আজ ২২ সেপ্টেম্বর ইনডিপেন্ডেন্ট টিভি চ্যানেলের এক সাংবাদিক জান্নাতুল ফেরদৌস হরতালের খবর বলতে গিয়ে বললেন,‘সাধারণ মানুষ হরতাল পছন্দ করে না’। কিন্তু গতকাল ২১শে টিভির ড. কণক সরোয়ার সাধারণ মানুষের মতামত প্রদর্শনের সময় দেখা গেল অনেকেই হরতালকে সমর্থন করছেন। তিনি নিজেও বললেন ‘কেউ হরতালের পক্ষে কেউ বিপক্ষে'।
ইনডিপেন্ডেন্ট টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক জান্নাতুল ফেরদৌস আসলে নিজের ইচ্ছাকে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা বলে প্রমাণ করতে গিয়ে তিনি সাংবাদিক হিসেবে হরতাল সমর্থনকারী দর্শকদের ঘৃণা কুড়িয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে ইনডিপেন্ডেন্ট টিভি চ্যানেলের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণ যোগ্যতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তাছাড়া ঐ সংবাদ হরতাল সমর্থনকারীদের মনে এমন ভাব উদয় করেছে যে তাদের সেই চিন্তা হয়তো সারাজীবনই থেকে যাবে, তারা নিশ্চিত হয়ে গেল যে, ইনডিপেন্ডেন্ট টিভি চ্যানেল একটি দলীয় চ্যানেল অথবা তার সাংবাদিকরা কোন দলের চামচা। মোট কথা চ্যানেলটি নিরপেক্ষ নয় এবং জনগণের নয়।
এটা কমবেশি সকল চ্যানেলের ব্যাপারে প্রযোজ্য।
হরতাল বিরোধীদের বক্তব্য হচ্ছে, হরতাল সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে দুর্ভোগ নিয়ে আসে। বিশেষ করে যারা দিন আনে দিন খায় তাদের আর কষ্টের সীমা থাকে না। দ্বিতীয়ত: দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের চরম ক্ষতি হয়। যা টাকার অংকে কয়েকশ’ কোটি টাকা। এটা জাতীয় অর্থনৈতিক ক্ষতি।
এক্ষেত্রে উপরোক্ত সকল সত্যকে সত্য হিসেবে মেনে নিয়ে এর সঙ্গে আরো যোগ করা যায় যে, হরতাল একটি সরকারের ভাবমূর্তি বিদেশীদের কাছে নষ্ট করে দেয়, বিদেশী বিনিয়োগ সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। এতে হরতাল আহবানকারীদের অবস্থান সরকার হঠাবার ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়। জনমত ঐক্যমতে পৌছাবার রাস্তা পায়, কোন কোন ক্ষেত্রে বন্যার কারণে একটু উচু জায়গায় সাপ-ব্যাঙ অর্থাৎ শত্রু-মিত্র যেমন একত্রিত হয় তেমনি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সরকারের বিশেষ কিছু সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচারণে অনেক ভিন্ন মত ঐক্যবদ্ধ হবার সুযোগ পায়। মোট কথা হরতাল একটি সরকারের জন্য কোনদিক দিয়েই সুখবর বয়ে আনে না।
অপরদিকে যারা হরতালকে সমর্থন করেন তাদের বক্তব্য উপরোক্ত উদ্দেশ্য হাসিলের প্রচেষ্টা। এর সঙ্গে তাদের আরো একটি যুক্তি হলো একটি নষ্ট রাস্তা চলাচলের উপযোগি করতে গেলে সেটি ঠিকঠাক করা দরকার, তাতে জনগণের সাময়িক অসুবিধা হবেই। অর্থাৎ বৃহৎ কল্যাণের জন্য সাময়িক কষ্ট মেনে নিতে হবে।
মোট কথা একটি সরকার যখন দেশ পরিচালনা করে তখন একদিকে যেমন দেশের কল্যাণ যেমন তারা সাধন করে, তেমনি কোন কোন ক্ষেত্রে জনগণের মৌলিক স্বার্থ ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। কখনো কখনো দেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে যে সব দেশের নেতৃবৃন্দের কিছু বিশেষ ব্যক্তি তাদের কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য এবং ইচ্ছাকে জনমত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে এবং নিজেদেরকে ক্ষমতাসীন করার জন্য বিদেশী শক্তির দারস্থ হয়। বিদেশীরা তখন নিজেদের কিছু স্বার্থ উদ্ধার করেই সাহায্য করে থাকে। এক্ষেত্রে সেই সরকারকে সেই ধরণের কাজ থেকে নিবৃত করা বা তার বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করার জন্য হরতালের বিকল্প নেই।
সরকারের বিশেষ কিছু ব্যক্তির বিশেষ কিছু ইচ্ছাকে সকল জনতার ইচ্ছা হিসেবে প্রমাণ করার জন্য সরকার তার সকল ক্ষমতাকে ব্যবহার করে। কিন্তু বিরোধী দলেরও সেই স্বাধীনতা থাকা উচিৎ এটা প্রমাণ করা যে, এটা সকল জনতার ইচ্ছা নয় বরং কিছু বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ কিছু ইচ্ছা। আর এটাই গণতন্ত্র। এখানে দেখা যায় সরকার সেটা প্রমাণ করতে দিচ্ছে না। তার ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমে সেই প্রচেষ্টা নস্যাৎ করে দেবার প্রবল চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এতে কি প্রমাণ করা সম্ভব যে সরকারের কিছু বিশেষ ব্যক্তির বিশেষ কিছু ইচ্ছা আসলে সকল জনতার ইচ্ছা? কখনোই তা নয়। এতে হয়তো সেই সকল জনতা যারা সেই বিশেষ ইচ্ছার সঙ্গে একমত নয় তারা সরকারের ক্ষমতার দাপটে চুপ থাকবে, কিন্তু তাদের অন্তরে চেপে থাকা ক্ষোভ প্রশমিত তো হবেই না বরং চেপে থাকার কারণে তা আরো বিকৃত হবে এবং উপযুক্ত নেতৃত্বে একসময় তা বিস্ফারিত হবেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক বিপ্লবগুলি ঐ একই নিয়মে হয়েছে।
যে সকল সাংবাদিক উপরোক্ত সত্যকে এড়িয়ে যান তারা আসলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করেন। ফলে তারা প্রকারান্তরে সরকারেরই ক্ষতি করে বসেন, নিজের প্রতিষ্ঠানেরতো বটেই।
এক ধরণের সাংবাদিক টিভিশোতে বলেন, দেশ এখন গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে এখন হরতাল অর্থহীন। তাদের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ কি তা স্পষ্ট নয়। কারণ বাস্তবে দেশের একটা বিশাল সংখ্যক জনতার অস্তিত্বকে ভিন্ন মতাদর্শের কারণে অস্বীকার করা, অর্থাৎ চাকরি, ব্যবসা এবং রাষ্ট্রিয় অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার নাম গণতন্ত্র কি করে হয়!
দ্বিতীয়ত: বর্তমান হরতালের বিপক্ষে যারা বলছেন তারা সেই লগি-বৈঠার তান্ডব এবং সেই সময়কার হরতাল অবরোধকে কি বলবেন! তা যদি জনস্বার্থে হয় তবে বর্তমান হরতাল আহবানকারীরা তো ঐ একই যুক্তি দেখাবেন যে এখনকার হরতাল জনস্বার্থে হচ্ছে। অতএব সাংবাদিকদের দৃষ্টিভঙ্গি নিরপেক্ষ হওয়া দরকার, নিজস্ব মতামত টিভির পর্দায় জনমত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মত মুর্খামী করা ঠিক হবে না। জনমত একটা ভিন্ন বিষয়, একটি দেশে বিদেশীদের বিরুদ্ধে জনমত যে রূপে ঐক্যবদ্ধ হয়, একই জনগণ নিজের দেশের জনতার বিরুদ্ধে সেভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে না। সে চেষ্টায় জাতির ঐক্য বিনষ্ট হয়, জাতির ভ্রাতৃত্ববোধ নষ্ট হয়, জাতিসত্ত্বা খন্ড-বিখন্ড হয়ে যায়। তাতে দেশ তো দূরের কথা একটা সরকার নিজস্বভাবেও এগোতে পারে না। অতএব সেই সব সাংবাদিকদের উচিত হবে এই পবিত্র দায়িত্ব সকল জনতার স্বার্থে ও কল্যাণের প্রতি নিবেদন করা।
মিডিয়া মানেই পবিত্রতা। নিরপেক্ষতা। সত্য পথের অনুসারী। আপনি যখন পানি খান তখন মিডিয়া হিসেবে যে গ্লাসটা ব্যবহার করেন তার পরিচ্ছন্নতা ও পবিত্রতা অবশ্যই আপনি চাইবেন। আপনার নগ্ন শরীর ঢাকার মিডিয়া হিসেবে ব্যবহৃত পোশাককে, আপনার শোবার বালিশ-বিছানাকে, আপনার খাবার প্লেটকে অর্থাৎ সকল মিডিয়াকে আপনি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্রই যখন চান তখন দর্শক-শ্রোতা হিসেবে খবর পাওয়ার মিডিয়া হিসেবে আপনাকেও আমার তেমনিই চাইবার অধিকার আছে।