তানুবু মাটির মানুষ, মায়ার মানুষ । মাঝে মাঝে আমি ভাবি এত মায়া পায় কোত্থেকে তানুবু ! আল্লাহ্ আসমান জমিন সৃষ্টি করার সময় তার থেকে নাকি একভাগ দয়া-মায়া মানুষকে দিয়ে দিয়েছেন । আমার তো মনে হয় তার আরধেকই খরচ হয়ে গেছে তানুবুর পেছনে ।
সেদিন বড় মাঠটায় বিকেলে খেলতে গিয়ে বাবুর বলে বেধড়ক মারতে গিয়ে তানুবুর মাথা ফাটিয়ে ফেলেছিলাম । ভয়ে ভয়ে ছুটে গিয়ে দেখি তানুবু শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা চেপে বসে রয়েছে । ভাবলাম এই বুঝি খেলাম মার । তানুবু আমাকে অবাক করে দিয়ে বলটা হাতে ধড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বিশাল শোন, পরেরবার আরও জোরে মারিস । এই মারে হয় নাকি, তুই না বড় ক্রিকেটার হবি’ । আমি হু হু করে কেদে দিলাম । তানুবু মাথা ছেড়ে আমাকে নিয়ে পড়ল, ‘দেখ ভাই কাদলে হবে, ক্রিকেটাররা কিন্তু কাদে না’ ।
‘আমি ক্রিকেটার হব না, কক্ষনো না’ বলেই ছুটে চলে এলাম । তানুবু জানো আমি আজও ক্রিকেট বল হাতে ধরি নি । সে রাতে খুব কেদেছিলাম । একটা পুরনো ব্লেড নিয়ে হাতটা কেটে দিতে চেয়েছিলাম, পারিনি । ছোট ছিলাম কিনা, রক্তে বড় ভয় করত ।
মায়ের মার খেয়ে যখন আর আমার ঘরে জায়গা হত না, তখন ঠিক ঠিক তানুবু আমাকে খুজে নিত । বাড়ি থেকে চুপিচুপি দুধ-মুড়ি এনে খেতে দিত । রাতে চুপিচুপি ঘুমোবার জায়গা করে দিত । কাকাডাকা ভোঁরে আবার তুলে দিত, ‘বিশাল বাড়ি যা, চুপিচুপি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়বি । নাহলে কিন্তু চাচিমা আবার তোকে মারবে’ । আমি ঘুম ঘুম চোখে উঠে বাড়ি যেতাম । ভাগ্য ভালো থাকলে মা ঘুমিয়ে থাকত, আর না হলে আরও দু ঘা জুটত । আচ্ছা তানুবু, তুমি কি পুরো রাত জেগে থাকতে শুধু আমাকে তুলে দেয়ার জন্যে ? ‘জানো তানুবু আমি না তোমাকে চুপিচুপি মা ডাকতাম’ । আমার সৎ মা কি না, তাই তোমাকেই মা ডাকতাম । তুমি শুনতে পেতে ? ঐযে সেদিন তুমি আমায় হাতে তুলে ভাত খাইয়ে দিলে, আমার গলায় ভাত আটকে গেল । তা দেখে তোমার পানি নিয়ে কি হুড়োহুড়ি । জানো তানুবু সেসময় আমি তোমায় কতবার মনে মনে মা বলে ডেকেছি ?
মায়ের যখন অসুখ ধরা পড়ল, মা আমাকে ডেকে বলত, ‘শোন বিশাল, তোর যখনই আমাকে মনে পড়বে তানুর কাছে যাবি । পারবি তো ?’
আমি বেশ বললাম ‘পারব’ । তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল কেন মায়ের কথা মনে পরলে তানুবুর কাছে যাব কেন ? মাকে জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠল, ‘পাগল, আমি কি আর সবসময় তোর কাছে থাকতে পারব । আমি যখন থাকব না তখন তানুর কাছে যাবি । আমি যাওয়ার সময় তানুকে আমার সব মায়া ভালবাসা আদর দিয়ে যাব’ । আমি মাথা নাড়িয়েছিলাম । একবিন্দু বুঝিনি জানো । ‘আচ্ছা তানুবু মা তো চলে গেছে, তোমাকে কি সব মায়া ভালবাসা আদর দিয়ে গেছে ? তাই বুঝি তুমি আমায় এতটা ভালোবাসো?’
তোমার মনে আছে তানুবু বৃত্তি পরীক্ষার সময় নতুন মা আমায় কেমন একটা ঘরে আটকে রেখেছিল ? শুধু পরীক্ষা দিতে যাব তাই একজোড়া জুতো চেয়েছিলাম বলে । তুমি মাঝ রাতে এসে তালা খুলে চুপিচুপি নিয়ে এলে । সে রাতেই সোবহান চাচার দোকান খুলিয়ে একজোড়া চকচকে জুতো কিনে দিলে । মনে পড়ে তোমার ? সে আমি বৃত্তিখানা পাওয়াতে তুমি সারা গ্রাম খাওয়ালে, যেন আমি নই বৃত্তি পেয়েছ তুমি ।
দু টাকার আইসক্রিম দেখিয়ে দেখিয়ে খেয়ে বাবু যখন আমায় ঠোঙ্গা দেখাত তখন পাঁচ টাকার আইসক্রিম কিনে ওকে দেখিয়ে খাওয়ার অর্ডার তুমি দিতে । নিজে থেকে বাবুকে ধরে রেখে সেটা দেখাতেও । তাহলে আজ কেন চলে যাচ্ছ ? দেখ বাবু কিন্তু কাল ও আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে আইসক্রিম খাবে, তখন কে ওকে ধরবে ?
মটকা বাবু যখন আমাকে এসে বলল তুমি চলে যাচ্ছ, আমি বিশ্বাস করিনি জানো । বিশ্বাস করবই বা কেন, তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে পার ? তবে তুমি যখন এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বললে, তখন কত্ত কষ্ট হচ্ছিল জানো ? তোমার আঁচলে চোখ মুছে ছুটে চলে এসেছিলাম, যাতে তুমি দেখতে না পার । তুমি পেছন থেকে কত ডাকলে, আমি শুনেও শুনলামনা । কে বলেছে তোমাকে আমাকে ছেড়ে যেতে ?
তুমি যখন নীল গাড়িটায় করে যাচ্ছিলে, গাছের আড়ালে আমিও দৌড়োচ্ছিলাম । বাবু দেখে খুব হাসছিলও আর বলছিলো, ‘ওভাবে দৌড়োস না বিশাল তানুবু হাসবে’ । আমি থেমে গেছিলাম । ‘আচ্ছা তানুবু তুমি কি সত্যি হাসছিলে ? তুমি কি তোমার আদরের ছোট ভাইটার ওপর হাঁসতে পেরেছিলে ? সত্যি তানুবু ?’