(১) ফেক হাইপ, বেস্ট সেলার বই ‘পদ্মা সেতুতে যা’ এবং অন্ধ জেন জি খরিদ্দারগণ
‘পদ্মা সেতুতে যা’ –২০২৪ বইমেলার নাম্বার ওয়ান বেস্ট সেলিং বই এটি। বইয়ের প্রকৃত নামটা বলা যাচ্ছে না কিছু কারণে; ধরেই নেই সেটার নাম ‘পদ্মা সেতুতে যা!’ এর রচয়িতা তরুণ এক লেখিকা। এই বইটির আগে তাঁর বই বেরিয়েছিল দুয়েকটি। কিন্তু এই বইটি এত সাড়া ফেলে দিয়েছিল, যা তাঁর রচিত এর আগের বইগুলোতে বিন্দুমাত্র পাওয়া যায়নি। তবে, এই বইটি প্রকাশের বেশ কয়েকমাস আগ থেকেই ধারণা করা যাচ্ছিল বইটি প্রকাশিত হলে বেশ সাড়া পাবে। যেহেতু অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বইটি বা বইটির কাহিনি নিয়ে কথা বলছিল। কিন্তু বইটি নিয়ে প্রচার-প্রচারণা সোশ্যাল মিডিয়ায় যেন দিনকে দিন বেড়েই চলল। আমরা যারা লেখালেখির সাথে অনেকদিন ধরে জড়িত, তারা বিষয়টা দেখে অবাক হলাম। দিনকে দিন যেন সোশ্যাল মিডিয়ায় এর প্রচার-প্রচারণা আকাশচুম্বী হয়ে গেল। এমনকি কোনো কোনো আইডি থেকে বলা হলোঃ এটি নাকি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেরা বই! আমরা যারা বইয়ের জগত অনেকদিন ধরেই ফলো করি, তারা জানি বিষয়টা স্বাভাবিক ছিল না। একটু ভালো করে খেয়াল করে দেখলামঃ এই বইটি নিইয়ে প্রচার-প্রচারণা যে আইডিগুলো ব্যবহার করে করা হচ্ছে বা হয়েছে, এর ৯০%-ই ছিল ফেক আইডি। সচেতন কোনো পাঠক বা লেখক বিষয়টা আঁচ করতে পেরে এই বইটিকে নিইয়ে সমালোচনা করে পোস্ট দিল। কেউ কেউ এই ফেক আইডিগুলোর মাধ্যমে প্রচারণাকে নিয়েও সমালোচনা করে পোস্টও দিয়েছিল। কিন্তু এতে যেন ‘বিপরীতে হিত’ হয়ে গেল এই কথিত বইটির জন্য। এই বইটি ও এর কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা আরো বেড়ে গেল। এমনকি দেখা গেল এই বইটি নিয়ে নেগেটিভ পোস্ট বিভিন্ন বইয়ের গ্রুপে দিলে বইটি নিয়ে আলোচনা আরও বেড়ে যেতে লাগল। সেই পোস্টগুলোতে রিঅ্যাক্ট ও কমেন্টের ঝড় উঠত। আমরা যারা শুদ্ধ সাহিত্যের পূজারী, তারা এসব নিয়ে খুব বিরক্ত ছিলাম। কিন্তু বইটির আসল ‘কাহিনি’ তখনও আমাদের দেখা হয়নি। দেখা গেল ২০২৪ বইমেলাতে বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকে। দেখা গেল বইটি নিইয়ে একপ্রকার কাড়াকাড়ি পড়ে গেল; আগে খালি অনলাইনে বইটি নিয়ে মারাত্মক আগ্রহ দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা গেল, বইমেলাতে তরুণ-তরুণীদের বিরাট একটা অংশ এই বই সংগ্রহের জন্য পাগল হয়ে গেল! একেবারেই তরুণ তরুণী আরকি, যারা টিনএজার থেকে শুরু করে খুব বেশি হলে ২৫-২৬ বছর বয়সী। এই বইয়ের সংগ্রাহক ৯০%-ই ছিল এই বয়সসীমার।
এক হিসাবমতে, এক বছরের মধ্যে এই বই যত কপি সেল হয়েছে, হুমায়ুন আহমেদের কোনো বইও এক বছরে এত পরিমাণে কখনো সেল হয়নি। শীর্ষ বেস্ট সেলার তালিকায় থাকা হুমায়ুন আহমেদ বা সাদাত হোসাইনের কোনো কোনো বই গত ১০-১৫ বছর ধরে যত কপি সেল হয়েছে, এই লেখিকার কথিত বইটি এক বছরে সেল হয়েছে তাঁর চেয়ে বেশি।
এই যে অবশ্বাস্য টর্নেডো গতির সেল, এর পিছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছে তিনটি ফ্যাক্টর বা জিনিস। সেগুলো হলোঃ শতাধিক ফেক আইডি কর্তৃক প্রচার-প্রচারণা, নেগেটিভ প্রচারে উল্টো হাইপ পেয়ে যাওয়া এবং হাইপে আক্রান্ত গভীরতাহীন, বিচার-বিবেচনায় ঘাটতিওয়ালা জেন জি ছেলেমেয়েদের পাগলের মতো এই বই সংগ্রহ করতে এগিয়ে যাওয়া।
আমি আমার পরিচিত কোনো শিক্ষিত, রুচিশীল বা সমঝদার ব্যক্তিকে এই বই কালেকশন করতে দেখিনি। আসলে আমার পরিচিত কাউকেই এই বই কালেকশন করতে প্রায় একেবারেই দেখিনি বললেই চলে। তাহলে এই বই স্রোতের মতো কিনে কারা একে সর্বকালের বেস্ট সেলার উপন্যাস বানাল? আর কারা? জেন জি’র কথিত পাঠকেরা। যারা কিনা হাইপ বা ভাইরালের ব্যাপকভাবে আক্রান্ত! কোনো জিনিস হাইপ বা ভাইরাল হলেই তারা মনে করে, এই জিনিসের এত হাইপ, এত্ত প্রচারণা, এই জিনিস তো নিতেই হয়। কী নিচ্ছে, সেটা কি ভালো না মন্দ, সেটা তাদের কাছে কোনো ব্যাপার না।
আর, শত শত ফেক আইডি ব্যবহার করে মিথ্যা প্রচার-প্রচারণা কতটা সুস্থ বা নৈতিক কাজ, সেই প্রশ্ন আজ না হয় বাদই রাখলাম!

(২) বাংলাদেশের রাজনীতিতে জেন জি কর্তৃক আসন্ন যে বিপদ
যেহেতু জেন জি’র বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে স্রেফ হাইপ দ্বারা আক্রান্ত, বিশেষ করে অনলাইন হাইপ, তাই সেই ‘পদ্মা সেতুতে যা’ উপন্যাসের মতো করেই অনলাইনে কোনো জিনিসের ব্যাপক হাইপ বা আলোড়ন তুলে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করা অনেকটাই সহজ।
কোনো বিশেষ স্বার্থবাদী গোষ্ঠী যদি কোটি কোটি টাকার অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া বাজেট নিয়ে বিশেষ কোনো ইস্যুতে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনলাইন বুস্টিং ও পেইড বট বাহিনীর মাধ্যমে প্রচারণা চালায় ও হাইপ তৈরি করতে পারে, তবে বিশাল সংখ্যক জেন জি ছেলেমেয়ে কিন্তু সেই হাইপেই আক্রান্ত হয়ে সেটিতেই একমত হবে বা সমর্থন দিবে।
গত কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় চলা ‘পাঁচ বছর, পাঁচ বছর’ বা ‘অমুকেই আস্থা’ বা ‘নির্বাচন চাই না, অমুককে এত বছর চাই’ টাইপের যে প্রচারণা দেখা যায়, সেটা কিন্তু বিশেষভাবে জেন জি’র এই ভয়ঙ্কর দুর্বল দিকটাকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে। যার কারণে ভূঁইফোড় এক কিংস পার্টি ও তাদেরকে অন্যায্য সমর্থন দিয়ে যাওয়া ক্ষমতাবান ভ্রষ্ট-শক্তিটির পক্ষে বেশ ভালো সমর্থন গড়ে উঠেছে। এসব পেইড ও বট কর্তৃক অনলাইন প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে অনেকেই ফেসবুকে বা ইউটিউবে কিন্তু বলছে, ‘আমরা নির্বাচন চাই না, অমুককে চাই,’ অথবা নির্বাচন বা সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ট্রানজিশনের সপক্ষে কেউ কথা বললে তাদেরকে ‘ভারতের দালাল’ বা ‘স্বৈরাচার’-এর দোসর বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা ভুলে যাচ্ছে, গণতান্ত্রিক ট্রানজিশন সঠিকভাবে না করতে চাওয়ার কারণে বা জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাওয়ার কারণেই কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ফুঁসে ছিল, যার চূড়ান্ত বিস্ফোরণ ঘটে ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে। আর সেটা ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক, কেননা বিপুল বাজেটের ক্রমাগত অনলাইন প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে মিথ্যা ও ভ্রান্ত জিনিসকেও সত্য ও সঠিক মনে করছে (অন্তত অনলাইনে) বিপুল সংখ্যক মানুষ। আমার ফেসবুক প্রফাইলে এই ধরনের মানুষ অন্তত ১০% হলেও পেয়েছিলাম (যাদেরকে আমি অবশ্য ধরে ধরে আনফ্রেন্ড করেছি গত কয়েক মাসে; যাদের মধ্যে আমার বন্ধুবান্ধব, পরিচিত বা আমার সাথে খুব ভালো সম্পর্ক, এমন মানুষও ছিল)।
পেইড ও বটভিত্তিক অনলাইন ব্যাপক মিথ্যা প্রচার-প্রচারণাতে প্রভাবিত হওয়া থেকে মানুষকে, বিশেষত, বিশাল সংখ্যক জেন জি ছেলেমেয়েকে দূরে রাখতে সক্ষম না হলে আমাদের দেশের সুষ্ঠু ও মধ্যপন্থী ধারার গণতান্ত্রিক মানুষজনের কপালে কিন্তু খারাবি আছে! তাতে করে দেশকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা লুটতে চাওয়া অগণতান্ত্রিক ও ডানপন্থী শক্তিটি আরো শিকড় গেঁড়ে বসবে।
আমি তো এমনটাই দেখতে পাচ্ছি; আপনারা কী বলেন?