[ভেবেছিলাম বুদ্ধদেব গুহের মত অসামান্য একজন সাহিত্যিকের প্রয়াণে সামু ব্লগে ভাল কিছু স্মৃতিকথা বা তাকে শ্রদ্ধা সন্মান জানিয়ে কিছু লেখা পাব- গত দু'দিন অপেক্ষা করে তেমন কিছুই পেলাম না। চরম হতাশ হলাম। ব্লগার রাজিব নুরের একটা পোষ্টে ডঃ এম আলী-ভাই সহ আরো কিছু ব্লগারের আক্ষেপে অবশেষে বিভিন্ন সুত্র থেকে সংগ্রহ করে নিজের অল্প স্মৃতিকথা মিলিয়ে একটা লেখা দিচ্ছি। উল্লেখ্যঃ লেখাটার নব্বুইভাগ সংগৃহীত- আমার নিজের কোন কৃতিত্ব নেই।]
বুদ্ধদেব গুহ (জন্ম ২৯ জুন, ১৯৩৬ ― ২৯ আগস্ট, ২০২১) একজন ভারতীয় বাঙালি লেখক। তিনি মূলত বন, অরণ্য এবং প্রকৃতি বিষয়ক লেখার জন্য পরিচিত। তার স্ত্রী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়িকা ঋতু গুহ। বহু বিচিত্রতায় ভরপুর এবং অভিজ্ঞতাময় তার জীবন।
ফিরে এসেছিলেন করোনা থেকে কিন্তু শেষ রক্ষা হল না।সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখকই পেরেছেন তার মত অকপট হতে। প্রেম কে নারী পুরুষের হৃদয়বৃত্তিকে এমন নিবিড় মায়ার আলোকে এমন কোমল আঁচড়ে চিত্রিত করতে পেরেছেন খুব কম লেখকই। তাইতো যুবক বয়সে চিঠি লিখেছি মারিয়ানা'কে ভেবেছি ছুটিকে,রিয়াকে,রোমাঞ্চিত হয়েছি রূষা কে ভেবে।আর বুলবুলি লেখকের একান্ত ভালোবাসার বুলবুলি.. তাকে বাধ্য হয়েছি ভালোবাসতে।অপেক্ষায় ছিলাম হয়তো বোধদয় হবে সাহিত্যের নীতিনির্ধারকদের।ওনার স্বীকৃতি তো অনেক আগেই তিনি পেয়ে গেছেন।বাংলা ভাষার অন্যতম বেস্টসেলার লেখক হিসাবে অনেক আগেই এতগুলো বছর তাকে বুকে তুলে নিয়েছিলো তার পাঠকরা, বাঙালিরা।অথচ একটা বই লিখেই একাডেমি পেয়ে গেলো কত লোক।
যাচিত অযাচিত অনেক উপদেশ থাকতো ওঁর লেখায়।আমরা যারা কম শিক্ষিত তাদের বড় ভালো লাগতো সেসব।উচিৎ কথাটা ভালোলাগার লেখক বলতেন যে।তাই হয়তো অনেক অন্যরকম লাগতো সেসব।শিখতাম উপলব্ধি করতাম কোট করতাম।
ইংল্যান্ড, ইউরোপের প্রায় সমস্ত দেশ, কানাডা, আমেরিকা, হাওয়াই, জাপান, থাইল্যান্ড ও পূর্বআফ্রিকা তার দেখা। পূর্বভারতের বন-জঙ্গল, পশুপাখি ও বনের মানুষের সঙ্গেও তার সুদীর্ঘকালের নিবিড় ও অন্তরংগ পরিচয়
বই পড়া নয় জঙ্গল নিয়ে ওঁর টাটকা ফার্স্ট হ্যান্ড অনুভব,মানুষের অন্যতম মৌলিক বৃত্তি খাওয়া দাওয়া নিয়ে গভীর চুলচেরা পর্যবেক্ষণ ,ফুলের মত প্রজাপতির মত কখনো বাঘিনীর মত নারীকে বিশ্লেষণ.. যারা বুঝেছে তারা বুঝেছেই-যতই প্রাইজ থেকে বঞ্চিত রাখা হোক 'হাজার হোক সময়ের অন্যতম সেরা বেস্টসেলার লেখক ছিলেন ভদ্রলোক।
এ জীবনে সব যাত্রাই শেষ হয়।লেখক শেষ করলেন তারটা। জানিনা পরের প্রজন্মের কি হবে। তারা কি বুদ্ধদেব গুহকে, জঙ্গল কে শিকার কে প্রেম কে জীবনবোধ নিয়ে লেখা সেই সব বিশ্লেষণ কে নিজের গভীরে ধারণ করে নেবে,আমাদের মত?
জানিনা,শুধু জানি এ জীবনে সেরা শিকারী লেখক বাংলা সাহিত্যের সেরা রোমান্টিক লেখক হিসাবে উচ্চারিত হবে শুধু তারই নাম।
অবশেষে চলে গেলেন প্রখ্যাত সাহিত্যিক এবং সঙ্গীত শিল্পী বুদ্ধদেব গুহ ।
মৃত্যু কালে বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর
গতকাল ২৯ শে আগস্ট ২০২১ সাল রবিবার রাত ১১ টা ২৫ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
জঙ্গল দেখার এবং তা নিয়ে লেখার যে ওনার অন্য রকমের চোখ ছিল (কয়েক জেনারেশনের বাঙালি লেখকদের মধ্যে) এ তো তর্কাতীত। মাধুকরী, কোজাগর, ঋভু, সারেঙ মিঞা, হলুদ বসন্ত, বাজা তোরা, রাজা যায় ভারী প্রিয় সব বই।
এ তো পাতা ঝরার দিন। এনাদের বয়সি জ্ঞানীগুণীরা তো চললেন। বুধো গুহ আমার মনে একটুখানি বিশেষ জায়গা নিয়ে থাকবেন।
'জঙ্গলমহল' তার প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ। তারপর বহু উপন্যাস ও গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি লেখক হিসেবে খুবই অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। তার বিতর্কিত উপন্যাস 'মাধুকরী' দীর্ঘদিন ধরে বেস্টসেলার। ছোটদের জন্য তার প্রথম বই- 'ঋজুদার সঙ্গে জঙ্গলে'। ঋজুদা তার সৃষ্ট একটি জনপ্রিয় অভিযাত্রিক গোয়েন্দা চরিত্র। আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৭৬ সালে। প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ঋতু গুহ তার স্ত্রী। সুকণ্ঠ বুদ্ধদেব গুহ নিজেও একদা রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন। পুরাতনী টপ্পা গানে তিনি অতি পারঙ্গম। টিভি এবং চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে তার একাধিক গল্প উপন্যাস।
টপ্পা গাওয়া নিয়ে তার এক ভক্ত লিখেছেন; বুদ্ধদেব বাবু'র ঈশ্বরে বিশ্বাস নিয়ে আমার পড়াশোনা নেই। কিন্তু সেদিনের বলার মধ্যে যে দৃঢ়তা ছিল সেটা আমায় ছুঁয়ে গিয়েছিল। পরের দিকে ভালো লাগতে শুরু করেছিল ওনার গাওয়া টপ্পা। বেশ ভালো লেগেছিল। "ভালোবাসিবে বলে ভালোবাসিনে, আমারও স্বভাবও এই আমি তোমা বই কিছু জানি নে".... মুগ্ধ করেছিল। তবে ওঁকে শুনলে মনে হত যেন কোথাও ঋতু গুহ'র মেল ভার্সান শুনছি। উচ্চারণ, স্বরক্ষেপণে এত মিল! আশ্চর্য লাগত। এখনও লাগে।
লেখকের কিছু জনপ্রিয় উপন্যাস।
চাক্ষুষ করেছি বইমেলায়। টকটকে লাল ফর্সা মানুষ একজন। শীতের রোদ গায়ে মেখে বসে আছেন। চারদিকে অনুরাগী পাঠক পাঠিকাবৃন্দের ভিড়। দূর থেকে দেখেছি। স্মিত হেসে কথা বলছেন সবার সঙ্গে। সই করছেন। বিস্ময় লেগেছে, এই মানুষটা এমনভাবে জঙ্গলের গভীরের গল্প লেখেন! এত নরম, এত কোমল একজন মানুষ জঙ্গলে... ভেবে দেখার চেষ্টা করেছি বইমেলায় হাঁটতে হাঁটতে... আবার ভুলে গেছি। বই সত্য অবশেষে, লেখক তো নন।
মনটা অসাড় হয়ে আছে। আজকাল কোনো কিছুতেই ভীষণ আঘাত যেন পাই না। অতিমারিই করে দিয়ে গেছে। আফগানিস্তান খবরের পাতা জুড়ে। কি অসহায় ছবি সব। বারবার মানুষ আশ্রয় খোঁজে। মানুষ অন্ধকারের রাজাকে খোঁজে। বিশ্বাসে, অবিশ্বাসে, যুক্তিতে, ভক্তিতে একটা ব্যাখ্যা খোঁজে সব কিছুর। এক টুকরো কুড়িয়ে বাড়িয়ে যদিও বা পায়, আবার তছনছ হয়ে যায়।
মানুষের গভীরতম অন্ধকার ভবিষ্যতের অন্ধকার। সেই অন্ধকারকে সে কল্পনা করতে চায় অনুকূলভাবে। হয় না। জীবন মানেই তো নিত্যনতুন প্রতিকূলতা। নিজেই নিজের অনুকূল হই কই?
বুদ্ধদেব গুহ একটা অনুষ্ঠানে দুষ্টুমি করে তারাপদ রায়কে বলছেন, তাই.. এইসব দুষ্টুমি ছিল বুঝি আপনার… (না, তোমার বলেছিলেন মনে নেই)। তারাপদ বাবু একটুও অপ্রতিভ না হয়ে বলেন, হ্যাঁ তো, আপনি যেমন ওইসব দুষ্টুমি নিয়েই গল্প লেখেন।
হাসির হুল্লোড় উঠল বৈঠকে। এই হয়। অল্প অল্প সুখ। অল্প অল্প স্বপ্নপূরণ। আর অসীম অধরা, অসীম অজানা, অসীম না বোঝা। কতটুকু জীবন আর! লেখকের কাছে চাহিদা তো এই, সলমন রুশদির ভাষায় কব্জি ডুবিয়ে মানুষের গভীরে ঢুকে কিছু বলতে যাওয়া। গভীরের কথা বলতে যাওয়া। কিন্তু সবাই কি অত গভীরের কথা বলতে চান? অনেকে বাইরের কথাও তো বলেন। মনের উপরে ভেসে থাকা সুখ-দুঃখ, আশা-হতাশা, এ সবের গল্পও কম কি! পাঠক তাও তো চায়! একটু ভুলে থাকা। একটু আরাম। সব সময় মুখের সামনে আয়না ধরা লেখা কি পছন্দ করে মানুষ? না। মানুষ সত্যকে চায় না। মানুষ সুখ চায়। দুঃখের মধ্যেও সুখ চায়। কান্নার সুখ। ব্যর্থ ভালোবাসার কোনো লেখকের কলমে সার্থক হয়ে ওঠার সুখ। কিম্বা সে ব্যর্থতাকে তুচ্ছ না করে তাকেও মনের মুকুরে ভাস্বর করে দেখার সুখ। সেও তো আছে। বুদ্ধদেব বাবু'র অজস্র লেখায় পাঠক নিজেকে খুঁজে পাবে, এ নিশ্চিত। লেখক চলে যান, বই থেকে যায়। বই সত্য, লেখক তো নয়।
শেষ বেলায় বুদ্ধদেব গুহ
আরেকজন লিখেছেন;
সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যে খুব কম লেখকই পেরেছেন তার মত অকপট হতে।প্রেম কে নারী পুরুষের হৃদয়বৃত্তিকে এমন নিবিড় মায়ার আলোকে এমন কোমল আঁচড়ে চিত্রিত করতে পেরেছেন খুব কম লেখকই।তাইতো যুবক বয়সে চিঠি লিখেছি মারিয়ানা'কে ভেবেছি ছুটিকে,রিয়াকে,রোমাঞ্চিত হয়েছি রূষা কে ভেবে।আর বুলবুলি লেখকের একান্ত ভালোবাসার বুলবুলি.. তাকে বাধ্য হয়েছি ভালোবাসতে।অপেক্ষায় ছিলাম হয়তো বোধদয় হবে সাহিত্যের নীতিনির্ধারকদের।ওনার স্বীকৃতি তো অনেক আগেই তিনি পেয়ে গেছেন।বাংলা ভাষার অন্যতম বেস্টসেলার লেখক হিসাবে অনেক আগেই এতগুলো বছর তাকে বুকে তুলে নিয়েছিলো তার পাঠকরা, বাঙালিরা।অথচ একটা বই লিখেই একাডেমি পেয়ে গেলো কত লোক।এক সময় ছিলো ভুখা নাঙ্গা আর সমাজতন্ত্র আর এখন হল ধর্মের সুড়সুড়ি অথবা সমকামিতার মত কোনো বিকৃত ইস্যু ব্যাস হয়ে গেলো ককটেল।আর এদেশে তো কথাই নাই। বলাৎকারী মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা আর ভঙ্গুর লেজুড়বৃত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা এমন গতিতে সেমি শিক্ষিত সমাজকে অন্ধকারে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যে আগামী দিন উটের পিঠে চড়ে বসতে হবে কিনা সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে সামনে।
যাচিত অযাচিত অনেক উপদেশ থাকতো ওঁর লেখায়।আমরা যারা কম শিক্ষিত তাদের বড় ভালো লাগতো সেসব।উচিৎ কথাটা ভালোলাগার লেখক বলতেন যে।তাই হয়তো অনেক অন্যরকম লাগতো সেসব।শিখতাম উপলব্ধি করতাম কোট করতাম।
বই পড়া নয় জঙ্গল নিয়ে ওঁর টাটকা ফার্স্ট হ্যান্ড অনুভব,মানুষের অন্যতম মৌলিক বৃত্তি খাওয়া দাওয়া নিয়ে গভীর চুলচেরা পর্যবেক্ষণ ,ফুলের মত প্রজাপতির মত কখনো বাঘিনীর মত নারীকে বিশ্লেষণ.. যারা বুঝেছে তারা বুঝেছেই-যতই প্রাইজ থেকে বঞ্চিত রাখা হোক 'হাজার হোক সময়ের অন্যতম সেরা বেস্টসেলার লেখক ছিলেন ভদ্রলোক।
এ জীবনে সব যাত্রাই শেষ হয়।লেখক শেষ করলেন তারটা।জানিনা পরের প্রজন্মের কি হবে।তারা কি বুদ্ধদেব গুহকে, জঙ্গল কে শিকার কে প্রেম কে জীবনবোধ নিয়ে লেখা সেই সব বিশ্লেষণ কে নিজের গভীরে ধারণ করে নেবে,আমাদের মত?
জানিনা,শুধু জানি এ জীবনে সেরা শিকারী লেখক বাংলা সাহিত্যের সেরা রোমান্টিক লেখক হিসাবে উচ্চারিত হবে শুধু তারই নাম- অতল শ্রদ্ধা এই সাহিত্যিককে। শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকুন প্রিয় লেখক।
কুর্চিকে লেখা অসাধারণ চিঠি -
https://www.youtube.com/watch?v=kpiemAnTwro
-----------------------
সুত্রঃ উইকি, বইয়েরপোকা,আনন্দবাজার সহ বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়া
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:২৪