কিরগিজের এক গ্রামে বাস করত তিন ভাই। ওদের সম্পত্তি বলতে ছিল শুধু একটা ষাঁড়। জীবিত অবস্থায় এটাকে কিভাবে তিনভাগে ভাগ করে নেয়া যায় এর কোন যুক্তিসম্মত উপায় বের করতে না পেরে প্রথমে ভাবল ওটাকে বিক্রি করে ফেলবে। কিন্তু কয়েকদিন ধরে কয়েক গ্রাম ঘুরে এমন কোন ধনীকে খুঁজে পেলনা যার ওই সাড় কেনার সামর্থ্য আছে! একবার ভাবল ষাঁড়টাকে কেটে টুকরো টুকরো করে মাংস ভাগ করে নিবে। কিন্তু না তখুনি তারা মাথা থেকে এ চিন্তা তাড়িয়ে দিল। এত প্রিয় ষাঁড়টাকে কেটে ফেলতে তাদের খুব কষ্ট হবে।
অবশেষে বহুদূরে এক গাঁয়ের কোন এক বিচক্ষণ প্রবীণ লোকের কাছে পরামর্শ চাইল,কি করে ষাঁড়টাকে সমান ভাবে তিনজনে মিলে ভাগ করে নেয়া যায় ।
তিনি বললেন ষাঁড়টাকে তার কাছে নিয়ে আসতে। তারপরে বলবেন কি করে এটাকে ভাগ করা যায়।
তিন ভাই বাড়িতে ফিরে এসে পরদিন অতি প্রত্যুষে ষাঁড়টাকে নিয়ে চলল সেই বিজ্ঞ প্রবীণের কাছে। যাবার পথে বড় ভাই হাঁটছিল আগে আগে ,ষাঁড়ের দড়ি ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সে, মেঝো ভাই ছিল মাঝে আর ছোট ভাই গরু তাড়াবার একটা লাঠি নিয়ে ষাঁড়টার পিছু পিছু। পথে যেতে যেতে তাদের দেখা হল এক পূর্ব পরিচিত ঘোড় সওয়ারীর সাথে।
সে ঘোড়া থামিয়ে প্রথমে বড় ভাইকে জিজ্ঞেস করল,
- কি ব্যাপার ষাঁড় নিয়ে চললে কোথায়?
- যাচ্ছিরে ভাই ওই দুরের পাহাড়ের পাদদেশের এক গ্রামের বিজ্ঞ প্রবীণের কাছে। তিনি বলেছেন ষাঁড়টাকে নাকি আমাদের তিন ভাইকে সমান ভাগে ভাগ করে দিবেন!
- তাই নাকি ! খুব ভাল । ঠিক আছে,ফের দেখা হবে - বিদায়।
শুনুন বড় ভাই তাকে ডেকে বলল,
-কিছুদূর গেলেই আমার মেজো ভাই এর সাথে দেখা হবে । তাকে আমার শুভেচ্ছা দিয়ে বলবেন, আমরা আশা করি সন্ধ্যে নাগাদ ওই গ্রামে পৌঁছে যাব, সে যেন চিন্তা না।
- ঠিক আছে বলব।’ বলেই ঘোড় সওয়ারী বিদায় নিল।
দুপুর নাগাদ তার সাথে দেখা হল মেঝো ভাই এর সাথে। ঘোড় সওয়ারী কাছে গিয়ে কুশল বিনিময় করে বলল,
-তোমার বড় ভাই তোমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেছে, চিন্তা না করতে ।সন্ধ্যে নাগাদ নাকি তোমরা ওই গ্রামে পৌঁছে যাবে।
- ও তাই ধন্যবাদ তোমাকে। আরেকটু সামনে এগিয়ে আমার ছোট ভাই এর সাথে দেখা হলে বলবে সেও যেন চিন্তা না করে। আমরা ভাল আছি। আশা করি সন্ধ্যের আগেই গন্তব্যে গিয়ে পৌছব।
-ঠিক আছে বলব। আপনাদের যাত্রা শুভ হোক।’ বলেই অশ্বারোহী ফের ঘোড়া ছোটাল তার পথ ধরে।
বিকেল নাগাদ দেখা পেল ছোট ভাইয়ের। সে লাঠি নিয়ে ষাঁড়ের পিছু পিছু এগিয়ে আসছে।
সামনে এগিয়ে গিয়ে কুশল বিনিময় করে ঘোড় সওয়ারী বলল;
- আসার পথে তোমার মেঝো আর বড় ভাই এর সাথে দেখা হয়ে ছিল। তারা তোমাকে শুভেচ্ছা দিয়ে বলেছে চিন্তা না করতে। সন্ধ্যে নাগাদ নাকি ওই গ্রামে পৌঁছে যাবে।
- তাই। তোমাকে ধন্যবাদ ভাই। আমি আরও ভয়ে ভয়ে মরছি। রাত হয়ে গেলে-তো বেশ বিপদে পড়ব।
- আপনাদের যাত্রা শুভ হোক। ফের দেখা হবে।’ বলে বিদায় নিয়ে অশ্বারোহী তার তার গন্তব্যের পথে ঘোড়া ছোটাল।
-------------------------------------------------------------------------
ঠিক তখুনি ঘটল এক ভয়াবহ অঘটন! আচমকা বিশাল এক ঈগল এসে ষাঁড়টাকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেল! তিন ভাই বোকার মত শুধু হা করে চেয়ে চেয়ে দেখল । কিন্তু ওদের কিছুই করার ছিলনা। পথের মাঝেই সারারাত বসে থেকে সকাল হলে ভীষণ মন খারাপ করে খালি হাতে বাড়ির দিকে ফিরে চলল।
ঈগলটা সেই বিশাল-দেহী ষাঁড়কে তার নখের থাবায় ধরে উড়ে উড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল মনমতো কোন বসার জায়গা। উড়তে উড়তে তার নজরে এল তৃণভূমিতে চড়ে বেড়াচ্ছে বিশাল এক ছাগলের পাল। ওর মধ্যে বেশ বড়সড় একটা ছাগলের দিকে তার নজর গেল। ছাগলটার উঁচু উঁচু শিংগুলোকে বেশ শক্তপোক্তই মনে হল। ঈগলটা চুপিসারে ধীরে ধীরে নেমে বসল সেই ছাগলের শিংয়ের উপরে। সেখানেই বসে আরামসে ষাঁড়টাকে ছিঁড়েফুড়ে খেল আর ষাঁড়ের হাড়গুলো সে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ফেলল এদিক ওদিক।
----------------------------------------------------------------------
ঠিক তখুনি শুরু হল বৃষ্টি। ছাগপালক তাড়াহুড়ো করে তার ছাগলের পালকে বৃষ্টির ছাট থেকে বাঁচানোর জন্য জড়ো করলো সেই বড় ছাগলটার দাড়ির নীচে।
-----------------------------------------------------------------------
আচমকা সেই ছাগ-পালক তার বা’চোখে অনুভব করল তীব্র ব্যথা। সে ভাবল ‘চোখে নিশ্চয়ই কিছু একটা ঢুকছে’।
কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই ব্যথা উঠল চরমে! তাড়াহুড়ো করে ছাগলের পালকে খোঁয়াড়ে রেখে,গ্রামের সবাইকে ডেকে বলল,
-‘তাড়াতাড়ি আমার জন্য ডাক্তার নিয়ে আসো। আঃ! মনে হচ্ছে পাথর কণা ঢুকেছে চোখের মধ্যে। খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।’
তার ব্যথার ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে গ্রামের লোকেরা হুড়োহুড়ি দৌড়াদৌড়ি করে জনা চল্লিশেক ডাক্তার জোগাড় করে নিয়ে এল। ডাক্তাররা চল্লিশটা নৌকায় চেপে নেমে পড়ল ছাগ-পালকের চোখের মধ্যে!
বহুক্ষণ ধরে তারা চোখের ভিতর নৌকা বেয়ে আবিষ্কার করল একটা হাড়! সেটা ছিল সেই ষাঁড়েরই চোয়ালের হাড়ের একটা অংশ।
ডাক্তাররা ছাগ-পালকের চোখের মধ্যে থাকা হাড়টা-বের করে দিয়ে ফিরে যাবার পথে সেটাকে ফেলে দিয়ে গেল গ্রাম ছাড়িয়ে বহুদূরের এক জঙ্গলে।
কিছু সময় বাদে একদল যাযাবর সেই পথ দিয়েই যাচ্ছিল- যেখানটায় ডাক্তারদের ছুড়ে দেয়া হাড়টা পড়ে আছে।
রাত সমাগত,বনের মাঝে একটা লবণের গুহা দেখে তারা ভাবল আজকের রাতটা এখানেই কাটিয়ে গেলে কেমন হয়? সবাই মিলে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিল আজকের এখানেই থাকবে।
চারিদিক থেকে শুকনো কাঠ জোগাড় করে আগুন জ্বেলে তার পাশে সবাই মিলে গোল হয়ে বসে গল্প করতে করতে বলল,এই লবনের গুহাটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশী নিরাপদ , এর থেকে ভাল জায়গা মনে হয়না এই বনে আছে।’
রাতে সেই গুহায় যখন সবাই শোবার বন্দোবস্ত করছে, ঠিক তখনি আচমকা সেই গুহার মেঝে দেয়াল ছাদ সবকিছু ভয়ংকর ভাবে দুলে উঠল। যাযাবররা ভয় পেয়ে ভাবল, হয়তো ভূমিকম্প হচ্ছে। তারা তাড়াহুড়ো করে দৌড়ে গুহা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এল।
বাকী রাতটা তারা গুহা ছেড়ে বহু দুরে খোলা আকাশের নীচে নির্ঘুমই কাটাল।
ভোর হতেই যাযাবর সর্দার তার চল্লিশজন ঘোড় সওয়ারীকে পাঠাল গুহার চারপাশটা ভাল করে দেখে আসতে। কেন শুধু গুহাটাই কেঁপেছিল।
ঘোড় সওয়ারীরা তাদের ঘোড়া ছুটিয়ে সেই লবন গুহার আশে পাশ ঘুরে দেখল। সেটা আসলে গুহা নয় বিশাল একটা ষাঁড়ের চোয়ালের হাড়- সেটা এখনও একটা শেয়াল বসে বসে চিবোচ্ছে।
‘ও এই জন্যই আমরা গতরাতে ভেবেছিলাম ভূমিকম্প হচ্ছে!’ আহ্ কি ভয়টাই না পেয়েছিলাম কাল রাতে।’
------------------------------------------------
তারা সবাই মিলে একসাথে তীর ছুড়ে সেই শেয়ালটাকে মেরে ফেলল। কিন্তু শেয়ালটাকে মারল বটে তবে ছাল ছাড়াতে গিয়ে পড়ল বিপদে! একপাশের ছাল ছাড়ানোর পরে বহু-চেষ্টা করেও সেটাকে অন্যপাশে উল্টাতে পারল না। অগত্যা হাল ছেড়ে দিয়ে ওরা অর্ধেক চামড়া নিয়েই ফিরে এল তাদের সর্দারের কাছে।
ঠিক তক্ষুনি এক মহিলা এসে সেই সর্দারের কাছে আর্তি জানাল,
-দয়া করে কি তুমি আমাকে সেই শেয়ালের চামড়াটা দিবে,যেটা এই মাত্র তোমার ঘোড়সওয়াররা বয়ে নিয়ে আসল। আমি চামড়াটা দিয়ে আমার ছোট্ট শিশুর জন্য একটা টুপি বানাব।’
- ঠিক আছে নিয়ে যাও।’ দয়ালু সর্দার তখুনি চামড়াটা মহিলাকে দিয়ে দিলেন।
--------------------------------------------------
মহিলা চামড়াটা তার বাসায় বয়ে নিয়ে ছেলের মাথার মাপ নিয়ে টুপি সেলাতে বসলেন। আধখানা টুপি সেলাই করতেই তিনি দেখেন চামড়া শেষ। তিনি আবার ছুটলেন সেই সর্দারের কাছে। তাকে অনুরোধ করলেন বাকি অর্ধেক চামড়া এনে দেয়ার জন্য।
সর্দার তাকে বললেন তার চল্লিশটা ঘোড় সওয়ারীর কথা অনেক চেষ্টা করেও তারা বাকি অর্ধেক আনতে পারেনি। তিনি বললেন,
-এর থেকে ভাল হয় যদি তুমি নিজে গিয়েই ছাড়িয়ে নিয়ে আস।’
সর্দারের অনুমতি পেয়ে মহিলা খুশী মনে চলে গেল শেয়ালের চামড়া ছাড়াতে। খুব সহজেই সে চামড়া ছিলে দ্রুত হতে ছেলের জন্য টুপি বানিয়ে ফেলল।
-----------------------------------------------
এখন সবার জন্য প্রশ্ন। কেউ কি বলতে পারবে কে সবচেয়ে বড়?
এটা কি সেই ষাঁড়?
মনে রাখতে হবে একজন ঘোড় সওয়ারীর প্রায় সারাদিন লেগেছিল তার মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত যেতে !
তবে কি ঈগল ?
মনে রাখতে হবে থাবায় করে ষাড়টাকে তুলে গিয়েছিল আকাশে!
তবে কি সেই ছাগল?
ভুলে গেলে চলবে না যার শিঙের উপরে বসে ঈগলটা ষাড়টাকে খেয়েছিল!
তবে কি সেই ছাগপালক?
মনে রাখতে হবে চল্লিশটা নৌকায় চড়ে চল্লিশ জন ডাক্তার দীর্ঘক্ষন ধরে খুজে তার চোখের ভিতর থেকে গরুর চোয়ালের হাড় বের করেছিল!
তবে কি সেই শেয়াল ?
মনে রাখতে হবে যার থাবায় পুরো বনভুমি কেঁপে উঠেছিল।
তবে কি সেই শিশু?
ভুলে গেলে চলবেনা অর্ধেক শেয়ালের চামড়া দিয়ে তার মাথার টুপি হয়নি।
অথবা সেই শিশুর মা যে এমন দৈত্যাকৃতি শিশুর জন্ম দিয়েছে?
এই গল্পটাতে আরো অনেক প্রশ্ন ও তার উত্তর রয়ে গেছে। বলতে পারবে কি কেউ -কে সবচেয়ে বড়? *
ভাষান্তর ও রুপান্তরঃ শেরজা তপন
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ রাত ১০:৪১