somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একটি ভিন্নরকম আড্ডার গল্পো

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১১ সকাল ১০:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শওগাত আলী সাগর
সাদ কামালী লিখেন ভালো। শুধু ’ভালো’ বললে আসলে তাঁর প্রতি অবিচারই করা হয়। তাঁর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট আর ক্ষুরধার লেখনি ইতিমধ্যে বাংলা কথা সাহিত্যে অত্যন্ত শক্তিশালী একটা অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি বলেন্ও ভালো। না , গদবাধা ব্ক্তৃতাবাজি নয়,বাংলা সাহিত্য আর বিশ্বসাহিত্যের মুনিঋষিদের বক্তব্য আর কর্ম থেকে উদাহরন টেনে টেনে সারগর্ভ আলোচনায় আসর জমিয়ে রাখার অসাধারন একটা শক্তি তাঁর রয়েছে। অনানুষ্ঠানিক স্রেফ বৈঠকি আড্ডায়্ও তার এই সক্ষমতায় একট্ওু ভাটা পড়ে না।
প্রাবন্ধিক কথাসাহিত্যিক সাদ কামালী যখন কবিতার সূত্র ধরে চিত্রকর্ম নিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন আমি খানিকটা বিস্মিতই বোধ করছিলাম। বলে রাখি,মঞ্চ বানিয়ে, মাইক লাগিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক সমাবেশ নয়,আয়োজনটা ছিলো নিতান্তই ঘরোয়া,ইনফরমাল আলোচনা। বিষয়বস্তু অবশ্যই সাহিত্য। আমি নিজে সাহিত্যের দূর্বল পাঠক,আমার বিচরন সংবাদপত্রে, যার নাসারন্ধ্র সর্বদাই ‘নিউজের’ গন্ধ খুঁজে বেড়ায়। সাহিত্যের আড্ডায় সবসময়ই খানিকটা অপ্রস্তুত বোধ করতে হয় আমাকে। কিন্তু সাদ কামালীর সূচনা বক্তব্য আমাকে খানিকটা সাহস জোগায়- একেবারে বেমানান নই আমি এই আসরে।
ভূমিকা শেষ না হতেই ফ্লোরে আসন গেড়ে আয়েশ করা মানুষগুলোর চোখ ছুটে যায় দেয়ালের দিকে। সেখানে ঝুলে আছে বেশ কিছু চিত্রকর্ম। সাদ কামালী জানিয়ে দেন- এই ছবিগুলো ওয়াহিদ আজগরের আঁকা। ওয়াহিদ আজগর সাহিত্যের লোক, তিনি কবিতা লিখেন।কিন্তু এই আড্ডায় তিনি হাজির হয়েছেন নিজের আঁকা চিত্রকর্ম নিয়ে। দৃষ্টিতে , মনে শিল্পীর রঙ তুলির খেলার সৌন্দর্যবোধ নিয়ে আমরা প্রবেশ করি মূল আড্ডায়।
ইকবাল করিম হাসনু কে দিয়েই শুরু হয় আড্ডা। প্রাবন্ধিক ইকবাল করিম হাসনু টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা পড়ান। কিন্তু সাহিত্য কিংবা সংস্কৃতিজগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পৃক্ততার কারনে তাঁর স্মৃতির ভা-ারে সংরক্ষিত আছে অনেক মূলবান সম্পদ। বাংলাদেশের নতুনধারার চলচ্চিত্র নির্মতা,সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো তারেক মাসুদকে ঘিরে রয়েছে এমনি কিছু অমূল্য স্মৃতি। সেই স্মৃতি ভা-ার থেকেই ছড়িয়ে দেন তিনি তারেক মাসুদের জীবনের অসাধারন কিছু তথ্য। উঠে আসে তারেক মাসুদের চলচ্চিত্রের আরেক অপরিহার্য মানুষ মিশুক মুনীরের প্রসঙ্গ্ও। এক সঙ্গে সিনেমা বানাতে বানাতে জুটি হয়ে য্ওায়া দুজন গুনী মানুষ জুটি বেধে মৃত্যুক্ওে আলিঙ্গন করেন। ইকবাল করিম হাসনুর তথ্যনির্ভর এই স্মৃতিকথা শেষ হতেই শুরু হয় তা নিয়ে আলোচনা। সেই আলোচনা বিস্তৃত হয়ে যায় বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস আর কাহিনী বিন্যাসের রুপান্তর,সমস্যা-সম্ভাবনায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদেই কেবল নয়,অসাধরন মনন আর বোধশক্তির কারনেই ইকবাল করিম হাসনু তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনীরের স্মৃতি তর্পন করতে গিয়ে তুলে আনেন বাংলা চলচ্চিত্রকেই। আর সাদ কামালী,্ওয়াহিদ আজগর,শিবলি সাদিক, মাসুদ খান নিজেদের বিশ্লেষন সংযোজন করে সেটিকে করে তুলেন আরো প্রাণবন্ত। বিশেষ করে সাদ কামালী জ্ঞানগর্ভ আলোচনা তাকে ভিন্ন মাত্রা দেয়।
তরুন কবি আহমেদ মেহমুদের কবিতা নিয়ে মতামত প্রকাশকে ঘিরে তো রীতিমতো একটা কবিতার ক্লাশের চরিত্র পেয়ে যায় আড্ডাটা। আহমেদ মেহমুদ নিভৃতচারী কবি। সাদা কাগজের বুক চিড়ে ভাবের আল্পনা আঁকল্ওে তিনি সেগুলোকে আড়ালে রাখতেই বেশি পছন্দ করেন।কিন্তু এই আড্ডায় এসে তাঁর আর আড়ালে থাকার উপায় ছিলো না। তিনি তুলে ধরেন তাঁর একগুচ্ছ কবিতা। কবি অবশ্য শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, কথা সাহিত্যিক সাদ কামালীর লেখা ‘লীলাবতী’ উপন্যাসটি পড়েই তিনি ৭টির মতো কবিতা লিখে ফেলেছেন। সেই কবিতাগুল্ইো তিনি পড়ে শুনাতে চান। নিভৃতচারী কবি কবিতা পাঠেও নিম্নকণ্ঠ। কিন্তু দেশের খ্যাতিমান কবি মাসুদ খান ,’আমার তাৎক্ষনিক মন্তব্য’ বলেও ‘নিখুঁত অক্ষরবৃত্ত ছন্দে লেখা কবিতাগুলোর ধ্বনিগত অনুপ্রাস,ছন্দ অলংকার আর অবাধ অনুসঙ্গের ব্যবহার মুহুর্তেই মনকে ছুঁয়ে দেয়’ বলে উল্লেখ করেন ।’ দীর্ঘ পাঠে ক্লান্তি আসতে পারে বল্ওে তিনি সতর্ক করে দেন। মাসুদ খানের আলোচনার সূত্র ধরে শুরু হয়ে যায় কবিতার ব্যাকরন,ধ্বনি আর ছন্দ নিয়ে তাত্বিক আলোচনা।
সেই আলোচনার রেশ না ফুরোতেই কবিতা নিয়ে হাজির হন কবি নাঈম হাসান। নাঈম হাসান এর বিচরন কবিতা এবং প্রবন্ধ- এই দুই শাখাতেই। ‘নিরন্তর’ নামে এক সময় সাহিত্য পত্রিকা বের করতেন তিনি। পত্রিকার সম্পাদনায় লেখা বাছাইয়ে অতিমাত্রায় পারফেকশনিষ্ট কবি নাঈম হাসান কবিতার ক্ষেত্র্ওে পারফেকশনিষ্ট হতে সচেষ্ট। আড্ডার মতঅনুসারে, ‘সুনির্বাচিত এবং ব্যাকারণঋদ্ধ শব্দের ব্যবহার,রুচিশীলতা আর শব্দের মধ্য দিয়ে বহুমাত্রিকতা হাজির করার প্রচেষ্টা’ রয়েছে তার কবিতায়। আর সেজন্যেই বোধ হয় কবিকণ্ঠে শুনা কবিতাগুলো ‘ইন্দ্রিয়কে ছুঁয়ে য্ওায়া’ আনন্দ দিতে পেরেছে সবাইকে।
কবি শিবলী সাদিকের প্রিয় বিষয় প্রকৃতি। সাহিত্যের আড্ডায় তিনি যেন প্রকৃতিকে নিয়েই হাজির হয়ে যান। শুরুতেই তিনি জানিয়ে দেন,বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে প্রায় পাঁচ মাসের মতো সময় তিনি অনেকটা জলাবদ্ধ সময় কাটাতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই অভিজ্ঞতাকেই তিনি বন্দী করেছেন তাঁর কবিতায়।
কবিতা নিয়ে ছেদ ব্যবচ্ছেদ আর তুমুল পর্যালোচনাকে ভিন্নদিকে নিয়ে যেতে গদ্য নিয়ে হাজির হন কথাশিল্পী সালমা বাণী। তিনি পড়ে শুনান তাঁর প্রকাশের অপেক্ষায় থাকা ‘ক্ষরণ জাতক’ উপন্যাসের অংশ বিশেষ। মুক্তিযুদ্ধের সময় জন্ম নেওয়া এক যুদ্ধশিশু যে কীনা তার জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে বের করতে কানাডা থেকে দেশে ফিরে যায় - তার কাহিনী নিয়ে আবর্তিত হয়েছে এই উপন্যাসের শরীর। ইতিমধ্যে সালমা বাণীর বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এই লেখাটিও প্রকাশিত হয়েছে ঢাকার একটি ঈদ সংখ্যায়। গল্পের চরিত্রের সঙ্গে অনেকটা একাত্ম হয়ে গল্প থেকে পাঠ করে সালমা বাণী আড্ডার পুরো মনোযোগটাই আকড়ে ধরতে সমর্থ হন। কিন্তু পাঠপরবর্তী আলোচনায় প্রশংসার পাশাপাশি কাহিনী বিনির্মানের ত্রুটি বা দূর্বলতাগুলো নিষ্ঠুরভাবে তুলে ধরত্ওে দ্বিধা করেন নি আড্ডার মানুষগুলো।
সবশেষে কবিতা নিয়ে হাজির হন কবি মাসুদ খান। “বাংলা ভাষার এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের একজন মাসুদ খান। নিজের ও তাঁর অনুসারীদের জন্য মৃদু ও বুদ্ধিদীপ্ত একটি কবিতার ধারা নির্মাণ করে নিয়েছেন তিনি। বাংলা কবিতায় এখন কিছু শব্দ ও শব্দবন্ধের ব্যবহার একান্তই মাসুদ খানের পরিচয়ে পরিচিত হয়ে গেছে।“- এভাবেই মাসুদ খানকে উপস্থাপন করা হয় ঢাকার মূলধারার মিডিয়ায়। মাসুদ খান যখন কবিতা পড়তে শুরু করেন, তখন মনে হতে থাকে যেন কবিতার প্রতিটি পঙতিমালার বিন্দু বিন্দু আবেগ তার কণ্ঠ থেকে ঝড়ে পড়ছে।
সাদ কামালী জানিয়েছিলেন এই ধরনের সাহিত্য আড্ডা তারা মাঝে মধ্যেই করে থাকেন। আমার অবশ্য এই প্রথম তাদের কোনো আয়োজনে অংশ নেওয়া। টরন্টোতে বসবাস করল্ওে বাংলাদেশের মূল সাহিত্যজগতে যথেষ্ট শক্ত অবস্থান করে ন্ওেয়া লেখক কবি আর তরুন কবির সংমিশ্রিত পাঠ আর তা নিয়ে আলোচনা- আড্ডার এই বৈশিষ্ট্যটাই আমাকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। কেবল পিঠ চাপড়ে দ্ওেয়া নয়, অপারেশ থিয়েটারে শুইয়ে দিয়ে একটু একটু করে ব্যবচ্ছেদ করা আর সেই ব্যবচ্ছেদকে সহাস্যে মেনে নিয়ে আলোচনায় অংশ ন্ওেয়ার মধ্য দিয়ে এই লেখক কবিরা আড্ডাটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেন। বিকেলকে পেছনে ফেলে সন্ধ্যা ক্রমশ পূর্ণযৌবনা রাত্রিতে পরিণত হল্ওে যেন সেই আড্ডায় ছেদ পড়ে না। বরং ঘরোয়া আড্ডাটি আর নিতান্ত ঘরোয় না থেকে একটি সাহিত্য আয়োজনে চরিত্র পেয়ে যায়। আর বাবলু’র দরাজ গলার গান সেই আয়োজনকে দেয় ভিন্নমাত্রা।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

লিখেছেন নতুন নকিব, ০৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৫৬

...এবং উচ্চতায় তুমি কখনই পর্বত প্রমাণ হতে পারবে না

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ অন্তর্জাল।

ছোটবেলায় মুরব্বিদের মুখে শোনা গুরুত্বপূর্ণ অনেক ছড়া কবিতার মত নিচের এই লাইন দুইটাকে আজও অনেক প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×