণা পুরোপুরি বৃথা যায় নি।
'দুই'
আধোঘুমে মনে হল ভয়ানক ভুমিকম্প হয়ে যাচ্ছে, কে যেন এই এই বলে ডাকছে। ধরফর করে উঠলাম। নিতু গায়ে হাত দিয়ে থামাল। হাত ইশারায় ড্রইং রুম দেখিয়ে বলল কে যেন দরজায় নক করছে।
মেজাজটা খিচড়ে গেল। কোনমতে বিরক্তি চেপে দরজার দিকে এগোলাম।
রফিক ভাবি দারিয়ে, হাতে ট্রলি ব্যাগ। মুখের দিকে চোখ পড়তেই চমকে গেলাম। চোখের নিচে কালসিটে দাগ, ফুলে গেছে। গালে পাচ আঙুলের স্পষ্ট দাগ পড়ছে। পরনের শাড়িটা ছিড়ে গেছে বেশ ক জায়গায়। পাশে শিউরে ওঠার শব্দে চমকে উঠলাম। নিতু কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে টেরই পাই নি। নিতু ভাবিকে ভেতরে নিয়ে গেল। আমি সোফায় নিশ্চুপ বসে রইলাম।
কিছুক্ষণ পর নিতু এসে বুকে মাথা রেখে চুপচাপ বসে রইল। বুকের কাছটা পুরো ভিজে গেল ওর চোখের জলে।
চলে যাবার আগে অভিযোগ করে গেল, "জানো জানোয়ারটা কিভাবে মেরেছে, কিভাবে মেরেছে...."
'তিন'
রফিক সাহেব পায়ের ওপর পা তুলে সামনের সোফায় বসে আছেন। লোকটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে কালকে এই লোকটাই নিজের বউকে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলেছেন।
"জােনন রফিক সাহেব, আপনি পুরোই ভালোমানুষ "
রফিক সাহেব পুরো চমকে উঠলেন
" জ্বি কি বললেন? "
"না বলছিলাম যে , আপনি পুরো ভালমানুষ শুধু মাঝে মাঝে বউকে পেটান এই আর কি"
রফিক সাহেব একগাল হাসলেন
"না মানে হয়েছে কি ব্যাপারটা বউ তো আর প্রেমিকা নয় যে প্রেম ভালবাসা করব। বউকে রাখতে হয় নিজের পায়ের নিচে আর পায়ের নিচে রাখতে হলে মাইরের কোন বিকল্প আছে বলে আমি মনে করি না"
আমার আধমনী চড়ের চোটে রফিক সাহেব সোফার সাথে সেটে গেলেন। হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠেই ধমকে উঠলেন।
আমি শান'ত গলায় বসতে বললাম। রফিক সাহেব চুপসে গেল।
"কে বলে বিয়ের পর প্রেম ভালবাসা হয় না, ভালবাসতে জানতে হয়। আর এই জিনিসটা ভাবি খুব ভালো করেই জানেন। এই যে আপনি আসছেন, খবর পাওয়া মাত্রই ভাবি লেগে গেছেন সুটকেস গোছাতে, আপনার সাথে যাবেন তিনি। তার জায়গায় যদি আমি হতাম ফিরে যাওয়া তো দূরের কথা আপনাকে আজীবন জেলের ঘানি টানানোর ব্যাবস্থা করতাম। আমি জানি আপনার স্বভাব শুধরাবে না, আপনি আজকেও বাড়িতে গিয়ে বউ পেটাবেন। আর কালকে ভাবি আপনার দোষ ঢাকার জন্যে পুরোনো শাড়ি পড়ে আমাকে, নিতুকে এসে বলবে "জানেন ভাবি কাল ও কিনে এনেছে। সুন্দর না? আপনার বরকে দেখাতে নিয়ে এলাম, পরেরবার যাতে ভুল করে আর সাদা শাড়ি না কিনে নিয়ে আসে "।
রফিক সাহেব বাচ্চাদের মত ফোঁপাতে শুরু করে দিলেন। দরজার আড়াল থেকে ভাবি হইহই করে ছুটে আসলেন।
আমি আর ওখানে দাড়ালাম না। বেডরুম লাগোয়া বারান্দাটায় এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পর নিতু এসে বুকে মাথা রাখল।
সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিল, এখন ঝড়ে পরিণত হয়ে গেছে। আমি দুজনের জন্যে প্রার্থনা করলাম, নিতু বিরবির করে সায় দিল।