১৯৭৩ সাল মে মাস
মারুফ গত ৩ দিন ধরে মনিপুরিপাড়ায় একটি বাসা থেকে একবেলা করে ভাতের মাড় খেয়ে আছে। ভিক্ষা হিসেবে ভাত চাওয়া প্রায় অপরাধের পর্যায়ে পরে এই সময়ে। ভিক্ষুকদের টিনের বাটি হাতে নিয়ে নিয়মিত বলতে শোনা যায়, 'মা ফ্যান থাকলে দেন।' 'ফ্যান' দেয়া হলে কখনো একটু নরম আবদার, 'মা একটু লবণ ছিটায় দেন'।
গত দুই সপ্তাহ মারুফকে ভিক্ষুকই বলা যায়। যদিও ৩ বছর আগেও তার এই অবস্থা ছিল না। তিন বছর আগে মারুফের বয়স ছিল দশ। ঢাকার অদূরে কামরাঙ্গিরচরে মা আর ষোল বছর বয়সী বড় ভাইকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল তাদের জীবন। বাবা চাকরী করত চট্টগ্রাম স্টিল মিলে।
এক বছর পরেই যুদ্ধ শুরু হয় দেশে। ভাই চলে যায় যুদ্ধে। দুমাস পরেই মা-কে স্থানীয় দেশপ্রেমিক রাজাকার সদস্যরা সালিশ করার জন্য মিলিটারি ক্যম্পে নিয়ে যায়। একসময় দেশ স্বাধীন হয়। বাবা, মা, ভাই কেউই আসে না।
আরও প্রায় দু বছর চলে যায়। ১৯৭৩ সাল মার্চ মাস। সারা দেশে দুর্ভিক্ষ।
মারুফের মামা একদিন মারুফকে আড়ালে ডেকে জানায় যে তার পরিচিত একজন মারুফের বড় ভাইকে ঢাকায় দেখেছে। সে একটি দোকানে চাকরী করে। একটি ঠিকানাও দেয়। এবং আনুপ্রানিত(!) করে ঢাকায় গিয়ে ভাইকে খুঁজে বের করতে।
মারুফ পরদিনই এক কাপড়ে ঢাকায় চলে আসে।
যাই হোক।
এই মুহূর্তের বাস্তবতা হল মারুফ আজ আর হাঁটতে পারছে না। তার শীর্ণ হাত দুটি মাটিকে ঠেলে বুক একটু উঁচু করে। হাঁটু গেড়ে হামা দেবার মত করে কিছুক্ষণ ধাতস্ত হবার চেষ্টা করে। উঠতে কি আর পারবেনা? তারতো যে-কোন ভাবেই যেতে হবে আর চারটা বাড়ি দুরে। লাল টিনের দরজার বাড়ির খ্রিস্টান সেই মহিলা তো অবশ্যই তাকে ভাতের মাড় দেবে।
কিন্তু কেন আজ আর জোর পাচ্ছেনা সে শরীরে? এরকম কেন হচ্ছে? কেন প্রতিটি নড়াচড়াতেই সাদা হয়ে আসছে সবকিছু!
মারুফ হামা দেয়া শুরু করল। তার মস্তিষ্কের নিউরন কাজ করছে ধীর গতিতে। নতুবা সে বুঝত যে গত ৪০ মিনেটে সে অতিক্রম করেছে ৬ গজ দূরত্ব।
ঘুমিয়ে গেল মারুফ। রাস্তার পাশেই একটি পাচিল ঘেঁষে।
সন্ধ্যা।
মারুফের ঘুম ভাঙ্গল।
তার যেতেই হবে আর মাত্র দুইটা বাসা দুরে। সে খাবে। সে বাঁচবে।
হঠাৎ ঘাড়ে একটি হাত। কানে পরিচিত কণ্ঠ।
তুই এখানে? তোর এই অবস্থা কেন?
ভাইজান! ভাইজান? তুমি?
মারুফ রীতিমত বুঝল যে সে বেচে গেল এ যাত্রা। তার শীর্ণ পেশিবিহীন হাতের শক্তি নেই ভাইকে জড়িয়ে ধরার।
এরপরের গল্প ঘোরের মধ্যে।
ভাইজান তাকে কোলে করে নিয়ে গেল একটি বাড়িতে।
মা! বাড়িতে মা!
মা জড়িয়ে ধরল মারুফকে।
এতই আনন্দ কেন!!
মা তড়িঘড়ি চামচে করে দুধ খাইয়ে দিতে লাগলেন।
'আহঃ'- আবার মারুফ ভাবল, বেঁচে গেলাম এইবার।
।
।
।
রিনা গমেজ সাধারণত বাসা থেকে একা বের হয় না। আজ কি কারনে যেন বের হয়েছিল।
দু বাসা পেরতেই দেখল সেই বালকটার নিথর দেহ, যাকে সে গত তিন দিন দুপুরে ভাতের মাড় দিয়েছিল।
রিনা তার অপুষ্ট হাত দিয়ে শাড়ির আঁচলের একখণ্ড ছিঁড়ে বালকটির মুখমণ্ডল ঢেকে দিল।