somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জীবন বাঁচাতে জীবনবাজি

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ৯:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জীবন বাঁচাতে জীবনবাজি

শরিয়ত খান সাভার থেকে
ফায়ার সার্ভিসের ফরিদপুর জোনের কর্মী মিজানুর রহমান। চার দিনে উদ্ধার করেছেন হতভাগ্য বহু শ্রমিকের মৃতদেহ। শুক্রবার সারারাত উদ্ধার অভিযান চালিয়ে শনিবার সকাল ৮টায় রানা প্লাজার ৮ তলা থেকে সুড়ঙ্গ কেটে চলে যান ৩ তলা পর্যন্ত। উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তিন-তিনটি তাজা প্রাণ। একজন মহিলা আর দুইজন পুরুষ। এরপরই বেঁকে বসে তার শরীর। মিজানুর অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে ভর্তি করা হয় এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে শুয়েও 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাপার' হয়ে আসা এই বীর দৃপ্তকণ্ঠে বলে উঠেন_ 'একটু সুস্থ হলেই আবার ছুটে যাব রানা প্লাজায়। ওখানে আমি অনেককেই কথা দিয়েছি, তাদের ফিরিয়ে দেব স্বজনের হাতে। প্রয়োজনে নিজের জীবনকেও উৎসর্গ করব।'
শুধু মিজানুর রহমানই নয়, এ রকম আরো অনেক বীর এখন অবস্থান করছেন সাভারে। অচেনা-অজানা মানুষকে শুধু মানবিকতার খাতিরে উদ্ধার করে চলেছেন নিরলসভাবে।
শনিবার সকালে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে স্ট্রেচারে করে বের করে আনা হয় মো. শামসুদ্দিনকে। মিরপুরের এই সাধারণ লোকটি অসুস্থ হওয়ার পর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষেই হুঙ্কার করে বললেন, 'আমার হেলমেট কই? আমি আবার যামু।'
কথা বলে জানা গেল, বুধবার রানা প্লাজা ধসে পড়ার পরদিন বৃহস্পতিবার হেঁটে সাভার চলে আসেন তিনি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে টানা লড়াই করে চলেছেন যমদূতের সঙ্গে। হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে বারবার ঢুকেছেন যমপুরীতে। উদ্ধার করে এনেছেন একে একে ৭টি জীবিত প্রাণ।
প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আবার যুদ্ধে যেতে চাইলেন শামসুদ্দিন। কিন্তু চিকিৎসকরা বাধ সাধলেন। টানা ৪৮ ঘণ্টার বিরামহীন পরিশ্রমে শরীর বিধ্বস্ত। বাধা মানতে নারাজ এই বীর। আবার উদ্ধারে অংশ নিতে চান।
সামান্য সুস্থ হলে কথা হয় তার সঙ্গে। জানালেন, রানা প্লাজায় হাজার শ্রমিক আটকে আছেন। বৃহস্পতিবার এ খবর শুনার পর আর নিজেকে স্থির রাখতে পারেননি। চলে এলেন সাভার। উদ্ধারে যোগ দিতে চান। কিন্তু এখানেও বাধা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাকে ঢুকতে দিতে চান না। মাথায় একটি হেলমেট, কোমরে একটি গামছা- এই ছিল তার সম্বল। কাকুতি মিনতি করে ঢুকে পড়লেন ধসে পড়া ভবনে।
শামসুদ্দিন প্রথমে গেলেন ৯ তলার ছাদে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা তখন ছাদ ফুটো করে সবেমাত্র একটি সুড়ঙ্গ তৈরি করেছেন। পেশাদার উদ্ধারকারীরা সমস্ত নিরাপত্তামূলক পোশাক ও ব্যবস্থা থাকার পর নিচে নামতে ভয় পাচ্ছিলেন। কিন্তু নেমে গেলেন শামসুদ্দিন। ৪ তলা পর্যন্ত নামলেন। ফিরলেন তিনটি প্রাণ উদ্ধার করে।
প্রশিক্ষণ নেই, নিরাপত্তার জন্য কোনো পোশাকও নেই; তারপরও কেমন করে সম্ভব যমপুরীতে প্রবেশ করা? এ প্রশ্নের জবাবে শামসুদ্দিন বললেন, 'উদ্ধার করতে ট্রেনিং লাগে না; মন লাগে।' কোনোকিছুর আশায় নয়, শুধু মানবতার ডাকে সাড়া দিতে এসেছেন।
উদ্ধার করতে করতে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন। আটকে পড়া লাশের দমবন্ধ গন্ধে অচেতন হয়ে পড়েন শামসুদ্দিন। তাকে যখন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছিল তখন তার পাশে তিনটি বিছানায় আরো তিন বীরকে চিকিৎসা দেয়া হয়। একজনের নাম মো. সাদেক এবং অন্যজনের নাম মজনু মিয়া। চতুর্থজন অচেতন। তার নাম আর জানা গেল না।
মো. সাদেক জানালেন, তার বাড়ি রানা প্লাজার ঠিক পেছনেই। বুধবার সকাল থেকে আছেন উদ্ধার কাজে। ৭২ ঘণ্টায় ১ মিনিটের জন্যও অন্য কোথাও যাননি। ৩০ কদমের মধ্যে বাড়ি। তবু একটি বারের জন্যও বাড়ি যাননি। পানি, কলা-রুটি খেয়ে দিন পার করেছেন।
উঠে দাঁড়াবার শক্তি নেই তার। তবু মনের জোর ভাঙেনি। সাদেক স্পষ্ট গলায় বললেন, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি প্রাণ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তারা সরে যাবেন না। উদ্ধার কাজ বন্ধ না করার আকুতি জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমি নিজের চোখে দেখেছি অন্তত ২০০ মানুষ জীবিত আটকে আছেন। উদ্ধারকাজ বন্ধ হলে এরা সবাই মারা পড়বে। আপনারা পত্রিকায় লেখেন উদ্ধারকাজ যেন বন্ধ করা না হয়।'
জীবন বাঁচাতে জীবনবাজি
শনিবার দুপুর, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে বিধ্বস্ত ভবনের সামনে চিকিৎসকদের কাছে উপুড় হয়ে ছিলেন সুঠাম দেহের যুবক এজাজুদ্দিন (৩০)। তার গেঞ্জিতে তখনো লেগে আছে ইট-সুরকির ধুলা, যেন যুদ্ধাহত এক সৈনিক।
বিধ্বস্ত ভবনে উদ্ধারকাজ থেকে নেমে এসেছিলেন এজাজ; পা থেকে তখন রক্ত ঝরছিল। ২০-২৫ মিনিটের সেবায় সেরে উঠে ফের হাসিমুখে আবার নেমে পড়ার প্রত্যয়। এজাজ বলেন, 'তিন দিন হলো উদ্ধারকাজে নেমেছি। মাঝে মাঝে দেহের শক্তির কাছে হেরে যাই। ঝুঁকি আছে, ভেতরে বেশ দুর্গন্ধও। তারপরও একটি প্রাণের আশায় খুঁজে ফিরছি।' কাজ করার সময় পায়ে আঘাত পান এজাজ, কীসের আঘাত তা-ও বুঝতে পারেননি। যখন দেখলেন, তখন চিকিৎসার জন্য নিচে নেমে আসেন।
প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে কাজে পুনরায় নামার আগে কথা হয় এই যুবকের সঙ্গে। একটি বেসরকারি কোম্পানির পারসেজ ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত এজাজ জানালেন, দুর্গতদের সেবায় নিজ উদ্যোগেই কাজে নেমে পড়েছেন তিনি।
এজাজের মতো শত শত স্বেচ্ছাসেবী এখন রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে। বিভিন্ন ফাটল ধরে খুঁজছেন আটকে পড়াদের। জীবিত মানুষের সন্ধান মিললেই ছুটে যাচ্ছেন পানি, অক্সিজেন সিলিন্ডার আর লোহা-কংক্রিট কাটার যন্ত্র নিয়ে।
স্বজনসন্ধানী শত শত মানুষ এই স্বেচ্ছাসেবীদের দিকেই তাকিয়ে আছেন, তারা নেমে এলেই ঘিরে জানতে চাইছেন, নতুন কোনো খবর মিলেছে কি-না। বোন সীমাকে খুঁজতে এসে এক নারীকে ছুটে আসতে দেখা গেল স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে- 'ভাই, আমার বোনকে একটু উদ্ধার করে দাও। তোমাদের মুখ থেকে বললেই আমার বোনরে পাব। সে বাথরুমের পাশে একটি কক্ষে আটকা রয়েছে। আপনারা একটু মাইকে ঘোষণা দিতে বলেন, আপনারাই আমাদের ভরসা।'
এর কিছুক্ষণ পরই ঘোষণা এলো সীমাকে উদ্ধারের। বোনের খবর পেয়ে হাসির ঝলক দেখা গেল ওই নারীর মুখে; এরপর ছুটলেন সিএমএইচে, ওই হাসপাতালেই নেয়া হয়েছে সীমাকে।
মানিকগঞ্জের বাবুর্চি আহমদ হোসেন জানালেন, তার হাত ধরেই ৩০০ জন জীবিত ব্যক্তি উদ্ধার হয়েছেন। শুক্রবার সকাল থেকে একটানা কাজ করতে থাকা এই যুবক বলেন, চট্টগ্রামের হামজারবাগে ভবন ধসের সময়ও ছিলেন তিনি। ওই অভিজ্ঞতা নিয়েই এবারের উদ্ধার কাজে নেমেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভবনের নিচের বেজমেন্টে যাওয়ার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ছোট গর্ত দিয়ে গিয়ে তৃতীয় তলা থেকে ১২ জন জীবিত লোককে উদ্ধার করেন তিনি।
স্বেচ্ছাসেবী এসব যুবকের কাজের প্রশংসাও করলেন উদ্ধার অভিযানের নেতৃত্বে থাকা সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের অধিনায়ক মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী। তিনি বলেন, এ উদ্ধারকাজে প্রশিক্ষিত কমান্ডোরা যেমন আছেন, তেমনি সাধারণ মানুষের সাড়াও কম নয়। প্রশিক্ষিত এবং অপ্রশিক্ষিতদের সাহসের জোরেই এ অসম্ভব কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করা যাচ্ছে। আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলেও যেভাবে উদ্ধারকাজ চলছে, তাতে বাংলাদেশ বিশ্বে মডেল হয়ে থাকবে।
উদ্ধার অভিযান নিয়ে আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে স্বেচ্ছাসেবকদের কাজের কথা তেমন তুলে ধরা হয় না বলে অনুযোগ করলেন কয়েকজন। অবশ্য এটাকে যে গুরুত্ব দিচ্ছেন না, তা-ও জানালেন তারা। স্বজনের খোঁজে উদ্বিগ্নরা যে 'স্যালুট' দিচ্ছেন, সেটাকেই নিজেদের বড় প্রাপ্তি বলছেন তারা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×