somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঢাকার গ্রীষ্ম : উৎসব হোক ফুলের

২৯ শে এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বছর দশেক আগে আরেকবার জাপান গিয়েছিলাম, এপ্রিল মাসে। মনি ভাই ডেকেছিলেন চেরি ব্লোজম বা সাকুরা দেখতে। বসন্তের শুরুতে পুরো জাপান ভরে যায় চেরি ফুলে, গোলাপি, সাদা। আর জাপানিদের শুরু হয় ফুল দেখার উৎসব। ওদেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। প্রায় সপ্তাহখানেক ছুটি থাকে ওই সময়টায়। সবাই তন্ময় হয়ে ফুল দেখে। মিশে যায় প্রকৃতির সঙ্গে। সেবারই ফেরার পথে দুপুরবেলা যখন থাই এয়ারওয়েজের ফ্লাইটটা ঢাকার ওপর একটা ঘুরানি দিয়ে নেমে আসছিল রানওয়েতে, তাকিয়ে দেখছিলাম পুরো শহরে ছড়িয়ে থাকা থোকা থোকা আগুন। আসলে আগুন নয়, থোকা থোকা কৃষ্ণচূড়া। যদিও কেউ বলে গুলমোহর। কিন্তু আমরা কৃষ্ণচূড়া নামেই চিনি, জানি। এই ভরা গ্রীষ্মে এই প্রিয় শহরে সম্ভাষণ জানায় কৃষ্ণচূড়া।
একেক শহর একেক দেশ একেক ঋতুতে সবচেয়ে সুন্দর হয়ে ওঠে। পুরো বাংলাদেশ সুন্দর হয় বর্ষায়। বিশেষ করে যদি বলি, আমাদের পার্বত্য অঞ্চল, আমাদের সমুদ্রসৈকত সবই বর্ষায় পায় তার সেরা রূপ। তেমনি ভাদ্র মাসে বা বর্ষার শেষে শরতের শুরুতে এদেশে বেড়ানোর সেরা জায়গা কুড়িগ্রাম। হাশেম খানের তুলিতে আঁকা গ্রাম কেউ দেখতে চাইলে চলে যেতে হবে ভাদ্র মাসে কুড়িগ্রামে। ভরা পূর্ণিমায় দিনাজপুর। আদিগন্ত ধানক্ষেত অথবা রাম সাগরের পাশে টিলার ওপর যে বুনো গেস্ট হাউস সেখানে বসে দেখতে হবে পূর্ণিমার রূপ। কপাল ভালো থাকলে দূর থেকে ভেসে আসবে সাঁওতালি বা পলিয়া গ্রামের মাদলের সুর। একবার নীল পূর্ণিমা দেখেছিলাম রাজেন্দ্রপুরের শালবনে, অনেক ঝক্কি সামলে। সেও প্রায় ১৮ বছর আগে। এতদিনে আর সেই চাঁদ দেখার ঝক্কি নাই আবার শালবনও নাই। এখনও হয়তো শীতকালে সবচেয়ে সুন্দর ঠাকুরগাঁও, নির্দিষ্ট করে বললে রুহিয়া অথবা চিত্রা নদীর পাড়ে নড়াইল। এত এত সুন্দরের দেশে ঢাকা শহর সবচেয়ে সুন্দর গ্রীষ্মকালে।
শীত বা বসন্ত নয়, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি ফুল ফোটে গ্রীষ্মে। লাল কৃষ্ণচূড়া আর বেগুনি জারুল যখন পাশাপাশি ফোটে, এত সুন্দর কালার কম্বিনেশন আর কিছুতে মেলে না। এই গ্রীষ্মে ঢাকা শহর শুধু অগ্নি স্নানে শুচি হয় না, শুচি হয় ফুলের প্লাবনে। এরকম গ্রীষ্মের কত ভরা দুপুর গেছে কলা ভবনের পঞ্চম তলার বারান্দায় একা দাঁড়িয়ে। মনে হয়েছে বেগুনি আর লালের সমুদ্রে ভেসে যাচ্ছি, কোথায়, কোনখানে কেউ জানে না। কলাভবন আর ডাকসুর মাঝে যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা, এর মতো সুন্দর, ঋজু কোনো গাছ আর কোথায় পাব?
শুধু জারুল বা কৃষ্ণচূড়া নয়, এসময়ের আরেকটা পাগল করা ফুল সোনালু। এত সুন্দর ফুলটাকে আমরা পচা করে বলি বাদরের লাঠি! কচি কলাপাতা রঙের পাতার আড়াল থেকে যখন থোকা থোকা হালকা ঝুড়ি ঝুড়ি ফুল বের হয়ে আসে, তাকিয়ে দেখতেই আনন্দ। এই গ্রীষ্মে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটে। যত মন খারাপ থাকুক, যত ঝড় ঝঞ্ঝা, বজ্রপাত হোক, দুপুর বেলা এক গাছ সোনালু বা জারুল দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। এটা পুরোই আমার ব্যক্তিগত টনিক। কারও যদি মন চায়, ব্যবহার করে দেখতে পারেন। আরেকটা ফুল একটু দেরি করে ফোটে বটে, তবে গ্রীষ্মেরই শেষাশেষি ফুটে উঠবে গাঢ় বেগুনি ফুরুস। কারওয়ান বাজার থেকে শেরাটনের রোড ডিভাইডার বা বিজয় সরণির বাম পাশে মাথাভর্তি সাদা কুর্চির পাশে দারুণ গর্বিতভাবে হাসবে এই সব ফুরুস। ভুল করে যাকে এদেশের লোকে বলে চেরি। এখনও অল্প কিছু কুর্চি গাছ আছে শহরে। কলা ভবনের ছোট বাগানে আছে একটা। ওপর থেকে দেখলে মনে হয় সবুজ জমিনে সাদা ধবধবে তারা ফুটে আছে অসংখ্য। কুর্চির কথা যখন বলছি তখন পাঠে মন না বসানোর জন্য দায়ী কাঁঠালচাঁপাই বা বাদ যায় কেন? বেইলি রোডের কোণায় ভিকারুননিসার মাঠ ছাড়াও বেশ কিছু কাঁঠালচাঁপা গাছ ভরে যায় এই সময়ে সাদা আর গোলাপিতে। যেই ফুলটাকে অনেক দিন মাধবীলতা বলে চিনেছি, পরে জেনেছি মধু মঞ্জরী নামে। সেও কিন্তু আপ্রাণ ফুটে ওঠে বৈশাখের শুরু থেকে। গোলাপি লাল সাদা মিলিয়ে এমন সুন্দর । মনে হয় প্রকৃতি তার শেড সুতোয় করেছে নিপুণ কারুকাজ। চারুকলার গেটটা এসময় ভরে যায় এ ফুলে। এছাড়াও ধানমন্ডি মোহাম্মদপুরের বেশ কিছু ৫/৬ তলা বাড়ির একেবারে নিচ থেকে ছাদ পর্যন্ত উঠে গেছে মধু মঞ্জরীর ঝাড়। সন্ধ্যায় আশেপাশে ভরে যায় মিষ্টি সৌরভে। আরেকটা ফুল মন কেড়ে নেয় এ সময়। কৃষ্ণচূড়ার লালের ভিড়ে মিষ্টি একটা ঠাণ্ডা রং। এই রকমই বড় গাছের মাথা ভর্তি করে ফোটে। আগে একটা গাছ ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পুরনো ভবনের ভেতরের উঠোনে। নাম সম্ভবত জ্যাকারান্ডা। এখন একটা দেখি চন্দ্রিমা উদ্যানে। আমাদের স্মৃতির ঝাঁপি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সেই পুরনো ভবন নেই। নেই সেই গোলাপি ফুল গাছ ছাড়াও আরও কিছু গাছ। কিন্তু নতুন ভবনে এখনও আছে একটা মহুয়া। আগের মতোই।
এই এপ্রিলে কাঠমান্ডু শহরে একটা ফুল ফোটে, ভিনদেশি খটোমটো নাম, মনে থাকে না। অনেক বড় গাছে নীল-বেগুনি ফুল। শহরের রাস্তা ভরে থাকে ফুলের পাপড়িতে। গত কয়েক বছর এরকম একটা গাছ দেখি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কাছে। অল্প কিছু ফুল ফোটে। এতসব বনেদি ফুলের ভিড়ে খুব মিষ্টি একটা ফুল ফোটে, আমরা হয়তো খেয়ালও করি না। নিম ফুল। এখনও পুরো শহরে নজরে পড়ে গোটা কয়েক নিম গাছ। ঝিরঝিরে পাতার ডাল এসময় ভরে গেছে নাকফুলের মতো সাদা ফুলে। আর ফোটে কামরাঙার ফুল। নিমের মতোই ছোট্ট ছোট্ট। ডালের গা জড়িয়ে গোলাপি বেগুনি মিষ্টি ফুল। নামের মতোই সুন্দর, রহস্যময়। যারা জলপাই গাছ চেনেন, মনে করে মাথার ওপর তাকালে দেখবেন জলপাই গাছেও ফুল এসেছে। জলপাই যখন এলো, তখন জামরুলই বা বাকি থাকে কেন! ছোট ছোট ঝাড়বাতির মতো ফুলে ছেয়ে গেছে ঢাকা শহরের সবগুলো জামরুল গাছ। থাক এসব অচেনা, কম চেনাদের কথা বাদ দিই। প্রায় সবাই চিনি, সব জায়গায় দেখি এরকম একটা ফুল, বাগান বিলাসের কথা বলি। এই গ্রীষ্মেই বোধহয় ফুলটা সবচেয়ে বেশি জোর পায়। কোনোরকম কার্পণ্য না করে ফুটে ওঠে। আরেকটা বকুল, যদিও তার ফোঁটার সময় বর্ষা। কিন্তু গ্রীষ্মেই সে চলে আসে ঢাকা শহরে। গত কয়েকদিনই দেখছি বনানী ৭ নম্বরের কাছে ছাতার মতো মেলে ধরা একটা বকুল গাছ। নিচে দিয়ে হেঁটে যেতে গেলে সৌরভে মাতিয়ে তুলছে।
তো এই মশা, যানজট অপবাদের জন্য খ্যাত এই ঢাকা শহরটা যখন গ্রীষ্মকালে এত রঙে রূপে ভরে ওঠে, তাকে তো তখন বলাই যায় গ্রীষ্মের সুন্দরী ঢাকা। শহর কার্পণ্য করে না, প্রকৃতিও করে না। কার্পণ্য করি আমরা। আমরা আমাদের প্রিয় শহরের অসুন্দর অংশগুলো দেখি। সুন্দরটা উপভোগ করি না। এসময় সংসদ ভবনের পুরো মাঠটা ভরে যায় ছোট ছোট কাশফুলের মতো সাদা ঘাসফুলে। কজন সেটা খেয়াল করি? অনেক বছর আগে যখন সংসদ ভবনের লাল টানেলটা ভিআইপিদের জন্য সংরক্ষিত ছিল না, সাধারণ মানুষের সাধারণ গাড়িটাড়িও খুব সাধারণভাবে টানেলটা পার হতে পারত। তখন থেকেই টানেলের মুখের সোনালুর সারি দেখতাম আর ভাবতাম একদিন একটা সারাদিন কাটিয়ে যাব এই ফুল ভরা গাছের নিচে, লাল ফুটপাতে। বলা বাহুল্য, এখন পর্যন্ত কোনোদিনও তা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু কোনোদিন যে হবেও না, সেটাও ভাবতে চাই না। জাপানিজ বা সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হওয়া আমেরিকানদের চেরি উৎসবের মতো আমরাও তো ভরা গ্রীষ্মে একটা সোনালু বা কৃষ্ণচূড়া উৎসব করতেই পারি। একটা দিন পরিবার পরিজন, শিশু প্রবীণ-তরুণ সবাই মিলে শুধু ফুল দেখব। কোনো ড্রেসকোড নেই, ফুডকোড নেই। যার যেমন ইচ্ছা তেমন রঙের নিত্যদিনের বা তুলে রাখা পোশাকটি পরেই না হয় বের হব। প্রকৃতির দোহাই লাগে দরকার নেই আলাদা শপিং। শুধু উৎসব হোক। আমাদের শিশুরা একদিন স্কয়ার ফিটের হিসাব আঁটা ঘর থেকে বের হোক। ফুল চিনুক, গাছ চিনুক। আমাদের প্রবীণরা একদিন গাছের নিচে বসে গল্প করুক ফেলে আসা সেই সব দিনের। আমাদের তরুণরা গান ধরুক, সুরে অথবা বেসুরো গলায়।
অনেক অনেকগুলো বছর আগে পেছনে ফেলে আসা গ্রীষ্মের অলস দুপুরগুলোর মতো আরেকটা উৎসবের দুপুর ফিরে আসুক আমাদের নাগরিক জীবনে।
(লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে নিউজ ম্যাগাজিন ‘সাপ্তাহিক’এর বর্তমান সংখ্যায় )
http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=10201
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় কারো হাত না ধরে (ছবি ব্লগ)

লিখেছেন জুন, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:০৯

ঐ নীল নীলান্তে দূর দুরান্তে কিছু জানতে না জানতে শান্ত শান্ত মন অশান্ত হয়ে যায়। ১৯২৯ সালে রবার্ট মোস নামে এক ব্যাক্তি লং আইল্যান্ড এর বিস্তীর্ণ সমুদ্র... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×