মদ ধরেছি সবেমাত্র তখন। নতুন মদ খোরেরা নাকি বেশী মদ খেতে পারে। মনের জ্বালা মেটাতে আস্ত দু-লিটারের বোতল নিয়ে বসতাম। কিন্তু দু-চার পাত্তর পেটে পড়লেই ভেদ বমি শুরু হত! মনে হত মরে যাচ্ছি। ভাবতাম মরে গেলেই বেশ হয়। এই দুঃসহ অবস্থা থেকে যেন মৃত্যুই একমাত্র মুক্তির পথ! আত্মহত্যার কথাও ভাবতাম মাঝে মধ্যে!
ঠিক তখন আমাদের সেই বারোয়ারী বাড়িতে মইনের আগমন।ফুল হাতা শার্ট আর জিন্স পরা বেশ রোগা লম্বা সেই ছেলেটা দৃস্টি আকর্ষন করত সবার প্রায় কোমড় অব্দি লম্বা ঝাকড়া চুল দিয়ে।
মস্কোতে অবশ্য তখন বড় চুল রাখার ট্রেন্ড। দেশের বাইরে গেলে বাঙ্গালী ছেলেরা তাদের প্রথম লুক চেঞ্জ করে চুল লম্বা করে। তবে তার মত এমন চুল পেতে হলে ভাগ্য লাগে। চুলের প্রতি তার যত্ন-আত্মি দেখে একাধারে বিরক্ত ও বিমোহিত হতাম!
শুনলাম সে নাকি বেশ বড় ডাকাবুকো আদম ব্যাবসায়ী! মস্কো এসেছে নতুন কিছু ব্যাবসায়ীদের সাথে কন্ট্রাক্ট করতে। প্রথমে অবশ্য বিশ্বাস হয়নি। এই ফিগার আর ইনোসেন্ট মার্কা চেহারা নিয়ে এমন ভয়ঙ্কর ব্যাবসা করতে পারে বলে মনে হচ্ছিল না।
মইন কথা বলে কম- বাঁচাল না কিন্তু বাগাম্বর করে।
তার কয়েকটা খারাপ গুন(!) ছিল যা আদম ব্যাবসায়ীদের চরিত্রেরসাথে একদম যা না। একটু বেশী ইমোশনাল। মানুষকে দ্রুত বিশ্বাস করে। উদার আর ভিতু!কেন যেন সে প্রথম পরিচয়েই আমার প্রতি খুব বেশী সদয় হয়েছিল। হয়তো আমার মত এমন খাস বেকার আর অকর্মন্যের রুশ ভাষার প্রতি একটু বেশী দখল দেখে বিমেহিত হয়ে থাকবে। এখানে বলে নেয়া ভাল- সে রুশ ভাষা একদমই জানতা। বহু বছর সে রুমানিয়ায় ছিল তাই ওখানকার রাস্তা ঘাট সে ভাল করেই চেনে। রুমানিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ মলদোভিয়ার অফিসিয়াল ভাষা রুশ হলেও ওদের নিজস্ব ভাষা ছিল রুমানিয়ান। তাই তার ওখানে ঘাটি গাড়তে খুব একটা সমস্যা হয়নি। কিন্তু রাশিয়ানরাতো(আদপে রুশীয় মলদোভিয়ানরা) আর রুমানিয়ান জানেনা। কিন্তু পুরো ব্যাবসায়িক নেট ওয়ার্ক কন্ট্রোল করতে গেলে রুশ ভাষা জানাটা একান্ত জরুরী ছিল। তাই সে চেস্টা চালাচ্ছে খুব- কিন্তু এগুচ্ছে না। তাই ফাঁক পেলেই আমার কাছ থেকে দু-চারটে রুশ শব্দ শিখতে চাইত।
সপ্তা খানেক ছিল সে সেবার মস্কোতে! তার কাজের অবসরে প্রায় সারা দিনমান আড্ডা হত। মদের আসরে বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হয়। আমাদেরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ফিরে যাবার আগের রাতে আচমকা সে আমাকে আমন্ত্রন করল,
- মিশু ভাই যাবেন আপনি আমার সাথে মলদোভিয়ায়?
- গিয়ে কি করব?
- এখানেতো এখন কাজ নাই। চলেন যাই- ছোট্ট ছিমছাম দারুন শহর। পুরো শহরে মাত্র চার পাচজন বাঙ্গালী থাকে। আমার ওখানে কোন সঙ্গী নাই। সামনেই সামার –দুজনে মিলে হেভ্ভী আড্ডা হবে।
- কিন্তু আমার টাকা পয়সাগুলো হাতে না পেলে কেমনে যাই?
- আনিস ভাই এর সাথে আমি আলাপ করেছি।আপনার টাকা দিতে আরো মাস খানেক দেরি হবে। চলেন যাই। আমি যেমনে থাকি আপনি সেরকম থাকবেন।
- আপনিতো লোভ দেখাচ্ছেন রে ভাই! কিন্তু এখন আমার যাওয়া কি ঠিক হবে?
সিদ্ধান্তটা খুব বেশী ভেবে চিন্তে নিইনি। আমার অন্য বন্ধুরাও চাচ্ছিল যে এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমি ওখানে কিছুদিন বেড়িয়ে আসি।রাজি হয়ে গেলাম। দেখি না কি হয়?
পরের রাতেই একদম ঝাড়া হাত পায়ে পকেটে মাত্র শ’পাচেক রুবল নিয়ে এক পোষাকে পাসপোর্টটা বগলে করে মইনের সাথে উঠে বসলাম মলদোভিয়াগামী ট্রেনে!
বন্ধু আমার প্রথম শ্রেনীর স্লিপিং বাথ বুক করেছিল। পাক্কা আটচল্লিশ ঘন্টার জার্নি। গল্প গুজব আর শুয়ে বসে কেটে যাবেখন।
আঠার ঘন্টা বাদে উক্রাইনের বর্ডারে প্রবেশ। তখন ভিসার বালাই ছিলনা। শুধু পাসপোর্ট চেক করে ছেড়ে দিত। গল্পে গল্পে পুরো পথের সময়টা কেমনে যে কেটে গেল টেরই পেলাম না। মলদোভিয়ার রাজধানী কিষিনেও তখন অনেকটা মফস্বর শহরের মত। ছোট ছিমছাম রেল স্টেশন। আবহাওয়া মস্কোর থেকে অনেক সহনীয়। ঠান্ডার তীব্রতা এখানে অনেক কম। স্টেশন থকে ট্যাক্সিতে সোজা মইনের বাড়িতে। সে যদিও সাবলেট থাকে কিন্তু বাড়ির বৃদ্ধা মালিক তাকে ছেলের মতই জানে। ঘরে ঢুকতেই বুড়ি এত বেশী উচ্ছসিত হল যে মনে হল মা তার ছেলেকে অনেকদিন পরে ফিরে পেয়েছে। বড় সড় এক রুম দখল করে মইন থাকে আর অন্য রুমে বুড়ি তার সদা হাস্যময় একটু সরল টাইপের সদ্য যুবক তার নাতিকে নিয়ে থাকে।
এতদিনের সেই ভীড় হট্রগোল আর মদ মত্ত পরিবেশ থেকে এই ছিমছাম ঘরটাতে এসে যেন প্রান ভরে নিশ্বাস নিলাম।
মলদোভিয়া শহরটাকে আমার একদিনেই ভাল লেগে গেল।বুড়ি খাটি মলদোভিয়ান। রুশ আর মলদোভিয়ান ভাষা দুটোই তার আয়ত্বে।আমরা দুজনে দু রকম ভাষায় তার সাথে কথা বলি- সেও উত্তর দেয় তেমনি করে। তার আন্তরিকতা আর স্নেহের পরশে দারুন মুগ্ধ হলাম।
বুড়ির নাতি আলেগ সারাক্ষন সেটে থাকে মইনের সাথে। মইনও তাকে যথেচ্ছা খাটায়। সেও সব কাজ করে হাসিমুখে।
ওদিকে আমাকে নিয়ে মইনের চিন্তার অন্ত নেই। আমি অবশ্য এতটা আশা করিনি। কোন কিছু না চাইতেই হাজির। তার আদর আপ্যায়নের বহরে মাঝে মধ্যে সংকুচিত হয়ে যেতাম।
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞিস করে তোমার জীবনের সব’চে সুখের সময় কোনটুকু। তাহলে আমি নির্দ্বিধায় সর্বাগ্রে রাখব মইনের সাথে থাকা সেই সময়টুকুকে।
তার একান্ত গুরুত্বপূর্ন কাজের সময়টুকু বাদে বাকি পুরোটা সময় আমরা একসাথে ঘুরে গল্প করে খেয়ে ঘুমিয়ে কাটাতাম।সে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে আম জন্য ডুপ্লিকেট কিনত। একটা জামা কিনলে আমার জন্য অনুরুপ একখানা। সামান্য কদিনের বন্ধুত্ব যে কতটুকু প্রগাঢ় ও ঘনিষ্ঠতাপূর্ন হতে পারে তা আমি তখন দারুন ভাবে উপলব্ধি করেছি।
মাঝে মধ্যে অবশ্য নিজেকে তুচ্ছ মনে হত-তার এই ভালবাসা আর আন্তরিকতা বিনিময়ে আমি সামান্যতম উপকার করতে পারছিনা। শুধু স্বার্থপরের মত নিয়েই যাচ্ছি-দেয়ার কোন উপায় নেই।
এমনি করে মাসখানেক কেটে গেল! মস্কো থেকে ভাল কোন খবর পাইনি-আনিস টাকাটা ফেরত দিতে আরো কিছু সময় চেয়েছে। মইনও আমাকে ফিরে যেতে দিতে চাইছে না। বিভিন্ন বাহানা করে শুধু আরো কিছুদিন রেখেদেয়ার মতলব করছে।
হঠাৎ একদিন আমাকে এসে বলল,-মিশু ভাই আপনাকে আমার একটা উপকার করতে হবে?
উপকারের কথা শুনেই আমি ভীষন উৎফুল্ল! যাক তাহলে এতদিন বাদে কিছু একটা করার সুযোগ পেলাম।
-অবশ্যই!কি করতে হবে বলেন?
বলতে গিয়ে সে একটু লজ্জা পেল মনে হয়! এক ঝলক রক্ত খেলে গেল তার মুখাবয়ে।
একটু তালবাহানা করে যা বলল তার সারমর্ম এই দাড়ায়;
এখানে ব্যাবসা করতে হলে তার এখানকার পার্মানেন্ট ভিসাটা খুব জরুরী। আর সেজন্য দরকার বিয়ে করার। বহুদিন ধরেই সে বুড়িকে খোচাচ্ছে; ভাল একটা পাত্রী যোগাড় করে দিতে। অবশেষে বুড়ি নাকি এক পাত্রীর খোজ এনেছে। মেয়ে বেশ সুন্দরী,শিক্ষিতা বয়সও বেশ কম! তবে সমস্যা অন্যখানে। এই মেয়ে নাকি রুমানিয়ান এক বিন্দুও বোঝে না। কি ঝামেলা! মেয়ের সাথে কথা না বলতে পারলে বিয়ে হবে কিভাবে?
মেয়ে নাকি তার বড় বোনকে নিয়ে আগামী সপ্তাহে তাকে দেখতে আসবে! এই প্রথম দেখছি বা শুনছি; সেটেল ম্যারেজে পাত্রী নাকি পাত্রকে দেখতে যায়!
তাদের আদর আপ্যায়নের কোন সমস্যা হবেনা কিন্তু আমি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে সম্পুর্ন আলোচনা আমাকেই করতে হবে। দুজনে দু ভাষায় কথা বলবে আর অনুবাদকের কাজ আমাকেই করতে হবে। আর পরিচয়পর্বটা যেন পোক্ত হয়। এই নিয়ে কয়েকদিন ধরে চলল আমাকে তালিম দেয়ার কাজ।
নিজের সন্মন্ধে যাচ্ছেতাই বাগাম্বর করে শেষে নিজেই লজ্জা পেয়ে বলেন, দেইখেন ভাইরে আমারে ডুবায়েন না!
আমি হেসে তাকে আশ্বাস দেই-ভয় পাইয়েন না। কোন সমস্যা নেই-আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন।
এবার সে মিইয়ে গিয়ে মিউ মিউ স্বরে বলে,‘তা না হয় রাখছি কিন্তু আপনি রুশ ভাষায় আমাকে পচাইলেন না উপরে তুললেন তারতো কিছুই বুঝব না’!
এর প্রতিকার আমার কাছে নেই।
আমি আশ্বাস দিয়ে বলি- এতটুকু ঝুঁকিতো নিতেই হবে।...দ্বীতিয় পর্ব শেষ
আগের পর্বের জন্য Click This Link

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


