somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

'হুজুর'

১৭ ই জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

* সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই গল্পের প্রধান চরিত্রের নামকরন করা হয়েছিল 'হুজুর'!ধর্মীয়-ভাবে কাউকে খাটো করা লেখকের উদ্দেশ্য নয়।
বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা।তাপমাত্রা হিমাংকের প্রায় ত্রিশ ডিগ্রির নিচে।এসে অব্দি সূর্য দেখিনি। দেখার সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয়না।
মস্কোর অখ্যাত একটা হোটেলে আমরা তিন বাংলাদেশী বড় জোর ঘণ্টা ছয়েকের জন্য অবস্থান করছি। সন্ধ্যায় ট্রেন।গন্তব্য এখান থেকে শ’পাঁচেক কিলোমিটার দুরে এক মফস্বল শহরে। প্রথম ভ্রমণ তো বুঝতে পারিনি এখন মনে হয়, বিশ্বের সবচেয়ে ক্লান্তিকর ভ্রমণ বিমান ভ্রমণ। তেরো ঘণ্টা বিমান ভ্রমণ করে আবার ঘণ্টা দশেক ট্রেন ভ্রমণ, একটু কষ্টকরই বটে। বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে ব্যাটারিটাকে রি-চার্জ করে নিচ্ছিলাম।
আমার সঙ্গী অন্য দু’জনও পাশের রুমে বিশ্রাম নিচ্ছে। তন্মধ্যে একজনকে আমার প্রথম থেকেই পছন্দ হয়নি।
যেজন্য বরাবরই সে যথেষ্ট আন্তরিক হবার চেষ্টা করলেও আমি তাকে একটু এড়িয়ে চলছি।তার পোশাক চালচলন কথাবার্তার দৃষ্টিভঙ্গিতে গ্রাম্যতা ও অশালীন। মাঝারী উচ্চতা,গায়ের রং কালোর দিকে,গোলাকার মুখের গড়ন।চেহারায় কোন বিশেষত্ব নেই তবে চোখ দুটি ভয়ঙ্কর কুটিল, হাসলে সামনের দাঁত দুটো ফাঁক থাকায় বিশ্রী লাগে।প্রথম দফায় পরিচয় হওয়াতে নামটা জেনেছি তক্ষুনি।চৌধুরী শাহরিয়ার কবির। কেন যেন মনে হচ্ছে চেহারার সাথে নামের কোন সামঞ্জস্য নেই।
দেশের কথা মনে পড়ছে সেকারণেই মনটা স্বাভাবিক ভাবেই একটু বিষণ্ণ।ঘুম আসছিল না শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম আত্মীয় পরিজন বন্ধুদের কথা।
হঠাৎ শাহরিয়ার কবির আমার রুমে ঢুকে জিজ্ঞেস করল,’আচ্ছা ভাই কইতে পারেন পশ্চিমডা কোন দিকে?’
আমি অবাক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে আছি।ঠিক মালুম হচ্ছে না আঁতকা সে দিক নিয়ে গবেষণা শুরু করল কেন? মুখ ফুটে বেরিয়ে এল,’আমি জানি না।’
সে তার ভয়ঙ্কর এক ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,’জানতাম আপনে কইতে পাইরবেন না। চারদিকে শালার ঘুটঘুইট্যা অন্ধকার।কি দ্যাশে যে আইলাম দুপুর বেলা মনে হয় মাইজ রাইত।এহন আমি নামাজ পড়ি ক্যামনে?’
যেন ফয়সালা দেয়ার দায়িত্ব আমার কথাটা শেষ করে সে এইভাবে আমার দিকে চেয়ে রইল?
এতক্ষণে তার পশ্চিম খোজার রহস্য উৎঘাটিত হল।
’যেহেতু বোঝা যাচ্ছেনা পশ্চিম কোন দিকে সেহেতু আপনি যেকোনো দিক মুখ করে নামাজ পড়তে পারেন। মনে হয় নামাজ সহি হবে।’
(এখানে অন্য কাউকে জিজ্ঞেস করতে সম্ভব ছিলনা-সমস্যা,ভাষাগত।)
প্রতিউত্তরে কিছু না বলে বিড়বিড় করতে করতে চলে গেল। তার ফিরে চলার ভঙ্গী দেখে মনে হল সে চরম হতাশ! হয়তোবা নামাজ না পড়ার পক্ষে সে একটা মোক্ষম যুক্তি দাড় করিয়েছিল,সেই সঙ্গে আমাদের(আমার সঙ্গী দ্বিতীয়জন সহ)বুদ্ধিমত্তা যাচাই করতে চাচ্ছিল। এত সহজেই সমাধান দিয়ে ফেলব সে হয়তো ভাবতে পারেনি।
ঘুম ভাঙ্গল অতি প্রত্যুষে। জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে ক্ষীণ আলোর আভাস পেলাম।সেই আলোয় অনেক্ষন ঘড়ি পর্যবেক্ষণ করে বুঝলাম ভোর পাঁচটার মত বাজে।তার মানে গন্তব্যে পৌছুতে আর বেশী দেরী নেই। ট্রেনের কামরায় আমরা চারজন শুয়ে আছি।চতুর্থ সঙ্গী একজন রাশান গাইড। ইংরেজি যা জানে তাতে ইশারায় কথা বলা শ্রেয়।
কম্বলের আড়াল থেকে শাহরিয়ার প্রশ্ন করল,
-ভাইজান কয়ডা বাজে?’
’পাঁচটা’।
’কি কন?’ বলেই ধড়মড় করে উঠে বসল।’আহ্-আরে! আমার নামাজডা মনে হয় কাজা হইয়া গেল।’ অন্ধকারে আমার দিকে প্রশ্ন,’পশ্চিম বোঝা যায়?’
’নাহ্।চারিদিকে অন্ধকার।’
’ইস্‌শি রে—।এই দেশে ফজরের নামাজের সময় কহন হয় এইডাও-তো জানি না!’
মহা বিরক্তি নিয়ে সে তড়িঘড়ি করে অজু করতে গেল।
সৌভাগ্য ক্রমে সেদিন সকালে ঘণ্টা খানেকের সূর্য উঠেছিল।জন্ম লগ্ন থেকেই আমরা জানি’পূর্ব দিকে সূর্য উদয় হয় আর পশ্চিমে অস্ত যায়।’সেই থিউরির উপর সে ভর করে সে হিসেব কষে পরদিন থেকে মহা সমারোহে পশ্চিমে কেবলা মুখী হয়ে নামাজ পড়া শুরু করল।
ক’দিন বাদে...
তদ্দিনে সবাই তাকে’হুজুর’ নামে ডাকা শুরু করেছে। সেও দারুণ আপ্লুত এমন সম্মানিত নাম পেয়ে! এই নামে তাকে সন্মোধন করলেই সে লজ্জানত হয়ে মুচকি মুচকি হাসে। রুমমেট লিটন একদিন বিকেলে হোস্টেলের সবাইকে ডেকে বিশাল জানালার পাশে দাড় করিয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখাল।হুজুর গম্ভীর মুখে সেটা প্রত্যক্ষ করে মুখ কালো করে নির্বাক হয়ে বসে রইল।
-কেন কারণটা বলি; মুল রাশিয়ার অবস্থান উত্তর গোলার্ধের কাছে । পুরো শীতকালে সেখানে কদাচিৎ সূর্যের মুখ দেখা যায়। তাও আবার বড়জোর কয়েক ঘণ্টার জন্য। যেদিন আবার সুয্যিমামা ঘন কুয়াশা আর মেঘের আড়াল থেকে তার লাজ রাঙ্গা মুখ প্রদর্শন করে সেদিন অন্য সবার মুখ কালো হয়ে যায়। তার মানে বাকী কদিন ঠাণ্ডার প্রকোপ বেড়ে যাবে। আর সূর্যও সেখানে চিরাচরিত উদয় অস্তের রীতি মেনে চলেনা। উত্তর দিকে উদয় হয়ে একটু সামনে গিয়ে উত্তরেই ঢলে পড়ে।
আমাদের শাহরিয়ার সাহেব সূর্য উদয় ও অস্ত একদিকেই হতে দেখেছেন।স্বল্প বুদ্ধির সেই ছেলেটার স্বভাবতই এখন পাগল পাগল দশা।মাথার নাট বল্টু সব ঢিলা হয়ে গেছে।
অকস্মাৎ তার থলে হাতরে গুপ্তধনের মত বের করল একটা কম্পাস।এতদিনে হয়তো এটার কথা ভুলে গিয়েছিল।একাকীই সেটা নিয়ে সে বসে পড়ল দিক নির্ণয়ের জন্য ঘন্টা খানেক গভীর চিন্তা ও মনোনিবেশ ও সশব্দে রাশিয়ার চৌদ্দ গুস্টি উদ্ধার করে পশ্চিমের ঠিকানা খুঁজে পেল(আমার ধারনা সে কম্পাস দিয়ে দিক নির্ণয় করতেও জানেনা)।প্রত্নতত্ত্ববিদ-দের মত কয়েক সহস্র বছরের প্রাচীন
সভ্যতা আবিষ্কারের আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে সে সদম্ভে বুক ফুলিয়ে বলল সবাইকে
তার আবিষ্কারের কথা। সবাই মুচকি হেসে তাকে বাহবা দিল। তার ধারনা এই বুদ্ধি আর কারো মাথায় খেলত না।
তার পশ্চিম আবিষ্কারের সপ্তাহ যাপন করা আর হোল না।ফাজিল লিটন তার বন্ধু স্বপনের প্ররোচনায় বিশাল এক ম্যাপ মেলে তাকে আমন্ত্রণ করল নতুন কিছু দেখানোর জন্য।
শাহরিয়ার হেলে দুলে তাদের কাছে এসে বলল,’কন কি কইবেন?’
লিটন গম্ভীর মখে বলল,’আইচ্ছা হুজুর কন দেখি নামাজ পশ্চিম দিকে ক্যান পড়ে?’
এবার আর তাকে আটকানো গেলনা।
’কাবা শরীফ পশ্চিমে তাই ওই দিকে নামাজ পড়ার নিয়ম।’যেন সবাইকে দারুণ এক মাসলা শোনাল, এইভাবে সে সবার দিকে ঘুরে তাকাল।
লিটনের মুখে এক ঝলক ক্রুর হাসির বিদ্যুৎ খেলে গেল।সে এই মওকাই খুঁজছিল।
’তাইলে এই দেখেন।’সে হুজুরকে ম্যাপ দেখাল।’এইটা বাংলাদেশ।ঠিক কিনা?’প্রশ্ন করে সে তার মুখের দিকে তাকাল।
’হ।’
’আর এইটা মক্কা।কাবা শরীফ মক্কায় তো নাকি?’
শাহরিয়ার যেন তার চালাকি ধরতে পেরেছে।ঘাড় ঘুড়িয়ে সবার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিল।তার মানে’আমারে ছাগল পাইছস।কাবা শরীফ মক্কায় এইটা কেডা না জানে!’
লিটন ম্যাপের আরও কাছে ঝুঁকে গেল। ম্যাপের দিক নির্দেশ করে বলল,’এইটা যদি পুব হয় তাইলে এটা পশ্চিম? কাবা শরীফ আমাদের দেশের পশ্চিমে সেইজন্যে আমরা পশ্চিমে নামাজ পড়ি। কিন্তু এইদিকে তাকান?
তার এলোমেলো কথাবার্তা হুজুর বুঝতে পারছে না তবু অনিচ্ছা সত্বেও লিটনের নির্দেশ করা হাতের অঙ্গুলির দিকে তাকাল।
’এইটা হইল রাশিয়া আর আমরা আছি এইখানে।দেখেন-তো কাবা শরীফ আমাদের কোন দিকে? দক্ষিণে না। তাইলে ... ? বলেই সে হেসে ফেলল।
তারপরের ঘটনা বর্ণনা আর নাই করলাম। তবে রাগের মাথায় সেদিন রাশিয়া আর নামাজের উদ্দেশ্যে অশ্রাব্য গালিগালাজ দিয়ে সে নামাজ ছেড়ে দিয়েছিল।
বি:দ্র: প্রথমেই আমরা বুঝেছি ধর্ম পালন করত সে লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। আর পশ্চিম কোনদিকে তা আমরা দ্বিতীয় দিন থেকেই জানতাম। নতুন পুরাতন ছাত্র মিলে সবাই তাকে নিয়ে মজা করার জন্যই আগে থেকে জানাই-নি ।


০২.চৌধুরী শাহরিয়ার কবির হুজুর নামের আড়ালে একসময় হারিয়ে গেল।
এমনকি ইন্সটিটিউটের টিচাররা পর্যন্ত তাকি হুজুর নামে ডাকতে শুরু করলেন।
এখন তার বেশবাসে এসেছে আমূল পরিবর্তন। খাটো পাজামা আর লম্বা পাঞ্জাবী ছেড়ে জিনস টি সার্টে তাকে কিম্ভুত লাগে। মুখে সেই অগোছালো দাড়ি গোঁপের জঙ্গল নেই-এটাতে অবশ্য চেহারায় আলগা একটা শ্রী এসেছে।
তবে চাহনি হয়েছে আরও ক্রুর! এখন দেখি মাঝেমধ্যে কায়দা করে সিগারেটেও টান দেয়। মদটাও ধরতে চেয়েছিল তবে তার বিটকেল গন্ধ সহ্য হয়নি আর খেলেই নাকি বমি পায়।
তার পরেও জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একসময় হয়তো মদ ও পানির পার্থক্য বুঝবে না। কোন পূজা পার্বণ অথবা মিথ্যে ফাঁদা জন্মদিনে আমাদের এখানে কালেভদ্রে আসা দুচার জন বান্ধবীদের দিকে সে এমন ভয়ঙ্কর ভাবে চাইত যে,
‘সেই কুমারীদের তাৎক্ষনিক গর্ভবতী হয়ে যাওয়া অসম্ভব ছিল না।‘(লিটনের বয়ান)
ততদিনে আমরা ভাষা সমস্যা কিছুটা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি কিন্তু সে যে অবস্থানে ছিল তার থেকে মনে হয় দু’পা পিছিয়ে গেছে । রুশতো দুরের কথা বাংলা ভাষা নিয়ে তখনও সে হিমসিম খাচ্ছে। নকল সার্টিফিকেট নিয়ে পড়তে যাবার এত দুর্গতি সে আগে বোঝেনি ।শিক্ষকরা বুঝে ফেলল,তার প্রতিভা।
কিভাবে যেন তারা টের পেলেন নবাগত এই ছাত্রটি ইংরেজীতো দুরের কথা তার মাতৃভাষাও ভাল মত জানেনা।প্রথম ব্যাচ থেকে মাস-খানেকের মধ্যেই তার এক-পর্ব ডিমোশন হল।আমাদের অবাক করে দিয়ে জুনিয়র ছাত্রদের সাথে সে মহা আনন্দে ক্লাস করতে লাগল।কিন্তু দুর্ভাগ্য তার পরবর্তী তিন মাসে আরও দু-দু’বার ডিমোশোন হল। আমরা যখন প্রত্যয়-সমাস আত্মস্থ করছি তখনও সে রুশ বর্ণ নিয়ে হিমসিম খাচ্ছে।
অবস্থা বেগতিক দেখে ডিপার্টমেন্ট ডিন তাকে আলাদা কোচিংয়ের ব্যবস্থা করলেন। দায়িত্ব দেয়া হোল আমাদের সবচেয়ে সুন্দরী শিক্ষিকা (সম্ভবত সেই ইন্সটিটিউটের) লারিসা আলেকজান্দ্রাকে।
এই খোশ খবর শুনে তিনি মাথা চাপড়াতে লাগলেন- আর হুজুরের যেন খুশী ধরে না! পড়ালেখায় এত দ্রুত অবনতি না হলে এই সুযোগ কখনো আসতো? দুর্দান্ত বাজে ফর্ম-এর জন্য তাকে এই্ পুরস্কার দেয়া হয়েছে।
তার এই সৌভাগ্যে অন্যান্য ছাত্ররা কিছুটা যে ঈর্ষান্বিত এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।সে সবাইকে উৎসাহ যোগাল,তার মত এমন পারফরমেন্স দেখাতে পারলে সৌভাগ্যের দরজা আমাদের খুলে যেতে পারে।

বয়স্কা তাচিয়ানা ম্যাডামের কচকচানি ভাল লাগে না।মন পড়ে থাকে ওই রুমে যেখানে হুজুর একাকী পড়ছে।ব্লাক-বোর্ডের দিকে চেয়ে থাকি আনমনে।
হঠাৎ লারিসা ম্যাডাম ঝড়ের গতিতে ঢুকলেন আমাদের রুমে,চেহারায় একরাশ বিরক্তি ও হতাশা! বোঝা যাচ্ছিল সমস্যা গুরুতর।এসই হাপাঁতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তোমরা কি কেউ বলতে পার ‘হানি’ শব্দের বাংলা অর্থ? আমরা বিস্ময়ে একে অপরের মুখ চাওয়া- চাওয়ি করছি।কি ব্যাপার ম্যাডাম কি বাংলা ভাষার অনুরক্ত হয়ে পড়ল।
তিনি ব্যাকুল নয়নে চেয়ে আছেন আমাদের দিকে। অগত্যা কেউ একজন বলল,’মধু’।
তিনি বিড়বিড় দু’তিন বার উচ্চারণের চেষ্টা করলেন। আমাদের অপেক্ষা করতে বলে আবার বিপরীত দিকে । ক’সেকেন্ড পরেই ফিরে আসলেন তবে একা নন-পিছন পিছন নত মুখে কুটিল হাসি ছড়িয়ে আসছেন আমাদের আদু ভাই।
তোমরা ওকে একটু বলে দাও ‘হানি’ শব্দের অর্থ? অর্থ বলতেই ম্যাডাম মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে বসে পড়লেন। উচ্চস্বরে বললেন,’আমি চাকরি ছেড়ে দিতে রাজি আছি তবে একে পড়াতে পারব না।‘
আমরা যতটুকু ভেবেছিলাম সমস্যা মনে হয় তার থেকেও কঠিন।লারিসা ম্যাডামকে জিজ্ঞেস করলাম, -প্লিজ এক্সপ্লেইন করবেন কি ঘটেছিল?
কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে ম্যাডাম এগিয়ে গেলেন ব্লাকবোর্ডের দিকে।
রুশ ভাষায় লিখলেন,’মেওদ’ ফর ইংরেজি ‘হানি’। মুখে বললে,ওকে আমি জিজ্ঞেস করলাম হানি কি জানো সে প্রতিউত্তরে বলল,’না’।
আমি তাকে আবার বললাম ,-কখনো শোন নি,-হানিমুন? সে এবারও বলল,-না।
-যেভাবেই তাকে বোঝানোর চেষ্টা করি তার ওই একই উত্তর,-না।
-অগত্যা ব্লাক-বোর্ডে একটা ফুল আঁকলাম-এঁকে দেখালেন এই ভাবে।এখান থেকে একটা মৌ মাছি কিছু একটা নিয়ে মৌচাকে এসে বসবে এই মৌচাক থেকে যে আঠালো মিস্টি পদার্থ বের হবে সেটাই,-'মেওদ।
-তাকে জিজ্ঞেস করলাম এখন বুঝেছ-হানি কি?
সে প্রতিউত্তরে কিছুক্ষণ নাক ঝেড়ে(বলতে গিয়ে ঘৃণায় ম্যাডামের চোখ মুখ কুঁচকে গেল) খক্ খক্ করে কেশে মেঝেতে এক দলা কফ ফেলে বলল,-ফুল!!
-আবার তাকে প্রথম থেকে বোঝালাম।শেষে সে বুঝেছে কিনা জানতে চাইতেই
সেই আগের স্টাইলে বলল( তিনি নাম উচ্চারণ করতে পারছিলেন না ব্ল্যাকবোর্ডে একে দেখালে, আমরা বললাম),-মৌমাছি।
সেজন্য বাধ্য হয়ে তোমাদের শরণাপন্ন হতে হোল।চরম হতাশায় তিনি মাথা নেড়ে বললেন ওকে পড়াতে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব।
হুজুরের এই চরম অজ্ঞানতায় ও অসভ্যতায় আমরা যার পর নাই ক্ষুব্ধ ও লজ্জিত হলাম। আমাদের সহপাঠী সবচেয়ে তুখোড় ছাত্র ভীষণ শান্ত বিপুল পর্যন্ত ক্লাস শেষে রাগ দমাতে না পেরে একরকম তেড়েই গেল তাকে মারতে।
তদ্দিনে সবাই তার পড়াশোনার পেছনের গুঢ় রহস্যের সন্ধান পেয়েছে।রিপনের(সহপাঠী) থেকে ধার নেয়া বিশ্বের ম্যাপের উপর ঝুঁকে পরে চূড়ান্ত মনোনিবেশে,শকুনের দৃষ্টিতে আমেরিকা ও জাপানের বর্ডার ফলো করত।স্বপ্ন দেখত কোন ক্রমে যদি নিকোলাইভস্ক থেকে লাফ দিয়ে শাখালিন দ্বীপে পৌছুতে পারে তাহলে তাকে আর পায় কে অথবা একটু কষ্ট করে বেরিং সাগর সাতরে হিমশীতল আলাস্কা পর্বতশ্রেণীটা পার হতে পারলে-ইতো ..হেঃ হেঃ আমেরিকা।তার সেই অমার্জনীয় দুঃসাহসিক দিবা স্বপ্নের দু’একজন সঙ্গী জুটতেও দেরী হোল না।
ঠিক তক্ষুনি আবিষ্কার হোল তার ভুয়া সার্টিফিকেটের কাহিনী।সে ইতিহাস তার জন্য নিদারুণ লজ্জাকর। তবে আমাদের জন্য এটা বিশেষ কোন সারপ্রাইজ বহন করেনি। ব্যাপারটা আমরা আগে থেকেই আঁচ করেছিলাম। দু’ফোটা গড়ল গিলে গল্পের অতিসয্যে নিজের কৃতিত্ব জাহির করতে গিয়ে আচমকা মুখ ফসকে বেরিয়ে পরেছিল।
তবে এতদিনে বিশ্বাস করলাম মদ খেলে মানুষের ভিতরে সযত্নে জমিয়ে রাখা অনেক অপ্রিয় গোপন কথা গল্পচ্ছলে বেরিয়ে পরে।
অনেক দেখে এর একটাই বিশেষত্ব বের করতে পেরেছি।
সব সয়ে তার বিশেষ অনুনয়ে বন্ধুরা চেষ্টা করেছিল একটা গার্ল ফ্রেন্ড যোগাড় করে দিতে। যে ছেলে সুযোগ খোজে অন্যের মরূদ্যানে দু’দণ্ড জিরিয়ে নেয়ার (নিজের নেই কিন্তু সুযোগে থাকে অন্যের মেয়ে বন্ধুর সাথে একটু রসালাপ করার) সেও চেষ্টার কমতি করে নাই। অবশেষে সবাই ব্যর্থ!কেউবা তার চেহারা দেখে ভাগে কেউবা ভাগে কথা শুনে-কেউবা মায়াবী চাহনিতে।
চিখ্ম (মতান্তরে,-তিখ্ম! আমাদের সেই ইন্সটিটিউটের নাম)কর্তৃপক্ষ নতুন এক কেমেস্ট্রি টিচারকে নিয়োগ দিলেন আমাদের কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন শেখাতে।
প্রথম দিন তাকে দেখে চমকে গিয়েছিলাম।আরে এতো নেহায়েত ছুকড়ি!এত অল্প বয়েসি মেয়ে কিনা আমাদের টিচার!কি পড়াবে এই মেয়ে? কিন্তু ক্লাসের শুরুতেই সে ভুল ভাঙল।ছোটখাটো গড়নের লাস্যময়ী মিষ্টিমুখের সেই মেয়েটি পড়ানোর ফাকে বুঝিয়ে দিল বয়সে সে একটু কাঁচা হলে পড়ানোতে আনাড়ি নয়।
তবে তার সেই কাঁচা বয়েসের হিসেব শুনে আমারা ভিমড়ি খাবার যোগার বলে কিনা ওঁর বয়েস এই জুনে ত্রিশ পড়বে!
রেসিডেন্সের সমস্যার জন্য তিনি সাময়িক আস্তা গাড়লে আমাদের বিলাস বহুল বিশাল হোস্টেলের এক কোনায়।একই ফ্লোরে থাকার জন্য সকাল বিকাল তার মুখদর্শন অস্বাভাবিক ছিলনা।আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভাল লাগলেও সবাই তার দিকে সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাত।কিন্তু কেন যেন মনে হোল হুজুরে’র মতিগতি ভাল না।
সকাল বিকেল সন্ধ্যে থেকে গভীর রাত তক তিনি চুলে টেরি কেটে দেশ থেকে আনা একমাত্র খয়েরী রঙের জিন্সটা নাভির চার ইঞ্চি উপরে প্রায় বুকের কাছ ঘেঁষে বেল্ট নামক দড়ি দিয়ে টাইট করে বেধে রং বে রঙের ঝকমারি সার্ট আর কেটস্ পরে গুন গুন করে গান গাইতে গাইতে করিডোরের এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দিত আর মুচকি হেসে আড় চোখে চাইত মারিয়ানা ইভানভনার(কেমিস্ট্রি শিক্ষক)বন্ধ দরজার দিকে।
অন্য সবাই তার এই দিওয়ানা-পনের জন্য মৃদু ভৎর্সনা করলেও মজা পেত।
-খেলা জমে উঠেছে। রাতও গভীর। সেখানে তখন বাহান্ন পাতির তাস পাওয়া যেত না ওরা নাকি ছত্রিশ পাতির তাস দিয়ে খেলে।কি আর করার।এখানে আমাদের রিক্রিয়েশনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম এই কার্ড খেলা।
হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠের তীক্ষ্ণ চিৎকার,-পামাগিচে পাসালোসতা।’প্লিজ হেল্প’
-প্লিজ হেল্প’
হতচকিত হয়ে হাতের কার্ড ছুড়ে ফেলে হুড়-মুড়িয়ে ছুটলাম শব্দের উৎস লক্ষ্য করে,ক’পা এগিয়েই চমকে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম,এ আওয়াজ-তো আমাদের সেই নব্য ম্যাডামের রুম থেকে ভেসে আসছে!
যাওয়া কি ঠিক হবে? তক্ষণেই আবার সেই চিৎকার’ পামাগিচে।দ্বিধা ঝেড়ে দৌড়ে গেলাম সেই রুমের দিকে।গিয়ে দেখি হাট করে রুমের দরজা খোলা।
ঘরের মাঝখানে হিংস্র নেকড়ের মত ভয়ংকর ও কামার্ত দৃষ্টি নিয়ে শুধুমাত্র একখণ্ড অন্তর্বাস পরে দাড়িয়ে আছেন সেই মহান ব্যক্তিত্ব! নাম বলার কি কোন প্রয়োজন আছে?
আর ঘরের এক কোনে ভয়ার্ত ও অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে বিপর্যস্ত বসনায় চড়ুই পাখির ছানার মত কাঁপছেন মারিয়ানা পাভলভনা !!!!!

সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:৪০
১৬টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×