
ব্রিটিশ পার্লামেন্ট নির্বাচনে বাংলাদেশী অধ্যুষিত বেথনাল গ্রিন ও বো আসনের প্রার্থীরা বাংলাদেশী স্টাইলে এখন নির্বাচনী প্রচার চালাচ্ছেন। মিটিং-মিছিল আর টিভি ডিবেটে মুখর সমগ্র কমিউনিটি। ৬ মে পার্লামেন্ট নির্বাচনের দিনটি যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই প্রচারণা জমজমাট হয়ে উঠছে। বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে প্রায় প্রতিরাতেই প্রার্থীদের নিয়ে চলছে টকশো; কমিউনিটির বিভিন্ন সংগঠন মূল প্রার্থীদের নিয়ে আয়োজন করছে বিতর্ক ও পরিচিতি অনুষ্ঠান। প্রতি জুমা বার ও প্রত্যেক নামাজ শেষে মসজিদের ভেতর ও বাইরে চলছে ভোট ও দোয়া প্রার্থনা। বাংলাদেশী স্টাইলে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়েও আমার ভাই-তোমার ভাই অমুক ভাই—এরকম স্লোগান দিয়ে ভোট চাচ্ছেন প্রার্থীরা। পুরো বেথনাল গ্রিন ও বো আসনটি যেন এক মিনি বাংলাদেশ।
লেবারদলীয় প্রার্থী রোশনারা আলীর পক্ষে প্রচারণার জন্য বাংলাদেশ থেকে তার ছবি অংকিত রিকশা আমদানি করেছেন। তিনি বলেছেন, গত ৩ বছর যাবত্ ভোটারদের ঘরে ঘরে যাচ্ছি। আশা করি ভোটাররা আমার এ আবেদনকে খাটো করে দেখবেন না। রেসপেক্ট প্রার্থী আবজল মিয়া এ প্রতিনিধিকে বলেন, বাংলাদেশী ভোটারদের কাছে প্রচারণার একটি সুবিধা হলো এই প্রার্থী আপনাকে পছন্দ করলে তিনি আপনার জন্য আরও কয়েকজনকে অনুরোধ করবেন। অবাঙালি ভোটারদের ক্ষেত্রে সেধরনের সহানুভূতি অনেক সময় আশা করা যায় না। যদিও আমার সব ধরনের ভোটার আছে। আমি নবীন-প্রবীণ নির্বিশেষে সবার কাছেই ভোট প্রার্থনা করছি।
লেবার প্রার্থী রোশনারা আলীর আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু হয় গত সপ্তাহে। ওইদিন বিকাল ৫টায় এনার্জি অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ সেক্রেটারি মিলিব্যান্ড এমপি ব্রিকলেনে আসেন। এর আগেই বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা রোশনারার ছবি পেইন্ট করা বিশেষ রিকশাও এসে পৌঁছে যায় ব্রিকলেনের ক্যাফে বাংলা রেস্টুরেন্টের সামনে। মিলিব্যান্ড সেখানে এসেই সরাসরি রিকশাটির চালকের আসনে বসেন। আর রোশনারা এক শ্বেতাঙ্গ লেবার কর্মীকে নিয়ে বসেন প্যাসেঞ্জার সিটে। করতালি আর হাস্যরসের পর মিলিব্যান্ডকে নিয়ে রোশনারা বাংলা টাউনের ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে পথচারী এবং রেস্টুরেন্ট মালিক ও কর্মরতদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এসময় তাদের সঙ্গে ছিলেন সাবেক লিডার কাউন্সিলর হেলাল আব্বাস, সাবেক কাউন্সিলর গোলাম মর্তুজা, সাবেক কাউন্সিলর হেলাল রহমান, কাউন্সিলর আয়ুব করম আলীসহ লেবার পার্টির অন্যান্য কর্মী। তারা মিলিব্যান্ড এবং রোশনারাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এর আগে অবশ্য ক্যাফে বাংলা রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড মিলিব্যান্ড এবং রোশনারা বাংলা মিডিয়ার সাংবাদিকদের উদ্দেশে বক্তব্য রাখেন। মিলিব্যান্ড সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাঙালি কমিউনিটির জন্য একজন এমপির প্রয়োজন রয়েছে। আগামী ৬ মে রোশনারা বিজয়ী হলে এর সমাধান হবে। বাঙালি কমিউনিটি তথা এ এলাকার নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা তার রয়েছে উল্লেখ করে তিনি রোশনারাকে ইস্ট অ্যান্ডের কন্যা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বেকারত্ব দূর করা এবং অর্থনৈতিক সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নিতে হলে লেবার পার্টি ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এজন্য আগামী নির্বাচনে লেবার পার্টিকে ভোট দিতে তিনি সবার প্রতি অনুরোধ জানান। এরপর আয়োজিত জনসভায় রোশনারা আলী হাজির করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের শাশুড়ি শিক্ষাবিদ পলিন ম্যাকলেকে। তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে বক্তৃতা দিয়ে বলেন, বেথনাল গ্রিন ও বো থেকে প্রার্থী হওয়া রোশনারা একজন যোগ্য প্রার্থী। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দক্ষতার সঙ্গে কমিউনিটির সবার জন্য কাজ করতে পারবেন। তিনি রোশনারাকে একজন নিষ্ঠাবান চিন্তাবিদ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, একজন যোগ্য বাঙালি নির্বাচিত করতে সবাইকে ভোটদানে এগিয়ে আসা উচিত। পলিন ১২ বছর আগে বাংলাদেশে তিন বছর অবস্থানকালের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, কলেরা হাসপাতাল ও ব্র্যাকের হয়ে কাজ করার সুবাদে বাংলা ও বাংলাদেশকে তিনি জেনেছেন। পলিন বলেন, আমার দীর্ঘদিনের শিক্ষকতা পেশার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, রোশনারা স্থানীয় জনগণের শিক্ষার ক্ষেত্রে একটা পজিটিভ ইমেজ আনতে যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
সর্বশেষ শনিবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি প্রকাশ্য জনসভায় লেবারদলীয় প্রার্থীকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সমর্থন করে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। অনেকে মন্তব্য করছেন—বিদেশি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ব্রিটেনের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে কোনো দলীয় সমর্থন কূটনৈতিক নিয়ম বহির্ভূত আচরণ। তাছাড়া মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় আরেকজন বাঙালি প্রার্থী থাকা সত্ত্বেও এক প্রার্থীর সমালোচনা ও আরেক প্রার্থীকে প্রকাশ্যে সমর্থন করায় অন্যান্য প্রার্থীও ক্ষুব্ধ হন। শনিবার বিকালে পূর্ব লন্ডনের ওয়াটার লিলি মিলনায়তনে মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশটি ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রচারণা সমাবেশে পরিণত হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও বিশেষ অতিথি ছিলেন কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই তারা মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি আবদুল গাফফার চৌধুরী রোশনারা আলীকে সরাসরি সমর্থন জানিয়ে বলেন, রোশনারা আলীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা উচিত। তিনি বলেন, রোশনারা আলী নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ভূমিকা রাখবেন। এছাড়া এদেশে অবস্থানরত যুদ্ধাপরাধীদেরকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে বিচারের মুখোমুখি করার ব্যাপারে তার ভূমিকা থাকবে।
গত নির্বাচনে এ এলাকায় বিজয়ী হয়েছিলেন রেসপেক্ট পার্টি প্রধান জর্জ গ্যালাওয়ে। এবার তিনি নির্বাচন করছেন পার্শ্ববর্তী আসন পপুলার অ্যান্ড লাইম হাউস থেকে। এবার বেথনাল গ্রিন ও বো আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন রেসপেক্ট প্রার্থী আবজল মিয়া। ১৮ এপ্রিল থেকে তিনি আনুষ্ঠানিক প্রচারণা শুরু করেছেন। পূর্ব লন্ডনের টার্লিং কমিউনিটি সেন্টার থেকে নির্বাচনী লড়াইয়ে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করেছেন ব্যাটল বাস নিয়ে। আনুষ্ঠানিক প্রচারণার উদ্বোধন করেছেন রেসপেক্ট পার্টির নেতা এ এলাকার এমপি জর্জ গ্যালাওয়ে। তিনি অনুষ্ঠানে নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা করেছেন। মেনিফেস্টোর মূল কথা—সব ধরনের বৈষম্যের অবসান এবং শান্তি ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। জর্জ গ্যালাওয়ে বলেছেন, তিনি ভোটারদের কাছে দেয়া তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন। এ এলাকা থেকে তিনি নিজে প্রার্থী না হয়ে বাঙালির প্রতিনিধি আবজল মিয়াকে প্রার্থী দিয়েছেন। তিনি আশা করেন, সবার ভোট পেলে বিজয়ী হয়ে আবজল মিয়া হাউস অব কমন্সে এবার বাঙালিদের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
সরকার গঠনের দৌড়ে সম্ভাবনার তালিকায় সামনের কাতারে থাকা কনজারভেটিভ পার্টির প্রার্থী জাকির খান। প্রতিদিনই চলছে প্রচারণা। জাকির খান সভা-সমাবেশ করছেন বিভিন্ন ওয়ার্ডে। বলছেন, এবার কনজারভেটিভ পার্টি সরকার গঠন করবে। এ এলাকায় প্রথম বাঙালি প্রার্থীও ছিল কনজারভেটিভ দলের। এবারও কনজারভেটিভ দলের প্রার্থী হিসেবে তিনি জনগণের কাছে এসেছেন। তিনি সবার কাছে ভোট দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ এলাকার সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন যোগ্য নেতৃত্ব। তিনি সে দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।
এদিকে প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের তর্কযুদ্ধের ফলাফলে এগিয়ে লিবডেম দলনেতা নিক ক্লেগ। অপরদিকে টোরি ঠেকাতে প্রয়োজনে লিবডেম প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য লেবার দলনেতা গর্ডন ব্রাউনের আহ্বান এসব বিষয়গুলো আরও উদ্দীপ্ত করেছে লিবডেম থেকে এমপি প্রার্থীদের। এ এলাকার লিবডেম প্রার্থী আজমল মাসরুর। পোস্টার, লিফলেট, মিডিয়ায় বক্তৃতা—সব মিলিয়ে চলছে তার প্রচারণা। সভা করছেন ভোটারদের সঙ্গে। কথা বলছেন কমিউনিটি প্রতিনিধিদের সঙ্গে। শুক্রবার জুমার নামাজের পর মুসল্লিদের টার্গেট করে প্রচারণার সুযোগও হাতছাড়া করছেন না তিনি। গ্রিন পার্টির ফরদ বখতও নিজের ব্যতিক্রমধর্মী বক্তব্য নিয়ে যাচ্ছেন ভোটারদের কাছে; চলছে প্রচারণা। View this link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




