শেখ মিঠুন
বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের কাছে এ কথা স্পষ্ট যে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশে জাতীয় এবং জাতীয়মানের যে পুরস্কার প্রদান করা হয় তা নিরপেক্ষ নয়। স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পুরস্কার, বাংলা একাডেমি পুরস্কার এমন কি চলচ্চিত্র ও মিডিয়া পুরস্কারের ব্যাপারেও দলীয় বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়। দেশবাসি দেখেছে, যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন মূলত সেই দলেরই লোকদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে পুরস্কার প্রদান করা হয়। একথা সত্য যে, একটি দল ক্ষমতায় থাকাকালীন সে দলেরই যোগ্য লোককে পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু অন্য দলে যদি তার চেয়েও উচ্চতর যোগ্যতার কেউ থাকে তবে তাকে পুরস্কার দেয় হয় না। সরকার বদল হলে এবং সেই উচ্চতর যোগ্যতার ব্যক্তির দল যদি ক্ষমতায় আসে তবে হয়তো সেই ব্যক্তি পুরস্কৃত হয়। কিন্তু যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তির দল যদি কখনো ক্ষমতায় না আসে তবে সে ব্যক্তি কখনো পুরস্কার পায় না। এই হচ্ছে আমাদের দেশে পুরস্কার প্রদানের ইতিবৃত্ত।
এখন যদি আমরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের দিকে তাকাই তবে সেখানেও বাংলাদেশের পুরস্কার প্রদানের ঐ একই নমুনা দেখতে পাবো। এমন কি আন্তর্জাতিক পুরস্কার দেবার যে সব প্রতিষ্ঠান আছে, তাদের প্রদত্ত পুরস্কার যে নিরপেক্ষ নয় তা পুরস্কার প্রদানের পরে আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকাগুলো পাঠ করলেই বুঝা যায়। অর্থাৎ দেশ-বিদেশের বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সব পুরস্কারই বিতর্কিত।
আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের কোন নেতা এমন কি কোন সমাজসেবী বা কবি-সাহিত্যিক বা যে কোন ক্ষেত্রের যে কেউ যখন বিদেশের কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পুরস্কৃত হন তখন এ বিষয়টি নিশ্চিত যে, অবশ্যই পুরস্কার দেয়া সেই প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ সদস্যের আদর্শগত চিন্তার সঙ্গে পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যক্তির আদর্শের একটা সাদৃশ্য রয়েছে। সাদৃশ্যহীন চিন্তা-চেতনার ব্যক্তিকে কেউ পুরস্কৃত করে না।
বিশেষ করে কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি যখন বিদেশ থেকে পুরস্কার পান তবে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, তার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে সেই প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ সদস্যের চিন্তা-চেতনার সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু যখন প্রচার চালানো হয এই পুরস্কার দেশ ও জাতির জন্য সুখবর তখন তা একটা বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাড়ায়। কারণ সেই রাজনৈতিক নেতার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে জাতি একাত্মবোধ নাও হতে পারে। তাই এটা স্বাভাবিক ব্যাপার যে এটা দেশের জন্য খুব যেমন সুখবর নয় তেমনি দু:সংবাদও নয়। কিন্তু দু:সংবাদ তখনই হয়ে দাড়ায় যখন দেখা যায় রাষ্ট্রিয় নেতাকে চিন্তা চেতনার সাদৃশ্যের জন্য পুরস্কার দেয়া হয় না, বরং আমাদের মত রাজনৈতিক অস্থিতিশীল এবং অশান্ত একটা দেশের কোন শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতাকে পুরস্কার দেয়া হয় ভিন্ন কারণে। আর সেটা হলো আমাদের দেশের কাছ থেকে কোন স্বার্থ উদ্ধার করা। সে স্বার্থ বৈষয়িক হতে পারে আবার আদর্শগত ক্ষেত্রে ভিন্ন আদর্শকে দুর্বল করার চেষ্টা হিসেবে হতে পারে। তখন সেটা জাতির জন্য অমঙ্গোল। এ সম্পর্কে রাজনৈতিক দর্শনের স্রষ্টা প্লেটো এবং এ্যরিষ্টটল একই মত পোষন করেন। তারা বলেন, ‘সেই সব রাজনৈতিক শাসক দেশবাসির কাছ থেকে পুরস্কৃত হন না বরং দেশবাসি তার শত্রু হয়ে দাড়ায়, এই কারণে তাদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তারা রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। পক্ষান্তরে দেশে বন্ধুর চেয়ে বিদেশের বন্ধু তাদের যথেষ্ট হয়। বিদেশ তাকে নিরাপত্তা দেয়।’ বিভিন্ন ব্যাখ্যায় প্লেটো বা এ্যরিষ্টটল বলেছেন এরাই মূলত স্বৈরশাসক। বিদেশ থেকে পুরস্কার পাওয়ার অর্থ হচ্ছে দেশবাসি তাদেরকে ক্ষমতায় রাখতে চায় না, কিন্তু বিদেশ তাদেরকে ক্ষমতাসীন রাখে।