somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মদন বাবুর্চি

২৮ শে মে, ২০০৯ দুপুর ১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাড়ে ছ’ফুটের বেশী লম্বা বিশাল দেহি দৈতাকৃতির বিড়াল চোখ বা ক্যাটস্ আই এর লাল সোনালীতে মেশানো বিরল কেশী আমাদের ক্যান্টিনের সেই রুশ 'প্রোভর' যার বাংলা অর্থ দাড়ায় পাচক বা বাবুর্চি- নাম ছিল ইগর।
প্রথম প্রথম এমন দৈত্যের আশেপাশ দিয়ে হাটতেও ভয় পেতাম!
খেতে বসলে মাঝে মধ্যে মোলায়েম ভঙ্গীতে হেলে দুলে টেবিলের কাছে এসে সহাস্যে রান্নার তারিফ শুনতে চাইলে আমরা তার সেই অখাদ্য গলধঃকরন বিমর্ষ কন্ঠে ক্লিষ্ট হেসে বলতাম 'খাসা' যার একটাই রুশ প্রতিশব্দ জানতাম তখন -খারাশো’।
সেই শুনে তার কি খুশি! চোখ পিট পিট করে সারা কপোলে লাল আভা ছড়িয়ে ফিচ ফিচ করে হাসত।
ওদিকে আমাদের রাগে পিত্তি জ্বলত! মনে মনে বলতাম,শালা খাচ্চর কি রেধেছিস! এই গু মুত মানুষ খায়?’
অবশ্য এক পক্ষ না যেতেই বুঝে গেলাম দেখতে দৈত্যের মত হলেও সে একদম সহজ সরল সাধা সিদে মাটির মানুষ। আমরাতো সব বঙ্গ দেশীয় হনুমান। বুঝতে পেরেই কাধে উঠে তার কানমলা শুরু করলাম।
দুদিনেই তার নতুন নামকরন হয়ে গেল ‘মদন’।
মানে জিজ্ঞেস করতেই বললাম, আমাদের দেশে খুব ভাল 'প্রোভর'কে মদন বলি। এই শুনে সেকি খুশী! দন্তপাটি বের করে যেন কান পর্যন্ত হাসতে লাগল।
ক্যান্টিনে গিয়েই হাঁক ছাড়তাম ‘মদন’।
সাদা এপ্রোন পরা 'ইগর' তখুনি সব কাজ ফেলে পোষা কুকুরের মত ল্যাজ নাড়তে নাড়তে এসে হাজির!
-কি খাবি তোরা?
আমাদের তখন একেক জনের একেক আব্দার। ফরমায়েসের ঠেলায় তার জিভ বেরিয়ে যাবার যোগাড়!
তবে সে কি রান্নার ছিরি। এত বলে কয়ে পরামর্শ আদেশ অনুরোধের বিনিময়ে যে হস্তিডিম্ব সে প্রসব করত তা গিলতে গেলে খাবার ইচ্ছে লোপ পেত।
সেই বেচারারই বা দোষ কি-যা পারবে তাইতো করবে।
তবে আগ্রহ আর চেস্টা কমতি ছিলনা তার।
ওর এই কষ্ট দেখে( আসলে ওর কষ্ট-ফষ্ট আমরা ভাবতাম না। রান্না ঘরে অল্প বয়েসী তরুনীরা রান্না শিখতে আসতে, তাদের একটু ঘনিষ্ঠ হওয়ার আশায়) আমরা কয়েক সহৃদবান(!)যারা হেঁসেলের আশেপাশে উঁকি ঝুকি দিয়ে মা খালার রান্না দেখেছি তারাই এগিয়ে গেলাম তাকে সাহায্য করতে।
সেখানে গিয়ে নতুন করে তাকে রান্না শেখাতে লাগলাম। প্রথম ক'দিন মহা উদ্যোমে সে বাংলাদেশের বিকৃত রান্না শিখেছে । কিন্তু আমাদের জালায় ত্যাক্ত বিরক্ত হয়ে ক'দিন যেতই পুরো রান্না ঘরের ভার আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে পালাল।
রুশ ছাত্ররা লাঞ্চ সেরে নিত সাড়ে বারটা থেকে দেড়টার মধ্যে! তার পরে আমাদের পালা। তখন পুরো রান্না ঘর আর ডাইনিং আমাদের কব্জায়।
মদন রান্নার সরঞ্জাম আর উপকরন দিয়ে রাধুনীদের সাথে গল্প জুড়ে দিত।
অবশ্য রান্না শেষে পরিচ্ছন্ন ঘরের নোঙরা আর বেহাল দশা দেখে ভিমড়ি খেত! তবুও তার কোনদিন ম্লান মুখ দেখিনি। হেসেছে সে প্রান খুলে। সবাই যেন আমরা তার দুরন্ত অবুঝ সন্তান।
একদিন যথাসময়ে ক্যান্টিনে গিয়ে দেখি অবাক কান্ড! আগে থেকেই থালাবাটি সাজিয়ে বসে আছে ইগর। মুখে তার ফিচেল হাসি। কি ব্যাপার?
ভীষন লাজুক হেসে সে গড়বড় করে যা বলল, তার অর্ধেকও বুঝিনি। তবে এইটুকু বুঝলাম। সে নতুন রান্না শিখেছে, যাকে বলে উজবুকি পোলফ। এ ধরনের খাবার নাকি এশিয়ানরা বেশ পছন্দ করে।তাই আমাদের জন্য এক হাড়ি রেধেছে।
-যাও ভাই তাহলে নিয়ে আস তোমার সেই উজবুকি পোলফ।
গরম গরম গাজরের পেস্ট দিয়ে তৈরি খিচুরি টাইপের পোলফ(পোলাও) আর মাখন দিয়ে ভাজা মুরগি খেতে মন্দ ছিলনা। খেলামও পেটপুরে।
আর খাবার শেষে প্রসংশার বন্যায় হাসতে হাসতে মদনের চোখ ভিজে গেল।
কিন্তু হোস্টেলে যেতেই বাধল বিপত্তি! গুরু ভোজন কিংবা অন্য কোন কারনে টয়লেটে চুটোছুটি শুরু হয়ে গেল দু-চারজনের। বাকি হনুমানগুলো এই দেখে শুরু করল লাফঝাপ। ক্লাস ফাকি দেবার সুযোগ একটা পাওয়া গেছে-রে! আমরা সবাই কাল সকালে ডায়রিয়ায়(!)আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হব।
সকালের ক্লাসে সব বিদেশী ছাত্র অনুপস্থিত! ভয়াবহ ব্যাপার! এমনতো কখনো হয়নি। হোস্টেলের বুড়ি গার্ড মহিলার কাছে ফোন করলে খবর গেল অসুস্থ সবাই।
ভীষন আতঙ্কিত হয়ে ছুটে আসল একজোট হয়ে সব টিচার থেকে শুরু করে ডিন পর্যন্ত! ওদের দেখে আমাদের অসুস্থতা বেড়ে গেল কয়েকগুল!
লেপ কাথা মুড়ি দিয়ে কোকাচ্ছি-আর টলতে টলতে এক এক করে বাথরুমে ছুটছি।
একি কান্ড! পুরো হোস্টেল জুড়ে ডায়রিয়া! ক্যামনে সম্ভব?
সবার ধারনা হল এটার পিছনের একমাত্র কারন ফুড পয়জনিং। শুরু হল তদন্ত।
অবশেষে সব দোষ গিয়ে পড়ল মদনের সেই পোলাওয়ের ঘাড়ে।
মদনকে দাড় করানো হল আসামীর কাঠগড়ায়। চাকরিটা তখনকার মত টিকে গেলেও তাকে প্রবাসীদের হেঁসেল ঘরের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হল।
আর আমাদের খাবারের ব্যাবস্থা হল ইউনিভার্সিটির সরাসরি তত্বাবধানে হোস্টেলের নীচের তলায় অবস্থিত অন্য এক ক্যান্টিনে-যেখানকার খাবার বরাদ্দ ছিল শুধুমাত্র অসুস্থ ছাত্রদের জন্য। যেই ক্যান্টিনের রান্নার খুশবু যাওয়া আসার পথে আমাদের খিদেকে কয়েকগুন বেশী উসকে দিতে সাহায্য করত।(এখানকার রান্নার তারিফ অন্য একদিন করব)
...
মদন বা ইগরের সাথর আর একবারমাত্র দেখা হয়েছিল পুরোনো সেই ক্যান্টিনে। মদন বলে ডাকতেই সে চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখাচোখি হতেই দৃস্টি সরিয়ে নিল।
ঠোটের কোনে নেই তার সেই সরল শিশুসুলভ হাসি। আগের থেকে যেন রোগা হয়ে গেছে। সেই লালচে সোনালী চুলের বোকা চেহারার বিশাল মানুষটার দুচোখ জুড়ে শুধু ভয়ানক বিষন্নতা।
৯টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×