লাশের সঙ্গে বসবাস ৪ দিন
শরিয়ত খান সাভার থেকে
'বিকট একটি শব্দ শুনলাম। এরপর কিছুই জানি না। চোখ মেলে যখন তাকালাম, তখন আমার দুটি পা আটকে আছে ভেঙে পড়া ভবনের চাপে। মাথা ওপরে তোলা যাচ্ছে না। মনে হয়, মাথার ওপর ছাদ ছিল। আমার ঠিক পাশে দুটি মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় ইটের মধ্যে গেঁথে আছে। আমরা একই ফ্লোরে কাজ করি। কিন্তু ওরা কারা, তা আমি বুঝতে পারিনি। তবে এটা বুঝতে পারলাম, ওরা মৃত। আস্তে আস্তে ডেকেছি_ 'ওই তোরা কেমন আছিস?' কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। কোনো সাড়া পেলাম না। তখনই বুঝলাম, ওরা নেই। লাশ দুটি হাত বাড়িয়ে রেখেছে আমার দিকে। চারদিকে অন্ধকার। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। ধুলার মধ্যে হালকা তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। রাত-কি দিন, বোঝার উপায় নেই। নিজেকেও মৃত মনে হলো। পানি খেতে খুব ইচ্ছা করছিল। মনে হচ্ছিল, পানির অভাবে আমিও কিছু সময়ের মধ্যে মারা যাব। ধীরে ধীরে আমি নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছি। শুধু আল্লাহকে ডেকেছি। যতো সময় যাচ্ছে, গরম ততো বাড়ছে। কি যে এক অনুভূতি বোঝাতে পারবো না। অনেকটা সময় মাথা নিছু করে পড়ে আছি। ব্যাথায় চিৎকারও করতে পারছি না। কবরের মধ্যে মানুষ কিভাবে থাকে, তা দিন : পৃষ্ঠা ২ কলাম ৩
রোববার এমনভাবেই সাভার সিএসএস'র বিছানায় শুয়ে কাতরাছিলেন আর ৪ দিন রানা প্লাজার ধ্বংস স্তূপের নিচে লাশের সঙ্গে বসবাস করার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন নাসরিন আক্তার। এ যেনো একজন জীবিত মানুষ কবরের মধ্য থেকে ফিরে এসে বর্ণনা করছেন। সত্যিই তাই! বাইরে হাজারো মানুষ। গত ৫ দিন ঠিক এভাবে উদ্ধার হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার। অথচ একটু পানির অভাবে ছটফট করছে তারা। বাইরে কতো আলো কিন্তু একটু আলোর অভাবে মৃত্যুকূপের ভয়াবহতা দেখছে তারা। নিথর দেহ তবুও জীবিত। কিন্তু বাঁচার নিশ্চয়তা নেই। যে মানুষগুলো এই মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে এসেছে, তারা জীবিত অবস্থায়ই কবরের ভয়াবহতা দেখে এসেছে এবং এখনো অনেক মানুষ এই কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবেলা করছেন।
নসারিন আক্তার বলেন, 'একদিকে পানি নেই। তার ওপর শুরু হয় গন্ধ। ব্যাথায় নিজের শরীর আছে কিনা, অনুভূতি নেই। মাথার মধ্যে কোনো চিন্তাও আনতে পারিনি। পাশে দুটি লাশ দেখে একবারও মনে হয়নি আমি লাশের সঙ্গে আছি। এটা বুঝতে আমার কষ্ট হয়নি যে, আমি কিছু সময়ের মধ্যে মারা যাব। নিশ্চিত মৃত্যুর সঙ্গে গলা জড়িয়ে লাশের সঙ্গে কাটিয়েছি। এরপর আর কিছু মনে নেই।'
রোববার ছিল সাভার ট্র্যাজেডির পঞ্চম দিন। কিন্তু গতকাল ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে বের করা হয়েছে জীবিত মানুষ। উদ্ধারকারীরা তাদের জীবন বাজি রেখে উদ্ধার করছেন এসব অসহায় শ্রমিকদের। অনেকেই উদ্ধার করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। পচা লাশের গন্ধে বমি করে দিচ্ছেন। তবুও হাল ছাড়েননি উদ্ধারকারীরা। উদ্ধারকারী প্রতিটি মানুষ এক-একজন দেবদূত হয়ে ভবনে চাপা পড়া মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। মানবতার কাজে নিজেকে উৎস্বর্গ করছেন। এমনি একজন ফায়ার সার্ভিসের ফরিদপুর জোনের কর্মী মিজানুর রহমান জানান, 'গত ৫ দিন ধরে উদ্ধার করেছি বহু মৃতদেহ। প্রথম দিন থেকে এ পর্যন্ত এখনো এক রকম বসবাস করছি লাশের সঙ্গে। উদ্ধার অভিযান চালাতে গিয়ে রানা প্লাজার ৮তলা থেকে সুড়ঙ্গ কেটে যান তিনতলা পর্যন্ত। কয়েক দিনে উদ্ধার করেন নিয়ে আসেন অনেক তাজা প্রাণ।' তিনি বলেন, 'অভিজ্ঞতার কথা কি বলবো। ভবনে ঢুকলে শুধু লাশ আর লাশ। কখনো মৃতদেহের রক্ত এবং গলিত মাংস গায়ের ওপর এসে পড়ছে। আবার লাশের ওপর দিয়ে অন্য স্থানে যেতে হচ্ছে। তবে তার ধরণা, ভবনের ভেতর এখনো অনেক জীবিত মানুষ রয়েছে।' শুধু মিজানুর রহমানই নয়, এ রকম আরো অনেক বীর এখনো অবস্থান করছেন সাভার এলাকায়। অচেনা-অজানা মানুষকে শুধুমাত্র মানবিকতার খাতিরে উদ্ধার করে চলছেন নিরলস।
ধসে যাওয়া বিশাল ভবনটির ইট-কংক্রিট-রডের ফাঁক গলে ভেতরে গিয়ে যারা আটকে পড়া মানুষদের বের করে আনার চেষ্টা করছেন, আমিনুল তাদের একজন। রোববার এই ধ্বংসস্তূপের নিচে একটি ছোট্ট খুপরিতে হঠাৎ করেই ৩ জন জীবিত মানুষের সন্ধান পান তিনি। তাদের একজন ৫ দিনের দুর্বিসহ যন্ত্রণার ভার সইতে না পেরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। বকছেন আবল-তাবল। জীবন বাঁচাতে সবার সঙ্গে বিয়ে বসতেও রাজি সে। তিনি আরো জানান, বহু মৃতদেহ এখনো বিধ্বস্ত ভবনটির বিভিন্ন তলায় ছড়িয়ে আছে। এসব লাশ পচে বিকৃত হয়ে গেছে।
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পিন্টু জানান, 'চারদিকে অন্ধকার। পাশে পড়ে আছে লাশ। নাকে আসছে দুর্গন্ধ। পানি নেই। তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়। শ্বাস নেয়ার মতো বাতাসও নেই। নিজের শার্ট খুলে নাকের সামনে ঘুরিয়েছি একটু অক্সিজেনের জন্য। এভাবে কেটেছে ৪ দিন। সারাক্ষণ সৃষ্টিকর্তাকে ডেকেছি। কবর থেকে বেরিয়ে ফের সূর্যের আলো দেখবো, তা কখনো ভাবিনি। শেষ পর্যন্ত সৃষ্টিকর্তা আমার ডাক শুনেছেন।'
গতকাল দুপুর ১টা ২৫ মিনিটে উদ্ধার করা হয় সবিতাকে। তিনি কাজ করতেন সপ্তম তলায় ফিনিসিং বিভাগে। তিনি বলেন, 'কিভাবে বেঁচে আছি বলতে পারব না। মনে হয়, আল্লাহ নিজের হাতে আমাকে বাঁচিয়েছেন। আমার আশপাশে কেউ জীবিত ছিল না। সবাই মারা গেছে। আমি একটি মেশিনের নিচে পড়েছিলাম ৫২ ঘণ্টা। চারদিকে লাশের গন্ধ। অক্সিজেন পাচ্ছিলাম না। ভেতর থেকে আমি বাঁচার জন্য আকুতি করছিলাম। বাইরে মানুষের কোলাহল শুনছিলাম। আমার আকুতি বোধহয় বাইরে আসছিল না। অন্ধকারের কারণে কিছুই দেখতে পারছিলাম না। নিঃশ্বাসও নিতে পারছিলাম না। আমার ওপর ছাদ, নিচে ফ্লোর। সামান্য ফাঁকা জায়গায় উপুড় হয়ে ছিলাম। ওপর থেকে ছাদ আরেকটু ধসে পড়লেই আমাকে আর খুঁজে পাওয়া যেত না। যে কোনো সময় ছাদ আমার ওপর ধসে পড়ার আশঙ্কা ছিল।' সবিতা বলেন, 'আমার গ্রামের বাড়ি রাজশাহীর মতিহার থানার বাদুরতলা গ্রামে। রাজমিস্ত্রি স্বামী শাহেদুল এখনো জানে না যে, আমি বেঁচে আছি।'
এমন অনেক উদ্ধারকর্মীর দাবি_এতো কিছু দেখেও রাষ্ট্রের কর্তা-ব্যক্তিরা নির্বোধের পরিচয় দিচ্ছেন, যা সত্যি লজ্জার বিষয়, অপমানের। তারা যদি একবার এই মৃত্যুকূপ দেখে আসতে পারতেন, তবে হয়তো বোধের উদয় হতো। ভালো থাকুক শ্রমজীবী মানুষ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



