somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভ্রমন পর্ব-১(কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকা)

২৮ শে এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ২:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

শেষ থেকেই শুরুটা করছি।
ফের এয়ার এশিয়ার বাজেট কেরিয়ারে করে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। মুলত কম ভাড়ার কারনে এই সব রুটে বিমানের সবগুলো আসন যে পূর্ন হবে তা আগে থেকেই ভেবেছিলাম।
যাবার বেলায় ভীষন অবাক হয়েছিলাম প্রায় দুইশ সিটের এই মাঝারি বিমানের অর্ধেক সিট খালি দেখে।এদের সেই দূর্ভাগ্য অবশ্য আমার মত যাত্রীদের সৌভাগ্য বয়ে এনেছিল-হেসে খেলে হাত পা ছড়িয়ে মালয়েশিয়ার এল সি সি টি বন্দরে এসেছিলাম।এ সি সি টির অর্থ হচ্ছে লো কেরিয়ার কস্ট টার্মিনাল।
মুলত মালয়েশিয়ান এয়ার লাইন্সের অল্প কিছু বাজেট কেরিয়ার কার্গো বিমান আর এয়ার এশিয়ার এইসব বিমানের অবতরন আর উড্ডয়নের জন্য শহর থেকে অনেক দুরের এই টার্মিনালটি ব্যাবহৃত হয়।
ফেরার সময় অব্শ্য আমার ভাবনার সাথে সংগতি রেখে পুরো বিমানটাই কানায় কানায় পূর্ন হল।আমার ছোট ভাই দিনের বেলায় বিমানের জানালা দিয়ে এরিয়াল ফটগ্রাফি করার লোভে বোর্ডিং কার্ড নেবার সময় অনুরোধ করে ডানার সামনের দিকে জানালার কাছের একখানা সিট বাগিয়েছে।লাইনের একটু পিছনের থাকায় আমিও চলে গেলাম লেজের দিকে।আমি আর আমার ছোট ভাই বিমানের পেটে ঢুকলাম সবার শেষে-অভ্যার্থনার পরিবর্তে বিমান বালার আমসে মুখ দেখে দীর্ঘ চার ঘন্টার ক্লান্তিকর এই বিমান যাত্রার ভবিষ্যত ভেবে আঁতকে উঠলাম!
ভিতরে ঢুকতেই দেখি সেই অতি পরিচিত দৃশ্য। সিট ছেড়ে দাড়িয়ে আছে অর্ধেক যাত্রী-ভাবখানা এমন যে বিমান ছাড়ার আগে তাদের বসতে নিষেধ করা হয়েছে। তাদের পাশ কেটে বেরিয়ে যাবার চেস্টারত অন্য যাত্রীদের জটলায় মানব জ্যাম।সেই সাথে চেচামেচী হৈ হল্লাতো আছেই।ধৈর্য ধরে অনেকক্ষনের চেষ্টায় নিজের সিটের কাছে গিয়ে দেখি সেই পুরনো চিত্র। আমার সিট দখল করে আছে অন্য এক বাঙালী ভাই সেই সাথে লাগেজ কেরিয়ার খানা কানায় কানায় পূর্ন।অগত্যা সামনের একখানা কেরিয়ারে হাতের ব্যাগটা ঠেসে ঠুসে সেধিয়ে দিয়ে- আমার সিটে বসা সহযাত্রীর দিকে তাকাতেই লজ্জায় তার মুখটা রাঙা হয়ে গেল।
আমি মুখ খোলার আগেই সে আগ বাড়িয়ে বেশ কাচুমাচু হয়ে বলল,ভাই আসেন-এইটা মনে হয় আপনার সিট। আমি ওই পাশে বসছি।
আমি হাত দিয়ে থামালাম তাকে,
ঠিক আছে অসুবিধা নেই বসেন-আমি এই পাশেই বসছি।
না না বসেন ভাই-আমি ওইখানেই বসছি।
জানালার পাশে বসতে আমার ভাল লাগেনা। আপনি ওইখানে বসেন-এই পাশেই আমার সুবিধে।
আমার কথায় তখন সে একটু ভরসা পেল মনে হয়,এবার একটা সরল হাসি দিয়ে বেশ বিগলিত কন্ঠে বলল, ধন্যবাদ,ভাই মাইন্ড করেন নাইতো?’
আমার কিছু বলার আগেই, এবার মাঝে বসা লোকটা আচমকা বলে উঠল,আমরা সবাইতো একই দেশী-একটু মিলমিশ করে বসলেই হয়।
আমি লোকটাকে এতক্ষন ভাল করে লক্ষ্য করিনি এবার পূর্ন চোখ মেলে তাকালাম তার দিকে।মুখ ভর্তি কাচা পাকা দাড়ি-চেহারা আর পোষাকে দৈন্যতা স্পস্ট।গায় ময়লা একটা শার্ট পরনে লাল সবুজ রঙ্গের অতি জীর্ন একটা স্পোর্টস ট্রাউজার, আর পায়ে ক্ষয়ে যাওয়া রাবারের সেন্ডেল। অবাক হলাম ভীষন!সত্যি কথা বলতে কি এই পোষাকের এটা লোককে বিমানের সিটে বসে থাকতে দেখব বলে ভাবিনি।
আমি সিটে বসতে বসতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনার বাড়ি কোথায়,
প্রতিউত্তরে সে বেশ নিরস কন্ঠে বলল,'টাঙ্গাইল।
আর আমার সিটে বসা সেই ভদ্রলোককে প্রশ্নটা করতেই সোৎসাহের সাথে বলল, আমার বাড়ি ভাই কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে। আপনি কোথায় থাকেন।
আমি তাকি ভাই ঢাকায়-মাঝবয়সী এই লোকটার ব্যাপারেই আমার জানার আগ্রহ বেশী।তাই তাকেই ফের প্রশ্ন করলাম, মালয়েশিয়া এসেছিলেন কেন?
এবারও তেমন ধারা কাটা কাটা উত্তর, কাজ করতে।
কদ্দিন আগে এসেছিলেন?
উনিশ মাস আগে।
এখন দেশে ফিরে যাচ্ছেন কেন।
এবার একটু ঝাঁঝের সাথে বলল,
কাম নাই তো কি করব। এক বছর কাজ কইরা বেতন পাই নাই।ব্রিজের নীচে ঘুমাইলাম চার মাস-এখন চল্লিশদিন জেল খাইটা দ্যাশে যাচ্ছি।
গিয়েছিলেন কি, আদম ব্যাপারীর মাধ্যমে?
হ্যা।
পরিচিত?
হ্যা।
দেশে থাকতে কি করতেন?
চাষ বাস করতাম।
এইখানে এসেছেন কি জমি জমা বেচে।
জমি জমা থাকলেতো বেচব। ধার দেনা কইরা আইছি।
কত টাকা দিয়েছিলেন?
দুই লাখ।
দুই লাখতো অনেক টাকা নাকি?
সে মাথা নিচু করে অস্পস্ট কন্ঠে বলল, হ্যা।
দেশে এই টাকা দিয়ে ব্যাবসা করে কিংবা জমি জমা কিনে চাষাবাদ করে চলতে পারতেন না?
হ পারতাম।
ছেলে মেয়ে আছে?
হ্যা মেয়ে আছে একটা-ক্লাস ফাইভে পড়ে।
বয়স কত হয়েছে?
চল্লিশ পঞ্চাশ (বাপরে বয়স সন্মন্ধে কি ধারনা!)
এই বয়সে কেন বিদেশে আসলেন? প্রতি নিয়ত শুনছেন আদম ব্যাপারীদের খপ্পড়ে পড়ে সবাই সর্বশান্ত হচ্ছে। রেডিও টিভি পত্রিকায় প্রতিদিন কতশত নিউজ আসছে এই নিয় তারপরেও আপনারা ভুল করবেন।
আমার সাথে তাল মেলাচ্ছিল তখন পাশের লোকটা-‘হ্যা ক্যান যে আপনারা এই ভুল করেন?এখন কি ধরাটাই খাইলেন।দ্যাশে গিয়া করবেন কি-টাকা শোধ করতেই তো জীবন যাবে।
এবার আচমকা রেগে গেল মধ্য বয়েসী সেই লোকটা মাথা তুলো চকিতে আমার দিকে চেয়ে চিৎকার করে উঠল-হ্যা হ্যা ভাইজান, সব আমার দোষ। সব আমার ভুল। হাত জোর কইরা মাফ চাচ্ছি। আমারে মাফ কইরা দ্যান।
আমি তার আচমকা এহেন ব্যাবহারে হকচকিয়ে গেলাম।সবাই ঘুরে ঘুরে তাকাচ্ছিল আমাদের দিকে-স্বভাবতই একটু অপমানিত বোধ করছিলাম।
চুপ মেরে গেলাম কিছুক্ষনের জন্য। আমার সিটে বসা লোকটা তখন মুখ খুলল। ব্যাপারটা তার কাছেও বেশ খারাপ লেগেছে।সে আমার মুড ভাল করার জন্য হালকা কথাবার্তা চালাচ্ছিল।আমিও থেমে থেমে উত্তর দিচ্ছিলাম।ধীরে ধীরে পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে এল-মাঝখানের লোকটাকে আমরা বেমালুম ভুলে নিজের মধ্যে খুচরো কথাবার্তা চালাচালি করছিলাম।বিমান ততক্ষনে টেক অফ করেছে। পৌঢ় লোকটা গলা উচিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার খুব চেস্টা করছিল।
আমি প্রথম যাত্রীকে অনুরোধ করে বললাম, আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে উনাকে একটু জানালার পাশে বসতে দিবেন।এ জীবনে তার হয়তো আর প্লেনে চড়ার সৌভাগ্য হবেনা। শেষ বারের মত বিমান থেকে বাইরের দৃশ্যগুলো দেখুক।
সেও মনে হয় এমনই চাচ্ছিল। সানন্দে রাজি হয়ে গেল। আসেন চাচা এইখানে বসেন।আমি মাঝে বসি।
অমন ব্যাবহারের পর আমাদের কাছ থেকে সে এমন মানবতা আশা করেনি।তাই চকিতে চেয়ে চোখের দৃষ্টিতে দুঃখ প্রকাশ করে ধন্যবাদ দিল।
কথা বলছিলাম এই লোকটার সাথে। তিনিও এসেছেন উনিশ মাস আগে। চাকরি করেন-কে এফ সি তে সরবরাহ কারী একটা সসের ফ্যাক্টরিতে।পরিচিত কোন একটা এজেন্সির মাধ্যমে অল্প পয়সাতেই এসেছেন এইখানে। চুক্তি অনুযায়ী তিন বছরের আগে দেশে ফেরায় বাধা ছিল। কিন্তু চোখে ছানি পড়ায় সবাই পরামর্শ দিল দেশে গিয়ে অপসারন করতে। ভেবেছিলেন ছুটি পাবেন না –কিন্তু দরখাস্ত করতেই ছুটি মিলে গেল। মাসের মধ্যিখানে –হাতে কোন পয়সা কড়ি নেই। রুমমেটটা চাদা উঠিয়ে সিকিউরিটির টাকা আর বিমান ভাড়ার ব্যাবস্থা করেছে।কিছুই কেনাকাটা করতে পারেনি। শুধু ছেলের জন্য একটা সস্তা গাড়ি কিনেছে। সেইটে কোলের উপর অতি মমতায় ধরে রাখা-কেরিয়ারে রাখলে পাছে ভুলে যায় এই ভয়ে।
অনাকাঙ্খিত ভাবে আচমকা দেশে যেতে পারছে এই খুশীতে তার মুখ উদ্ভাসিত। কথা বলার ফাকে ফাকে সারাক্ষনই হাসছিল।
বুঝলেন ভাই দেশে ফিরতে পারলেই কোন চিন্তা নাই। আমার আটটা ভাই। সবাই খুব ভালবাসে আমারে।
আমি ভাবছি দুজন মানুষ কতই না সুখ সপ্ন নিয়ে এসেছিল সবাইকে ছেড়ে এই বিদেশ বিভুইয়ে। একই সময়ের ব্যাবধানে তারা আজ ফিরে যাচ্ছে স্বদেশভুমে। খুশীতে একজন উড়ছে ফুরফুর করে প্রজাপ্রতির মত-তার সপ্ন গুলো এখনো বিবর্ণ হয়ে যায়নি-বরঙচ আরো বেশী রঙ্গিন হয়েছে। আর অন্যজনের কি ভয়ঙ্কর ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে। কি নির্মমতা ডিজাস্টার তার দিকে নির্মম থাবা নিয়ে এগিয়ে আসছে সে জানেনা-ভাবতেও হয়ত চায়না। সে শুধু কিছুক্ষনের জন্য দেখতে চায় বিমানের ছোট্ট জানলায় চোখ ডুবিয়ে এই মহাবিশ্বের অতিক্ষুদ্র ছায়াপথের অতি নগন্য একটা সৌরজগতের মাঝারি মানের একটা নীল গ্রহকে। হয়ত তার ধারনা যেখানে রয়েছে শুধু হিংসা হানাহানি প্রতারনা দৈন্যতা আর সুন্দর সপ্নের নির্মম পরিনতি!
এয়ার এশিয়ায় এক বুন্দ পানিও কিনে খেতে হয়।এদের বিমানে চড়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা যাদের নেই স্বভাবতই ব্যাপারটা তাদের খটকা লাগবে। তবে দু-য়েকবার দেখলেই ব্যাপারটা স্বাভাবিক ঠেকবে। আকাশ পথে দাম যেখুব বেশী তা কিন্তু নয়।দেড় রিঙ্গিতের পানি মাত্র পাচ রিঙ্গিতে কিনতে হয়। ম্যাগাজিনের লোভনীয় খাবারের ছবি দেখে অর্ডার দিয়ে মাঝ মধ্যে মাথার চুল ছিড়তে হয় এই আর কি।মাগনা খাবার দিলে যাদের তিনবার খেলেও পেট ভরে না তারাই কিন্তু এখানা পান ভোজন না করে দিব্যি চার পাচ ঘন্টা কাটিয়ে দেয়। তবে তথাকতিথ মাগনা খাবার বাবদ অন্য বিমান সংস্থাগুলো যে পরিমান টাকা অগ্রিম নিয়ে নেয় তার তুলনায় এইটে অতি সস্তা!
খাবারের ট্রলি নিয়ে এয়ার হোস্টেজদের এগিয়ে আসার শব্দে সে বাইরের পৃথিবী দেখার বাসনা আপাতত ক্ষান্ত দিয়ে উটের মত গলা উচু করে ক্লান্ত চোখ দুটো দিয়ে প্রচন্ড আকুতি নিয়ে অপেক্ষায় রইল কাছে আসার।ডানা থাকলে হয়তো সে তখুনি উড়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়ত সেই ট্রলির উপরে ক্ষুধার্ত শকুনের মত।অবশেষে সেই ভয়ঙ্কর প্রতিক্ষার অবসান ঘটিয়ে ট্রলিটা এসে ভিড়ল আমাদের সিটের পাশে।সে সবার আগেই হাত বাড়াতে গিয়েই আবার কি ভেবে স সঙ্কোচে হাতখানা গুটিয়ে নিল।আমার পাশের যাত্রী ছোট্ট এক বোতল জুস নিয়ে টাকা বাড়িয়ে দিল দেখে তার সে কি বিস্ময়।
লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে করুন স্বরে বলেই ফেলল ভাই,এইখানে খাবার কি কিনে খাইতে হয়?
দ্বীতিয় যাত্রী বেরসিক হাসি দিয়ে বলল,হ্য-আপনে জানেন না?
দুঃখে হতাশায় ক্লান্তিতে লোকটার মুখাবয় ভেঙ্গে চুরে বিকৃত হয়ে গেল।
...
আদম ব্যাপারী তাকে ভুয়া ডাক্তারী সার্টিফিকেট দিয়ে মালয়েশিয়া পাঠিয়েছিল। এখানে এসে ফের ডাক্তারী পরিক্ষায় অনুত্তীর্ন হওয়ার কারনে মালিক তাকে কাজ দিতে রাজি হয়নি।সে বিক্রি হয়ে যায় অন্য এক মালিকের কাছে। সেখানকার কঠিন কাজের ধকল সহ্য করতে না পারায় সেই মালিক আবার বিক্রি করে দেয় আরেকজনের কাছে। এইভাবে সে হাত বদল হয় তিনবার। শেষ চাকরিটা জুটেছিল জনমানব শুন্য গহীন অরন্যে পাম ট্রি পরিচর্যার কাজে। জঙ্গল পরিস্কার,আগাছা সাফ,সার পানি দেয়া ছিল তার নিত্যদিনের কাজ।ছয়মাস হাড়ভাঙ্গা খাটুনির বিনিময়ে তার ভাগ্যে জুটেছিল দুইবেলা খাবার আর সাকুল্যে বার হাজার টাকা। নিজে কপর্দক শুন্য হয়ে সেই বার হাজার টাকা সে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিল।তার পর থেকে তাকে আর কোন বেতন দেয়া হয়নি। বেতনের জন্য বারংবার মালিকের দুয়ারে ধর্না দেয়ায় তার ভাগ্যে জুটেছিল নির্জন কারাবাস।দিনের পর দিন সেই অন্ধকার কুঠুরিতে মালিক তাকে আটকে রেখেছিল।সারাদিনে একবেলা খাবার তার ভাগ্যে জুটত।সে কি কঠিন জীবন-বলতে বলতে হাউমাউ করে কেদে ফেলল সে।
অবশেষে একদিন ছাড়া পেল সে শুধুমাত্র পরনে থাকা সেই জরাজীর্ন পোষাকে।নিজের পোষাক-আষাকতো দুরের কথা পাসপোর্টটা পর্যন্ত দেয়া হয়নি তাকে।হাতের মুঠোয় ধরা ছিল শুধু একখানা সেলফোন তাও জিরো ক্রেডিটের। অভুক্ত জীর্ন ক্লান্ত বহু কষ্টে সে এসে পৌছেছিল কুয়ালালামপুরে।
অবশেষে কোন এক বাঙ্গালী সহৃদের সহায়তায় সে গিয়ে পৌছায় বাংলাদেশ এম্বাসীতে।
এম্বাসীর এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তার পায়ের উপর আছড়ে পড়ল গিয়ে, ভাইজান আমারে বাচান। আমি আর এইদেশে এথাকবনা।আমারে দেশে পাঠায় দেন।তার সেই করুন আর্তির বিনিময়ে কোন সাহায্যতো পায়ইনি উল্টো খেতে হয়েছিল গলাধাক্কা!
এম্বাসীর আশে পাশে তখন কয়েক'শ বাঙ্গালীর ভিড়। প্রায় অভুক্ত অর্ধ উলঙ্গ সব আদমেরই তখন একই দশা!পরিচয়পত্র বিহীন সব হারানো সেই মানুষগুলো মরে যাবার আগে একবার তাদের প্রিয়জনের সান্নিধ্য পেতে চায়-ফিরে যেতে চায় তার প্রিয় জন্মভুমিতে।
পরের চার চারটা মাস সেই শ’চারেক মানুষ কি অবর্ননীয় দুঃখ কষ্ট কায়-ক্লেশে সেই এম্বাসীর সামনের একটা ব্রীজের নীচে দিন যাপন করেছে তার বর্ননা আর নাইবা করলাম।মফিজ নামের সেই অর্ধবয়সী সবহারানো সেই লোকটাও বলতে চায়না সেইসব দুঃখের দিনের কথা-শুধু বললেন ভাইরে এর থেকে অনেক আরামে ছিলাম সেই জেলখানায়। একবেলা খাবারতো পাইতাম। উপায়ান্তর না দেখে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষা করছি।
তবুও কিন্তু এতগুলো লোকের আহাজারী সেই সব অর্বাচীন কর্মকর্তাদের কর্ণকুহরে পৌছায়নি।
তার ভাষায়;
ক্ষুধার্থ পেটে ঘুম আসছিলনা।তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে মরার মত নির্জিব হয়ে পড়ে ছিলাম সবাই। আচমকা শত শত গাড়ি আর সাইরেনের শব্দ।চোখ মেলে দেখি যেন সারা কুয়ালালামপুরের পুলিশ আমাদের ঘিরে ফেলেছে। এত হাজার পুলিশ আমি দেখি না কখনো। প্রতিটা লোকের জন্য কমপক্ষে তিন চারজন করে।পালানোর কোন সুযোগ ছিলনা।
ফের জেলে। চল্লিশ দিন জেল খানায় ছিলাম। সেইখানেও জুটত মাত্র একবেলা খাবার।
আমি জানিনা কে যেন আমার টিকিটখান কইরা দিছে।কালকে ওরা কইল আজকে আমারে দেশে পাঠায় দিবে।
আজকে সকালে পুলিশের গাড়িতে করে এয়ারপোর্টে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মিটিয়ে তাকে প্লেনে তুলে দিয়ে হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে গেছে। দলিলের মত বাঙলাদেশী এম্বাসি কতৃক প্রাপ্ত সেই কাগজখানা এখন তার একমাত্র সম্পত্তি।সেইটেই সে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে আছে। সামনের সিটের পকেট থেকে যাত্রীদের বমি করার একটা আনকোড়া প্যাকেট বের করে অনেক্ষন উল্টে পাল্টে দেখে অনুচ্চ কন্ঠে অনুমতি নেয়ার ভঙ্গীতে আমার দিকে চেয়ে বলল,ভাই আমি কি এই প্যাকেটটা নিতে পারি-এর মধ্যে এই কাগজ গুলা ঢুকাইতাম।
ভাবখানা এমন যে আমিই এই প্যাকেটটার মালিক- আমার ইশারার উপরেই নির্ভর করছে এই মহামুল্যবান জিনিস হস্তগত করা না করা।
আমি 'হ্যা' বলাতে সে ভীষন খুশি হয়ে কি পরম যত্নে সেই সেই কাগজগুলো ভাজ করে প্যাকেটটাতে রাখল। অতিতুচ্ছ বমির প্যাকেটের এমন সদগতি আর আর এইজন্মে মনে হয় কেউ দেখেনি।
মালয়েশিয়ান পুলিশ তার মোবাইল ফোনখানা পর্যন্ত কেড়ে রেখে দিয়েছে।সেইটের অর্থনৈতিক মুল্য মনে হয় এই বমির প্যাকেটের থেকেও কম। কেননা ক্ষুধার তাড়নায় অনেকবারই সেই সেলফোন খানা বিকোতে চেয়েছে কেউ একবেলা খাবারের বিনিময়েও কিনতে চায়নি!
আপনি এয়ারপোর্ট থেকে কোথায় যাবেন-বাড়িতে?
না আগে সেই আদম ব্যাপারীর অফিসে যাব মতিঝিলে। তারে আমার চেহারাটা দেখাইতে হবে না?
যাবার ভাড়া আছে?
না।
তাহলে যাবেন ক্যামনে?
ভিক্ষা করার অভ্যাসতো আছেই। দেখি কারো হাতে পায় ধইরা বাসের ভাড়াটা জোগাড় করতে পারি কিনা।
আমি আর কোন কথা বলিনি। আমার থেকে অবস্থা তখন তার বিশেষ ভাল না।তিনটে দেশ ঘুরে হাতে রাখা শেষ ডলারটাও খরচ করে এসেছি।ট্রাভেল আর ক্রেডিট কার্ডে কিছু টাকা পয়সা আছে -কিন্তু এই আকাশ পথে সেটা মুল্যহীন।ওয়ালেটের এককোনায় অবশ্য কিছু বাংলাদেশী মুদ্রা আছে -এয়াপোর্ট থেকে বাসায় ট্যাক্সি ভাড়ার জন্য রাখা।তবে আমার হাতে অনেক অপসন-ছোট ভাইয়ের কাছে কিছু টাকা আছে বলে মনে হয় না হলে বাসায় ফেরার পথে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নিতে পারি কিংবা ভাড়াটা বাসায় গিয়েও দিতে পারি।যাহোক বেশী নাটকীয়তা না করে চুপচাপ বসে রইলাম তখন।বিমান ল্যান্ড করার পরে সবাই যখন নামার জন্য হুড়োহুড়ি করছে সেই ফাকে সেই সামান্য কটা টাকা আর পার্সোনাল কার্ড অতি সংকোচে তার হাতে গুজে দিয়ে বললাম,-আপাতত সেই আদম ব্যাপারীরর অফিসে যান-সমস্যা হলে আমাকে ফোন দিয়েন, দেখি কিছু করতে পারি কি না।আমি ভেবেছিলাম ব্যাস্তার ভান করে কেটে পড়ব তখুনি। কিন্তু সে সুযোগ আমাকে না দিয়ে খপ করে হাত খানা ধরে হাউমাউ করে কেদে ফেলল-‘ভাইজান আমারে একখান চাকরি দিবেন?’
ভীষন বিব্রত আমি প্রতিউত্তরে কিই বা বলার ছিল? শুধু সান্তনার স্বরে নিচু কন্ঠে বললাম,চেস্টা করব- আপনি আমার সাথে যোগাযোগ কইরেন।
বিমান থেকে নামার পরে তাকে আর কোথাও খুজে পেলামনা। ভেবেছিলাম অর্থাভাবে যে ভিক্ষে করতে পারে নিঃস্ব সেই মানুষট খড়কুটো ধরে বাঁচবার তাগিদে অবশ্যই আমার কাছে ফোন করবে। ফেরার পথে ট্যাক্সিতে বসে তাকে এড়াব কিভাবে,কলুষিত আর সংকীর্ন মন আমার সেই ফন্দি আটছিল।তবে না,দারিদ্রতা মানুষকে সব সময় অভব্য কিংবা নির্লজ্জ করে না। দু সপ্তাহ হতে চলল সে আর আমার সাথে যোগাযোগ করেনি- কখনো করবে বলে মনে হয়না।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে এপ্রিল, ২০০৯ রাত ৮:১৪
১৭টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিজয়ের কবিতা

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৫৪



বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, লক্ষ প্রাণে লেখা বিজয়ের
সেই সোনালি অক্ষর,
দিকে দিকে শুনি জয়ধ্বনি বাংলাদেশের নামে, এই
স্বাধীনতা কেনা রক্তের দামে;
হৃদয়ে হৃদয়ে বাজে মুক্তির শত গান, ডিসেম্বরে
পেয়েছি আমরা বিজয়ীর সম্মান;
মার্চের সেই অমর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৫

বন্ডাইর মত হত্যাকাণ্ড বন্ধে নেতানিয়াহুদের থামানো জরুরি...

বন্ডাই সৈকতের হামলাস্থল। ছবি: রয়টার্স

অস্ট্রেলিয়ার সিডনির বন্ডাই সৈকত এলাকায় ইহুদিদের একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সমবেত মানুষের ওপর দুই অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী অতর্কিতে গুলি চালিয়েছে। এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমাণ নন বলা কুফুরী

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১৪



সূরাঃ ২ বাকারা, ২৫৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৫৫। আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোন ইলাহ নেই।তিনি চিরঞ্জীব চির বিদ্যমাণ।তাঁকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না।আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজয়ের আগে রাজাকারের গুলিতে নিহত আফজাল

লিখেছেন প্রামানিক, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩


ঘটনা স্থল গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি থানার উড়িয়া ইউনিয়নের গুণভরি ওয়াপদা বাঁধ।

১৯৭১সালের ১৬ই ডিসেম্বরের কয়েক দিন আগের ঘটনা। আফজাল নামের ভদ্রলোক এসেছিলেন শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে। আমাদের পাশের গ্রামেই তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫৫ বছর আগে কি ঘটেছে, উহা কি ইডিয়টদের মনে থাকে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৫৮




ব্লগের অনেক প্রশ্নফাঁস ( Gen-F ) ১ দিন আগে পড়া নিউটনের ২য় সুত্রের প্রমাণ মনে করতে পারে না বলেই ফাঁসকরা প্রশ্নপত্র কিনে, বইয়ের পাতা কেটে পরীক্ষার হলে নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×