Click This Link
আওয়ামী লীগে 'বিদ্রোহ' আতঙ্ক
শরিয়ত খান
আগামী জাতীয় নির্বাচনে সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে ভয়ে আছে আওয়ামী লীগ। কারণ ইতোপূর্বে নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচনে লড়ার অভিজ্ঞতা তাদের সুখকর নয়। ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ছোট বড় প্রতিটি নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে মনোনীত বা সমর্থিত প্রার্থীর পরাজয় দলকে রীতিমত বিব্রত ও প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে। তাই ভবিষ্যতে যেন এ ধরনের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি সৃষ্টি না হয় সেজন্য এখন থেকেই কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে দলটির হাইকমান্ড। দলীয় সূত্রে জানা যায়, বর্তমান সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচন, সিটি করপোরেশন নির্বাচনসহ বিভিন্ন নির্বাচনে মনোনয়ন বা সমর্থন না পেয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন দলের অনেক বিদ্রোহী নেতা। তাদের কাছে আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থীকে পরাজয়ের স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় সংসদের টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী শহিদুল ইসলাম লেবু পরাজিত হয় দলের বিদ্রোহী প্রার্থী আমানুর রহমান খান রানার কাছে। তার আগে মনোনয়ন নিয়ে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে রানাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু রানা আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে সদর্পে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে এলে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণী মহলকে। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে এক ধরনের ভয় ঢুকে পড়েছে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে। তাই এবার আর তারা কোনোভাবেই কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে এবং সম্ভাব্য বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে ইতোমধ্যে সব জেলা কমিটিকে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বর্তমান সরকারের গত চার বছরে পৌরসভা নির্বাচন হয়েছে মোট ২৩৭টি। এসবের মধ্যে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জিতেছেন ৯০ জন আর বিএনপির প্রার্থী জিতেছেন ৯৫ জন। তিনটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সবগুলোতেই হেরেছে আওয়ামী লীগ। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে জয়লাভ করেন বিএনপির সমর্থিত প্রার্থী, কুমিল্লাতে বিএনপির বিদ্রোহী প্রার্থী আর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জিতেছেন। সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচন হয়েছে পাঁচটি। এতে আওয়ামী লীগ জিতেছে ৩টিতে আর বাকি ২ আসন জিতে নিয়েছে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। এছাড়া ৪ হাজার ২৯৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে ২ হাজার ১৯৭টিতেই হেরেছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা। অথচ তিন বছর আগের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট জিতেছিল ৩০০ আসনের ২৬২টি। এছাড়া ৪৭৫টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনেও চেয়ারম্যান পদে ৩০৪টিতে জয়ী হয় আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা। দৃশ্যত, আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পালা শুরু হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। ২০১০ সালের ১৭ জুন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হন বিএনপি সমর্থিত এম মঞ্জুর আলমের কাছে। ওই নির্বাচনে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে দল সমর্থন দিলেও স্থানীয় নেতারা বিরোধিতা করায় মহিউদ্দিন চৌধুরী হেরে যান ৯৫ হাজার ৫২৮ ভোটের ব্যবধানে। এরপর ২০১১ সালের ৩০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আবারো পরাজিত হয় আওয়ামী লীগ। কিন্তু এবার বিরোধী দল নয়, বিদ্রোহী প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয় দলটি। জনমত উপেক্ষা করে সেলিনা হায়াৎ আইভীর পরিবর্তে দল সমর্থন দেয় শামীম ওসমানকে। সেখানে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়ে আইভি রহমান এক লাখের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করেন শামিম ওসমানকে। গত ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও আওয়ামী লীগকে শোচনীয়ভাবে পরাজয় মানতে হয়েছে বিএনপি প্রার্থীর কাছে। প্রায় দ্বিগুণ ভোটে পরাজিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী অধ্যক্ষ আফজল খান। ওই নির্বাচনেও দলের বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন অ্যাডভোকেট আনিসুর রহমান মিঠু ও নূর উর রহমান মাহমুদ। ১৯ জানুয়ারি নরসিংদী পৌরসভা নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের বিপক্ষে ছিল আওয়ামী লীগ। নরসিংদী পৌরসভার জনপ্রিয় মেয়র লোকমান হোসেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হওয়ার পর ওই নির্বাচনে তার ভাই কামরুজ্জামান কামরুলকে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সমর্থন দিলেও তার বিরুদ্ধে নির্বাচন করেন নরসিংদী শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ উদ্দিন ভুঁইয়া। জেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতারই সমর্থন পাননি কামরুল। পাশাপাশি নরসিংদীর এক প্রভাবশালী মন্ত্রীও ছিলেন তার বিরুদ্ধে। কিন্তু কামরুলের কাছে বিপুল ভোটে পরাজিত হন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোন্তাজ। ৩০ সেপ্টেম্বর গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) আসনের উপনির্বাচনে জয় লাভ করেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সিমিন হোসেন রিমি। তবে সেখানেও রিমির বিরুদ্ধে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন তারই চাচা আফসার উদ্দিন। তিনি ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে এ আসনে জয়ী হয়ে মন্ত্রিত্ব পেয়েছিলেন। এবার দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। ফলে তিনি বিএনপি-জামায়াতের প্রার্থী বলে প্রচারণাও চালানো হয়। এত কিছুর পরও দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত উপেক্ষা করে নির্বাচনে ভুল প্রার্থী মনোনয়নের কারণেই ক্ষমতাসীনরা বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে পারছে না বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে অন্তঃকোন্দলের কারণেও বারবার বিদ্রোহী প্রার্থীর আবির্ভাব হচ্ছে বলে মনে করেন অনেকে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসছে, ক্ষমতাসীন দলে অন্তঃকোন্দল ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিটি আসনে আলাদা গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। স্থানীয় এমপি ও নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে নানামুখী কোন্দল। আবার এসব কোন্দল ছড়িয়ে পড়ছে দলের কর্মীদের মাঝেও। তৃণমূলের এসব কোন্দলের জন্য স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকেও দায়ী করছেন দলের সিনিয়র নেতারা। তারা বলছেন, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উদাসীনতায় প্রতিটি আসনে আওয়ামী লীগের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপিং সৃষ্টি হচ্ছে। এসব গ্রুপই তৈরি করছে বিচ্ছিন্ন ও বিদ্রোহী নেতা, যারা আলাদাভাবে জনসংযোগ চালাচ্ছে। জনসংযোগ চালাতে গিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে। নির্বাচনের সময় মনোনয়ন না দিলে হুট করেই বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে দাঁড়িয়ে দলকে সঙ্কটে ফেলছে। তাই এখনই এদের ব্যাপারে সতর্ক না হলে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন দলের সিনিয়র নেতারা। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন জানান, বড় দলগুলোতে এমন কিছু সমস্যা সৃষ্টি হতেই পারে। তবে বারবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় দলের মধ্যে কিছুটা বিব্রতকর ও হতাশাজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তাই দলের বিরুদ্ধে যারাই দাঁড়াবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয় সেজন্য ইতোমধ্যে দলের পক্ষ থেকে প্রতিটি জেলা কমিটিকে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়া সাংগঠনিকভাবে বেশকিছু পদক্ষেপও নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, বর্তমান সরকার দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। আর জাতীয় নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগের সফলতাকেই প্রাধান্য দেবে বলে তিনি মনে করেন। দলের মধ্যে কোনো সমস্যা নেই দাবি করে তিনি বলেন, দল ভালোভাবেই এগোচ্ছে। তারপরও যদি কোনো ছোটখাটো সমস্যা থেকে থাকে তা দ্রুত সমাধান করা হবে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



