১.
আমি গাড়ির ভেতর বসে কুলকুল করে ঘামছি। এসির দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ডায়াল পুরো ডানদিকে ঘোরানো, ফুল স্পিডে চলছে। অমল পাশে বসে মিটিমিটি হাসছে। অমলের হাসি দেখে মেজাজটা কেমন যেন বিগড়ে গেল।
“তুই এরকম ফ্যাক ফ্যাক করে হাসছিস কেন?” অমল আমার প্রশ্ন শুনে জোরেশোরে হাসতে শুরু করল। সামনের সিটে ছোট দুলাভাই বসে আছেন, অমলের হাসি শুনে জিঙ্গাসু দৃষ্টি নিয়ে পেছন ফিরে তাকালেন। “কি ব্যাপার অমল? এত হাসি কিসের? আমরাও একটু শুনি”।
“আর বলবেন না দুলাভাই, আপনার শালাবাবু তো ভয়ে কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে। দুই পা একবার নিজেদের মাঝে বারি খাচ্ছে একবার আমার পায়ের সাথে বারি খাচ্ছে। বিয়ে বাড়ি পৌছুতে পৌছুতে হাটু দুটো খুলে পড়ে কি না সন্দেহ”।
ছোট দুলাভাই হো হো করে হেসে ফেললেন। আমি রেগেমেগে কাই হয়ে গেলাম। পরক্ষনে ওদের দুজনের হাসি দেখে হেসেও ফেললাম। এরকম অনুভূতি তো আগে কখনো হয় নি আমার।
“ব্যাপার না শালাবাবু, হাটু খুলে গেলে খুলে যাক। আজ বউ না নিয়ে বাড়ি ফিরছি না। দরকার পড়ে তো তোমার হয়ে আমি কবুল বলে নিব। তাও বিয়ে হবে”।
অমল হাসতে হাসতে বলল, “ছোট আপা জানতে পারলে আপনার খবর আছে দুলাভাই। জহিরের তো এমনিতেই হাটু খুলে পড়ে যাচ্ছে, আর আপনার হাটু আপা খুলে হাতে ধড়িয়ে দেবে”।
দুলাভাই মাইক্রোবাস ফাটিয়ে হেসে ফেললেন। “তা যা বলেছও অমল, তোমার আপাকে বিশ্বাস নাই। শুনলে খবর আছে”।
আজ আমার বিয়ে। আঠাশ বসন্ত একা একা কাটাবার পর আজ থেকে দোকা হয়ে যাবার পালা। এত দিন একা থাকাটা আমার নিজের সিদ্ধান্ত ছিল। ভালবাসা ব্যাপারটা আমার কাছে সবথেকে পবিত্র। কারো কারো হয়ত বিয়ের আগে জুটে যায়, আমি বোধহয় একটু অন্যরকম। সব ভালবাসা জমিয়ে পৃথিবী সমান করে কাউকে দেবার অপেক্ষায় বসে আছি। আর আজ সেই অপেক্ষার অবসান ঘটবে।
ছোটবোনের হাতে করে একটা ছবি এলো। অফিস থেকে এসে দেখি ঘরে রমরমা অবস্থা। আমার বড় ছোট সব বোন সহ দুলাভাইরা বসে আছেন। আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসি খেলে গেল সবার মুখজুড়ে। মা অকারণে ব্যাস্ত হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বাবা উল্টো করে পেপার মুখে দিয়ে বসে রইলেন। আমি বুঝতে পারলাম না হঠাত কি হয়ে গেল সবার। নিজের ঘরে এসে শার্ট খুলছি, বড় আপা এসে শার্ট খুলে দিয়ে আমার বুকে মাথা রাখলো। আমি আপাকে জড়িয়ে ধরলাম। এই বোনটা আমাকে অকারণে বড্ড বেশি ভালোবাসে। আমি আপাকে আগ বাড়িয়ে কিছু জিঙ্গেস করে উঠতে পারলাম না। আমি একটু এরকমই, আপা আমার চুলগুলো ঘেটে দিয়ে চলে গেল। খাবার টেবিলে এলাহী অবস্থা, জামাইরা সব এসেছে। মা ইচ্ছেমতন সব রান্না করে ফেলেছে। এবাড়িতে জামাইরা সবসময় ছেলে হয়ে থেকেছে। বড় দুলাভাই বাবার পাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। মা প্লেটে খাবার নিয়ে আমাকে আর ছোট দুলাভাইকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন। ঘরে যাবার আগে ছোটবোন কানে কানে বললো, টেবিলে একটা খাম রাখা আছে দেখিস। আমি খামটা তুলে বেলকনিতে এসে বসলাম। একটা মেয়ের ছবি। আমি খানিকক্ষণ চেয়ে রইলাম, আচ্ছা এই ব্যাপার।
বড় আপা ধুপধাপ করে সামনে এসে বসল। হাতে চায়ের ট্রে, এক কাপ আমার দিকে বাড়িয়ে আরেক কাপ নিজে নিয়ে নিল। চোখেমুখে জিঙ্গাসা। আমি চুপ করে রইলাম। আপা চোখে মুখে জানতে চাইছে আমি কি ভাবছি, কিন্তু মুখ ফুটে বলে উঠতে পারছে না। একসময় কাপে চা শেষ হয়ে গেল, কাপটা টেবিলে রেখে আমি আপার মুখের দিকে তাকালাম। আপার কাপে চা পরে রয়েছে।
“তোমরা যা ভালো মনে করো করে ফেলো আপা, আমার কিছু বলার নেই”।
আপা পায়ে পায়ে আমার কাছে এসে হাসিমুখে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আপা জানতো আমি এমন কিছু বলব। আমি বরাবর এরকমই, শুধু মিলিয়ে নিল। আপার ওম শরীরে মেখে নিতে নিতে ভাবলাম আমি বোধহয় মায়ের থেকে বেশি আপার ছেলে।
আপা চলে যেতেই বসার ঘরে হৈ হট্টগোল শুরু হল। ছোট দুলাভাই ছুটে এসে আমাকে চেপে ধরল, বড় দুলাভাই পিঠ চাপড়ে চাপড়ে পুরো পিঠ ব্যাথা করে দিল। আমার নাভিশ্বাস ওঠার জোগার। ছাড়া পেয়ে সবাইকে বের করে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম, আঠাশ বছরে এই প্রথম। ছোট দুলাভাই দরজার ওপাশ থেকে বলে উঠলো, “কি শালাবাবু এখন থেকে প্রাক্টিস করতে শুরু করে দিলা নাকি? না মানে বিয়ের পর যখন দরজা দেয়াই লাগবে তো এখন থেকে দেয়া শুরু করে দিলা নাকি?”
দুলাভাইয়ের কথায় আমার গাল টাল গরম হয়ে গেল, আয়নায় নিজেকে লাল হতে দেখলাম। সে রাতে আমার ঘুম হল না। শুধু মনে হতে লাগল ঘুমোলেই ঐ চোখদুটো হারিয়ে যাবে। লজ্জার মাথা খেয়ে ছবিটা বুকে চেপে রেখে ঘুমোলাম। নীলা, আঠাশ বছরে এই প্রথম কেউ আমার ঘুম কেড়ে নিল।
পরদিন অফিসে দুটো শিটে ঝামেলা হলো। একশ বস্তা সিমেন্টের জায়গায় হাজার বস্তা সিমেন্ট হাজির। বস একটু বকাঝকা করে ফের কেবিনে নিয়ে জিঙ্গেস করলেন তোমার কি হয়েছে বলতো জহির, তোমারতো এমন ভুল হবার নয়। বাড়িতে কোন সমস্যা, তুমি কিন্তু আমায় নির্দিদ্ধায় বলতে পারো।
আমি বসকে কিছু বললাম না, কি ই বা বলবো। অমল পাশে বসে সারাদিন ফিক ফিক করে হাসলো। মাঝখানে কানে কানে বলে গেলো, “তুই তো শেষ জহির!”
আমি বেশ বুঝতে পারছি এসব বিয়ে পর্যন্ত চলবে, আমাকে লজ্জা, রাগ এসব নিয়ে এ কটা দিন কাটাতে হবে। অমল অফিস শেষে বাইকের পেছনে তুলে নিল। “
তোর যা অবস্থা বাড়ি না যেয়ে শশুরবাড়ি চলে যাস কি না সেই ভয়ে তোকে বাড়ি নিতে যাচ্ছি, চল”।
আমি অমলের কথায় হেসে ফেললাম। রাস্তায় বাইক থামিয়ে দুজনে টং দোকানে চা খেলাম। অমল বলল, “আমি বেশ বুঝতে পারছি তোর পছন্দ হয়েছে। তাও একবার মুখ ফুটে বল, শুনি শুনে কান স্বার্থক করি”।
চায়ে চুমুক দিয়ে অমলকে বললাম, “তোকে কে বলল?”
“তোর আগে তো আমি পছন্দ করেছি। মিতার সাথে আটঘাট না থাকলে তোকে দিতাম নাকি। এত দিনে তুই নীলাকে ভাবি ভাবি বলে ডাকতি”।
অমল আমাকে বাড়ি পৌছে দিয়ে চলে যেতে নিল। টেনে বাসায় নিলাম। সেদিন রাতটা অমল থেকে গেল। অমলের পাশে শুয়ে এপাশ ওপাশ করে রাতটুকু কাটালাম। নাস্তার টেবিলে অমল হাড়ি ভেঙ্গে দিল।
আন্টি বিয়ের দিন তারিখ একটু আগায় নেন, আপনার ছেলের বঊ ছাড়া রাতে ঘুম আসে না।
আব্বা হাসতে হাসতে পাঞ্জাবিতে চা ফেলে দিল। আমি চোখ মুখ গরম করে অমলের দিকে তাকালাম।
অমল ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, যা বাবা ভালো কথা বললেও দোষ। দেখছেন আন্টি ওর হেল্প করতে চাইলাম, আর আমার দিকে চোখ গরম করে তাকাচ্ছে। এই জন্য বাবা কারো ভালো করতে নেই। নাস্তা ফেলে অমলের দিকে ছুট লাগালাম। পিঠে দু ঘা দিয়ে তবে শান্তি।
নবনী, ছোটবোনটা পরদিন এসে বলল, ভাই তুই কি ভাবির সাথে কথা বলবি? আমি কি ভাবিকে বলে কোথাও দেখা করার ব্যবস্থা করব?
আমি না করে দিলাম, কেন দিলাম জানি না। আমার নিজেরই খুব দেখা করতে ইচ্ছে করছিলো। কেন যেন মনে হচ্ছিলো এখন দেখা করাটা ঠিক হবে না। বিয়ের প্রহর পর্যন্ত মেয়েটা অচেনা থাকুক। আমার পুরো একটা জীবন পড়ে থাকবে নীলাকে চিনে নেবার জন্য।
“তুই কিন্তু ফোনে কথা বলতে পারিস ভাই, আমার কাছে নাম্বার আছে দেবো?”
আমি নবনীকে বললাম, “তোর সাথে কথা হয়েছে?”
“হ্যা ভাই, জানিস ভাবির গলাটা কি সুইট। আমার তো ইচ্ছে করছিলো আরো অনেকক্ষন কথা বলি”।
আমি ইতস্তত করে জিঙ্গাসা করলাম, “আমার কথা কিছু জিঙ্গাসা করেছে”।
অবনী মিটিমিটি হেসে জিঙ্গাস করলো, “কেন ভাই, জিঙ্গাসা করলে কি হবে”।
আমি অবনীর কান চেপে ধরলাম, “আচ্ছা বাবা বলছি। ভাবি বলেছে, তুই কেমন?”
“তুই কি বললি?”
“আমি বললাম আমার ভাই সবথেকে বেস্ট”।
অবনী এর পর কথা হলে জিঙ্গাসা করবি, “বিয়েটা জোর করে করছে না তো?”
“সে তো তুই নিজেও বলতে পারিস”।
“আমি কথা বলতে চাইছি না, ছবি দেখেই আমি শেষ। কথা বললে আমার আর কিছু বাকি থাকবে না রে। বলেই জিভ কেটে ফেললাম”।
অবনী ছুটে যেতে যেতে বলল, “দাড়া ভাই আমি মাকে এক্ষুনি বলছি তার ছেলে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে”।
অবনীকে মানাতে বেশ বেগ পেতে হল। চকলেট, একমাস ওয়ালেটের উপর পুর্ণ অধিকার সহ কি কি যে আদায় করে নিয়ে গেল মেয়েটা!!!
আমি বরাবরই অন্তর্মুখী স্বভাবের। বিয়ে বাড়ির বরকে নিয়ে টানা টানিতে হাপিয়ে উঠলাম। অমল পাশে পাশে থাকায় কিছুটা কম ভোগান্তি হল। স্টেজে উঠিয়ে বসিয়ে দিল, সবাই আসছে, ছবি তুলছে। কেউ ভাবি কেউ ভাই, কেউ চাচা, খালা মামা অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আজকে পেয়ে নেই নীলাকে সব অভিযোগ সুদ সমেত আদায় করে নেব। সময় পেড়িয়ে যাচ্ছে, বড় দুলাভাই তাড়া লাগালেন শুরু করবার জন্য, কাজী আমরা নিয়ে এসেছিলাম। মেয়ের বাবা ভেতর বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। দুলাভাই বিরক্ত হয়ে আপাকে পাঠালেন ভেতরে। কেমন যেন সবকিছু ঝিমিয়ে গেল, আমার আশপাশটা হুট করে ফাকা হয়ে গেল। আমি অমলকে খুঁজলাম, কোন ফাঁকে যে ছেলেটা উঠে চলে গেছে টেরই পেলাম না।
২.
আমি এই পর্যন্ত বলে থামলাম। অনু জিঙ্গাসু দৃষ্টি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখগুলো বলছে থামলে কেন।
“এর পর আর কিছু নেই অনু। আমি ঘটনাটাকে খুব একটা ভালোভাবে নিতে পারিনি। আমার কাছে আমার আবেগগুলো খুব সত্য ছিল। এভাবে এক লহমায় মিথ্যে হয়ে যাওয়াটা সহ্য করতে পারিনি বেশ কদিন। বড় আপা তো বাড়িতে এসেই ঘোষনা দিয়ে বসল সাত দিনের মাথায় আমাকে বিয়ে দেবে। আমি সেই প্রথম বড় আপার মুখের ওপর না বলে দিলাম। অমল পুরো ব্যাপারটা নিতে পারেনি। নীলাকে খুজে বের করবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। পায় নি, ওরা হয়ত ওদের মতন সুখী হয়ে থেকেছে। অমল দিন দশেক পড়ে আমাকে জড়িয়ে কেদে ফেলেছিল। ওদের পেলে কি কি ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটাতো তাই বলে গেল সারা রাত। অপ্রকৃস্থের মতন বিহেব করল রাতটুকু। সকাল হলেই ওকে নিয়ে বেড়োলাম। শহর আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছিলো তখন। গরম গরম জিলাপি মুখ পুড়ে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ওকে সব ভুলে যেতে বললাম। তারপরের দুবছর একা থেকেছি। কেন থেকেছি জানি না, অপেক্ষা ছিলো না কোনকিছুর। তারপর হুট করে তুমি চলে এলে। খানিকটা আপার জোরে, খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে”।
“আমি নীলা আপাকে খুজে ধন্যবাদ দিয়ে আসবো”। অনু আমারে বুকে আঙুল ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বলল।
“কেন? ধন্যবাদ কেন?”
“বারে সেদিন বিয়ে থেকে না পালালে বুঝি আমি তোমাকে পেতাম”।
“আমাকে পেয়ে তুমি খুশি তো অনু?”
অনু আমার বুকে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বললো, “কেন তুমি বোঝনা?”
“তোমার মনে পড়ে বাসর রাতে আমি তোমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম?”
“হু! আমি তো তোমাকে দেখেই ভয়ে জড়োসড়ো, এত্তবড় একটা লোক। আমার পেটে প্রজাপতি উড়ছিলো, তার মাঝে আবার তোমার ক্ষমা। আমার তো আক্কেলগুড়ুম। বাবা আমার গলায় কোন পাগল ঝুলিয়ে দিল। আচ্ছা শোনো তুমি কিন্তু আমায় এখনো বলো নি কেন ক্ষমা চেয়েছো সেদিন?”
আমি একটু হাসলাম। “আমার খুব করে মনে হচ্ছিলো আমি তোমায় ঠকাচ্ছি। আমার তোমাকে দেখে হাত কাঁপছে না। দু পা দুপায়ের সাথে বাড়ি খাচ্ছে না, অমলের ভাষায় হাঁটু খুলে যাচ্ছে না। বিয়ের আগে তোমার চোখদুটো আমায় সারা রাত জাগিয়ে রাখলো না। আমার তো এসব তোমার বেলায় হবার কথা ছিলো। আমার তোমার কাছে কত অভিযোগ করার ছিলো। একটা অভিযোগ পর্যন্ত গড়ে উঠলো না। আমার এই উথাল পাতাল আবেগ গুলো ভুল সময়ে ভুল মানুষের জন্য খরচ হয়ে গেছে অনু। আমি শুধু এই একটি কারনে নীলাকে কখনো ক্ষমা করব না, কখনো না”। আমার গলা বুজে এলো
অনু কেঁদে কেঁদে আমার শার্ট ভিজিয়ে ফেললো। উথাল-পাথাল আদরে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল, তুমি শুধু আমার থেকো, আমার এই আবেগগুলো আমাদের দুজনের জন্যই যথেষ্ট, যথেষ্ট।