somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

লোমানসভ-রাশিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী

১১ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ সকাল ৯:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


পনাকে যদি জিগ্যেস করি ; কয়েকজন রুশীয় কবি সাহিত্যিকের নাম বলুনতো? আপনি গড়গড় কর দশ-বারোটা নাম বলতে পারবেন অনায়াসে। বাহ বেশ! এবার আসি দ্বিতীয় প্রশ্নে। আচ্ছা দু-জন রুশ বৈজ্ঞানিকের নাম বলুনতো? দু-চারজন বলতে পারলেও বেশির ভাগ লোকই মাথা চুলকাবেন নিশ্চিত! এখন না হয় ডিজিটাল যুগ, অন্তর্জালে খোঁচা দিলে মূহুর্তেই হাজির হবেএকগাদা নাম। তবে ভাবুন একবার প্রায় দুইযুগ আগের কথা! কলেজ অব্দি পড়ে আমি জেনেছিলাম সাকুল্যে একজন রুশ কবি আর জনাচারেক সাহিত্যিকের নাম। এর মধ্যে আবার শুধু মলাটের উপর দু-একজনের নাম পর্যন্ত দেখেছি, ব্যাস। খটমট হবে ভেবে পাতা উল্টাইনি। জানার বহর ছিল ঐ পর্যন্তই। তবুও আত্মপ্রসাদে ভুগতাম। আমরাতাও ওদের দু-চারজন কবি সাহিত্যিককে চিনি, কিন্তু ওরাতো আমাদের দেশটাকেই ভালো করে চেনেনা।
আমাদের একাডেমিক ভবন থেকে প্রশাসনিক ভবনের দূরত্ব ছিল অনেকখানি। বাসে করে যেতে হতো। শান্ত নিস্তরঙ্গ সানা নদীর পাড় ঘেঁষে দারুণ ছিমছাম একখানা দালান। ভবনের দো-তলার সিঁড়ির মুখেই প্রায় পুরো দেয়াল জুড়ে বিশাল এক অয়েল পোট্রেট। ভদ্রলোকের রাজকীয় ভঙ্গী দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম, “এই ইনিস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা হয়তো তিনি”। কালে ভদ্রে সেখানে যাই। দোতলায় উঠেই ছবিটার কথা মনে পড়ে। আমার এক রুশ বন্ধুর কাছে একবার জিজ্ঞেস করলাম, “লোকটাকে, রে?”
সে এমন অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে ফিরে তাকালো যে, আমি ঘাবড়ে গেলাম!
কিছুক্ষণ তার জবানবন্ধ ! এমন থাকলেই মনে হয় ভাল হতো। কন্ঠ দিয়ে শব্দ যখন বেরোলো, তখন সেটা এত অপমানজনক হবে আমি ভাবিনি।
-তুমি একে চেনোনা?! -ছাগল কোথাকার!
-তুমি নিউটন, আইনস্টাইনকে চেন?
হ্যা, চিনি।
তাহলে একে চেননা কেন? ইনি হচ্ছেন রাশিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী 'আন্দ্রে লোমানসভ।'

প্রারম্ভিকজীবন ও পরিবার

লমোনোসভ জন্মেছিলেন রাশিয়ার সর্ব-উত্তরে আরকানজেলস্ক শহরের দেনিসোভকা গ্রামে। পরবর্তী সময়েসেই গ্রামের নাম পাল্টে হয়ে যায় লমোনোসভ। তার বাবা ভাসিলিদোরো ফেয়েভিচলোনোসভ ছিলেন মৎসজীবী, যদিও বেশ ধনী, নিজের জাহাজে করে মাছ ধরতেন আর তা বিক্রি করতেন বড় বড় শহরে। লমোনোসভের মা ইলেনাসিভকোভা ছিলেন ভাসিলির প্রথম স্ত্রী।
বেশ অল্পবয়েসেই তাঁর বাবা তাকে নিজের ব্যবসায় নিযুক্ত করেন। লমোনোসভও বেশ দক্ষ তার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করতে সমর্থ হন।
কিন্তু ব্যবসাবাণিজ্য কখনোই তাকে টানেনি। তাঁর মুলত আগ্রহ ছিল নতুন নতুন কিছু জানার বা শেখার। দুঃখজনকভাবে তার বাবা তাকে কোন পড়ালেখা শেখায়নি- তিনি বালক-বয়সে তাঁর এক হিতাকাঙ্ক্ষী পড়শীর কাছে পড়াটা শিখেছিলেন। পড়ার প্রতি তাঁর ছিল অদম্য টান। একটুখানি সময় পেলেই বই পড়তে বসতেন। তাকে তাঁর এক গ্রাম্য ডেকান সব সময়ই পড়াশোনায় সাহায্য করেছেন। কিন্তু কৈশোরের একটা বড় অংশ তিনি শুধু ধর্মীয় বই পড়তে বাধ্য হয়েছেন।
১৭২৪ সালে ভাসিল (লমোনোসভের বাবা) তৃতীয়বার বিয়ে করেন। লমোনোসভের এই সৎ মা ইরিনার সাথে সম্পর্ক চরম তিক্ততায় পৌছে। এমনিতেই উচ্চশিক্ষার সুযোগনা পাওয়ায় তিনি বরাবরই ছিলেন প্রচণ্ডরকমের হতাশ আর অসুখী তারপরে তাঁর এই সৎ মায়ের ব্যবহার তাকে বাধ্য করে গ্রাম ছাড়তে।
১৭৩০ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে মস্কোগামী এক কারাভানের সাথে রওনা হন। মস্কো পৌছানোর অল্প ক-দিনবাদেই ‘স্লাভিকগ্রীক ল্যাটিন একাডেমিতে’ একজন যাজকের সন্তানের মিথ্যে পরিচয়ে ভর্তি হন।
কিন্তু তাঁর এই মিথ্যে পরিচয় গোপন থাকেনি বেশীদিন। একাডেমি কর্তৃপক্ষ যখন সত্যি ঘটনা জানতে পারলেন তখন তাকে সেখান থেকে বহিস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শিক্ষার প্রতি তাঁর চরম দুর্বলতা আর তাঁর দুর্দান্ত মেধাই তাকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দেয়।
সেই কঠিন সময়ে লমোনোসভ প্রতিদিন মাত্র তিন কোপেক (রাশিয়ান পয়সা) দিয়ে দিন নির্বাহ করতেন। শুধুমাত্র কালো পাউরুটি (সবচেয়ে স্বস্তা রুশ রুটি) আর কাভাস খেয়ে তিনি মাসের পর মাস কাটিয়ে দেন।


মেধাবী এই মানুষটি চরম দৈন্য সয়ে শিক্ষার প্রতি যে একাগ্রতা দেখিয়েছেন তা নিশ্চিতরূপে অনুকরণীয়। তার প্রতিভার প্রকাশ হতে দেরি হয়নি। সেই একাডেমিতে তিনবছর শিক্ষালাভের পর একাডেমি কর্তৃপক্ষ তাকে উচ্চতর শিক্ষার জন্য কিয়েভের মোহাইলা একাডেমিতে পাঠায়। বিস্ময়কর এই মানুষটি ১২ বছরের শিক্ষা (টুয়েলভথক্লাস) মাত্র পাঁচ বছরে শেষ করেন এবং গ্র্যাজুয়েশন করেন শ্রেষ্ঠতম ছাত্র হিসেবে। (১৭৩৬ সালে) সেন্টপিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ লাভ করেন। সেন্টপিটারর্সবুর্গের শিক্ষা শেষে তাকে পাঠানো হয় জার্মানির বিখ্যাত এবং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় ‘মারবুর্গ ইউনিভার্সিটিতে (শুরু:১৫২৭)’।
১৮ শতকে মারবুর্গ ছিল ইউরোপের সবচাইতে স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়। জার্মানির তৎকালীন প্রথিতযশা দার্শনিক ‘কিশ্চিয়ানউলফ’ এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও প্রিয় ছাত্রদের একজন ছিলেন লমোনোসভ। লমোনোসভের প্রিয় এই দার্শনিকের দীর্ঘদিনের সহচর্য লমোনোসভের বাকি জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
লোমোনোসভ দ্রুত জার্মান ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং দর্শন ছাড়াও, রসায়নে গুরুত্ব সহকারে অধ্যয়ন করেন,১৭ শতকের ইংরেজ ধর্মতত্ত্ববিদ এবং প্রাকৃতিক দার্শনিক রবার্ট বয়েলের কাজ আবিষ্কার করেন, এমনকি কবিতা লিখতে শুরু করেন। তিনি জার্মান সাহিত্যেও মনোনিবেশ করেছিলেন। বলা হয় যে তিনি গুন্থারের গুণমুগদ্ধ ছিলেন। ১৭৩৯ সালে রচিত সাহিত্যকর্ম ‘Ode on the Taking of Khotin from the Turks’সেন্ট পিটার্সবার্গে প্রচুর মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।

জার্মানিতে বসবাসের সময়, লোমোনোসভ ক্যাথারিনা জিলচের বাড়িতে উঠেছিলেন।তিনি ক্যাথারিনার মেয়ে এলিজাবেথ ক্রিস্টিন জিলচের প্রেমে পড়েন।১৭৪০ সালের জুন মাসে তাদের বিয়ে হয়।‘রাশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্স’ কর্তৃক প্রদত্ত স্বল্প এবং অনিয়মিত ভাতা তাঁর ক্রমবর্ধমান পরিবারের জন্য অপ্রতুলছিলো। যখন তাঁর আর্থিক পরিস্থিতি শোচনীয় হয়ে ওঠে, তখন তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন।



রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তন

১৭৪১ সালে তিনি রাশিয়ায় ফিরে আসেন। এক বছর পরে রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সেরপদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা করা হয়।১৭৪৩ সালের মে মাসে, লোমোনোসভকেএকাডেমির সাথে যুক্ত বিভিন্ন ব্যক্তিকে অপদস্ত করার অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়।তাকেগ্রেপ্তার করে আট মাস ধরে গৃহে অন্তরীণ রাখা হয়।অভিযোগকারীদের কাছে ক্ষমা চাওয়ার পর ১৭৪৪ সালের জানুয়ারিতে তাকে মুক্তি দেয়া হয় এবং ক্ষমা করা হয়। ১৭৪৫ সালে তিনি একাডেমির একজন পূর্ণ সদস্য এবং রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত হন। তিনি একাডেমির প্রথম রসায়ন গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেন। রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে১৭৫৫ সালেমস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি্র প্রতিষ্ঠায় লোমোনোসভ তাঁর পৃষ্ঠপোষক কাউন্ট ইভান শুভালভের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ১৭৬০ সালে, তিনি রয়েল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সের একজন বিদেশী সদস্য নির্বাচিত হন।১৭৬৪ সালে, তিনি Bologna Institute এর বিজ্ঞান একাডেমির বিদেশী সদস্য নির্বাচিত হন।



পদার্থবিদ

লোমোনোসভ ১৬৭৩ সালে সংঘটিত রবার্ট বয়েলের পরীক্ষাগুলো পুনরায় করার চেষ্টা করেন।তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে সাধারণভাবে গৃহীত ফ্লগিস্টন তত্ত্ব মিথ্যা। অ্যান্টোয়াইন লাভোয়সিয়ার আবিষ্কারগুলো সম্পর্কে পূর্বানুমান করেতিনি তার ডায়েরিতে লিখেছিলেন: " বিশুদ্ধ তাপের ক্রিয়ার ফলে ধাতুর ভর বৃদ্ধি পায় কিনা তা নির্ণয় করতেআজ আমি রূদ্ধ (হারমেটিক) কাচের পাত্রগুলিতে একটি পরীক্ষা করেছি। ১৩ তম পৃষ্ঠায় আমি যে পরীক্ষাগুলোর তালিকা সংযুক্ত করেছি তা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, শ্রদ্ধেয় রবার্ট বয়েলকে বিভ্রান্ত করা হয়েছিল, কারণ বাইরে থেকে বাতাসের প্রবেশাধিকার না থাকলেওপোড়া ধাতুর ভর একই থাকে "। তিনি তাপকে গতির একটি ধরণ হিসেবে গণ্য করেছেন, আলোর তরঙ্গ তত্ত্বের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন, গ্যাসের গতিতত্ত্ব প্রণয়নে অবদান রেখেছেন এবং পদার্থের নিত্যতার ধারণাটি নিম্নোক্ত কথায় বর্ণনা করেছেন: "প্রকৃতির সমস্ত পরিবর্তন এমনই যে, এক বস্তু থেকে যতখানি নেয়া হয়তার বিপরীতে অন্য বস্তুর সাথে ততখানিযুক্ত হয়।তাই, যদি পদার্থের পরিমাণ এক জায়গায় হ্রাস পায়, তবে তা অন্যত্র বৃদ্ধি পায়।প্রকৃতির এই সার্বজনীন নিয়মটি গতির নিয়মকেও গ্রহণ করে, কোনোবস্তু যদি নিজের শক্তিতে অন্যের স্থানান্তর ঘটায় তাহলে বস্তুটি যে শক্তি হারায় তা অন্য বস্তুটিতে স্থানান্তরিত হয়।



জ্যোতির্বিজ্ঞানী

১৭৬২ সালে, লোমোনোসভ রাশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেস ফোরামে একটি অনুধ্যায়ী (রিফ্লেক্টিং) টেলিস্কোপের উন্নত নকশা উপস্থাপন করেছিলেন। তার টেলিস্কোপের মূল প্রতিফলকটি টেলিস্কোপের অক্ষের সাথে চার ডিগ্রি কোণে সমন্বয় করা হয়েছিল।ফলে এটি মূল ইমেজ ফোকাসকে টেলিস্কোপ টিউবের পাশে নিয়ে এসেছে, যেখানে পর্যবেক্ষক ইমেজটিকে ব্লক না করে এক চোখ ব্যবহার করেই দেখতে পারে।এই আবিষ্কারটি 1827 পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি, তাই এই ধরনের টেলিস্কোপের নকশা উইলিয়াম হার্শেলবাহার্শেলিয়ান টেলিস্কোপের অনুরূপ নকশার সাথে সংযুক্ত হয়েছে। লোমোনোসভ প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৭৬১ সালে শুক্রগ্রহের কক্ষপথে শুক্রের অতিক্রমণ পর্যবেক্ষণ করে শুক্রের বায়ুমণ্ডলের অস্তিত্ব অনুমান করেছিলেন।



রসায়নবিদ

লোমোনোসভ প্রথম ব্যক্তি যিনি পারদের হিমায়িত হওয়াকে তালিকাভুক্ত করেছিলেন।তিনি প্রকৃতির পরিবর্তনের সাপেক্ষে নিয়মিত এবং ক্রমাগত বিবর্তনকে বিশ্বাস করতেন।তিনি মাটি, পিট, কয়লা, পেট্রোলিয়াম এবং অ্যাম্বারের জৈব উৎসের বর্ণনা করেছিলেন। ১৭৪৫ সালে, তিনি ৩,000 এরও বেশি খনিজের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিলেন এবং ১৭৬০ সালে তিনি হিমশৈলের (আইসবার্গ) গঠন ব্যাখ্যা করেছিলেন।



ভূগোলবিদ

লোমোনোসভের হিমশৈল গঠনের পর্যবেক্ষণ তাকে ভূগোলের ক্ষেত্রে তাঁর অবিস্মরণীয় কাজের দিকে ধাবিত করে। তিনিমহাদেশীয় সঞ্চরণ বা কন্টিনেন্টাল ড্রিফট তত্ত্বের কাছাকাছি গিয়েছিলেন, তিনি তাত্ত্বিকভাবে অ্যান্টার্কটিকার অস্তিত্বের পূর্বাভাস দিয়েছিলেন (তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে দক্ষিণ মহাসাগরের হিমশৈলগুলোর নিচে শুষ্ক ভূমি আছে।) এবং সমুদ্রের দিক ও দূরত্ব নির্ণয়ের সরঞ্জাম আবিষ্কার করেছিলেন যা সমুদ্রযাত্রায় দূরত্ব ও দিক নির্ণয়কে সহজতর করেছিল।১৭৬৪ সালে, তিনিঅ্যাডমিরাল ভাসিলি চিচাগভের নেতৃত্বে সাইবেরিয়ার উত্তর উপকূলেএকটি অভিযানের আয়োজন করেছিলেন যার উদ্দেশ্য ছিলো আটলান্টিক এবং প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যেকার উত্তর-পূর্ব দিকেরগমনপথ খুঁজে বের করা।




মোজাইকশিল্পী

লোমোনোসভ মোজাইকশিল্পের প্রাচীন ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের একজন গর্বিত অংশীদার ছিলেন। ১৭৫৪ সালে, লিওনার্ড ইউলারকে লেখা তাঁর চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে, খনিজ পদার্থের রঙের ওপররাসায়নিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে তাঁর তিন বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাকে মোজাইক শিল্পে তার গভীর সম্পৃক্ততার দিকে ধাবিত করে। ১৭৬৩ সালে, তিনি একটি কাঁচের কারখানা স্থাপন করেন যা ইতালির বাইরে সর্বপ্রথম স্টেইনড গ্লাস মোজাইক তৈরি করে। লোমোনোসভের কাছে চল্লিশটি মোজাইকচিত্রকর্ম ছিল, যার মধ্যে মাত্র চব্বিশটি আজ অবধি অক্ষত আছে। এদের মধ্যে পিটার দ্য গ্রেট এবং পোল্টাভার যুদ্ধের পোর্ট্রেট সেরা, যাদের পরিমাপ ৪.৮× ৬.৪ মিটার।



কবি

১৭৫৫ সালে, তিনি একটি ব্যাকরণ লিখেছিলেন যাওল্ড চার্চ স্লাভোনিককে স্থানীয় ভাষার সঙ্গে যুক্ত করে রাশিয়ার সাহিত্যিক ভাষাকে পুনর্গঠিত করেছিলো। তাঁর সাহিত্যচর্চাকে আরও এগিয়ে নিতে, তিনি ২০ টিরও বেশি গম্ভীর গাঁথারচনা করেছেন, এদের মধ্যে‘Evening Meditation on the God's Grandeur’বিশেষভাবেউল্লেখযোগ্য।তিনি তাঁর পরবর্তী কাব্যগুলোতে একটি স্বতন্ত্র তত্ত্ব প্রয়োগ করেছিলেন। কোমল বিষয়গুলোর জন্য সামনে E, I, U স্বরবর্ণধারণকারী শব্দগুলির প্রয়োজন ছিলযাতিনিপ্রয়োগকরেছেন ।আবারযেখানে এমন কিছু পরিস্থিতি যা ভয়ের সৃষ্টি করতে পারে (যেমন "রাগ", "হিংসা", "ব্যথা","দুঃখ")সেসব ক্ষেত্রেপিছনে O,U,Y স্বরধ্বনিযুক্ত শব্দ ব্যবহার করা। যাকে এখন শব্দের প্রতীকবাদ (সাউন্ড সিম্বলিজম) বলা হয় তারই একটি সংস্করণ ব্যবহার করেছেন তিনি।তিনি ১৭৬০ সালে রাশিয়ার একটি ইতিহাসগ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। উপরন্তু, তিনিভার্জিলের Aeneid এর উপর ভিত্তি করে পিটার দ্য গ্রেট সম্পর্কে একটি মহাকাব্য লেখার ব্যর্থ প্রচেষ্টাও করেছিলেন।১৭৬১ সালে, তিনি রয়েল সুইডিশ একাডেমি অফ সায়েন্সের একজন বিদেশী সদস্য নির্বাচিত হন।১৭৬৪ সালে, তিনিসেক্রেটারি অফ স্টেট পদে নিযুক্ত হন।

তিনি এক বছর পরে সেন্ট পিটার্সবার্গে মারা যান।তার মৃত্যুর পর অনেক সময় পর্যন্ত তার বেশিরভাগ অর্জন রাশিয়ার বাইরে অজানা ছিল। রাশিয়ার লোমোনোসভ শহর,চাঁদ ও মঙ্গলের একটি জ্বালামুখের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামানুসারে এছাড়াও, 1379 Lomonosawa গ্রহাণুটিও তাঁর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। ২০১৬ সালে উৎক্ষেপণ করা একটি রাশিয়ান স্যাটেলাইটের নাম ছিল মিখাইলো লোমোনোসভ।দ্য ইম্পেরিয়াল পোর্সেলিন ফ্যাক্টরি, সেন্ট পিটার্সবার্গ (১৯২৫-২০০৫) তাঁর নামে নামকরণ করা হয়। মস্কোর ডোমোডেডোভো বিমানবন্দরের নাম আনুষ্ঠানিকভাবে লোমনোসভের নামে রাখা হয়েছে। Lomonosov স্বর্ণপদক ১৯৫৯ সাল থেকে প্রচলিত হয় এবং প্রতিবছর রাশিয়ান একাডেমি অফ সায়েন্সেস কর্তৃক একজন রাশিয়ান এবং একজন বিদেশী বিজ্ঞানীকে এই পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। সেন্ট পিটার্সবার্গ মেট্রোর নেভস্কো-ভ্যাসিলিওস্ট্রোভস্কায়া লাইনের লোমনোসভস্কায়া স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছে তাঁর নামে।

তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গে ১৭৬৫ সালের ৪ এপ্রিল (আনুমানিক) মারা যান।তিনি "রাশিয়ান বিজ্ঞানের জনক" হিসাবে বিবেচিত। যদিও তাঁর অনেক বৈজ্ঞানিক কৃতিত্ব রাশিয়ার বাইরে তাঁর মৃত্যুর পর অনেকদিন পর্যন্ত অজানা ছিল এবং শুধু ঊনিশ এবং বিশেষত বিশ শতকের শেষের দিকে তাঁর কাজ যথাযথ প্রশংসা অর্জন করেছিল।
-----------------------------------
লোমোনোসভের লেখা কবিতা 'মেরু জ্যোতি' দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নীচের কবিতাটি রচনা করেছেন সর্বজনপ্রিয় ও শ্রদ্ধেয় ব্লগার ডঃ এম আলী ভাই; (তাঁর অনুমতি সাপেক্ষে লেখাটি মুল নিবন্ধের সাথে জুড়ে দিলাম)

ঈশ্বরের মহত্ত্বের উপর একটি সন্ধ্যার ধ্যান,
(কবিতাটি মেরু জ্যোতি হতে অনুপ্রাণিত)
মূল : মিখাইল লমোনসভ [১৭১১-১৭৬৫]

দিবস মুখ লুকিয়েছে সন্ধায়;
মাঠ শুয়ে আছে রাতের আঁধারে;
সূর্য রশ্মি আমাদের থেকে সরে গেছে দুর,
কালো ছায়া রেখেছে ঢেকে পাহাড়ের ধার।
অগণিত তারাগুলি আনন্দে ঝলমল করে
গভীর অতল গহ্বরে।

ছোট ছোট দাগের মতো সাগরের তরঙ্গ
অনন্ত হিমের মাঝে একটি স্ফুলিঙ্গ,
অগ্নিশিখার একটি পালক,
ঘূর্ণি হাওয়ায় ধুলোর কুঁচি ছুঁড়ে গেল,
এসবের মধ্যে এভাবেই নীজকে হারিয়ে ফেলি
বিশাল স্থানিক ব্যপকতায়!

জ্ঞানীরা করেন ঘোষণা সেখানে আছে
নাবলা বৈচিত্রময় বিশ্ব,
অতীতের সূর্যের সাথে গণনা বা তুলনা,
এবং প্রাচীন ইতিহাস সহ জাতিস্বত্যা:
তাদের প্রকৃতি, পৃথিবীর সাথে করে যা লড়াই,
সমান মূল্য দিয়ে কর ঈশ্বরের প্রশংসা ।
হয়েছে কি তোমাদের, প্রকৃতির নিয়ম?

উত্তরে হয় ভোর!
সেখানে কি জ্বলছে সূর্যের সিংহাসন
নাকি সমুদ্রের বরফ জ্বলন্ত আনন্দে উদ্ভাসিত?
রাতের আঁধার ভেদ করে আসে উজ্জ্বল প্রভাত,
তার শীতল শিখা আমাদের করে আবৃত.
হে জ্ঞানীগন, তোমাদের দ্রুতগতির নয়ন
অবিনশ্বর আইনের বইয়ে কর নিবদ্ধন
সামান্যতম লক্ষণে উপলব্ধি কর
সমগ্র মহাবিশ্বের চিহ্নসকল ।

গ্রহগুলি কোথায় যায় সেই পথগুলি কি জান:
তখন প্রার্থনা কর আর বল এত নিদর্শন কে দেয়!
কোথা থেকে আসে এই আলোর রশ্মিগুলো,
নহে বজ্র, পৃথিবী থেকে শীর্ষে ঊর্ধ্বমুখী,
পরিষ্কার মেঘহীন শীতের রাতে,
সকলই কি স্বর্গে বোনা পাতলা আলোক শিখা ?

রহস্যময় প্রকৃতি কেমন করে বহন করে
হিমায়িত বাতাস থেকে এমন আতশবাজি?
হয়তো সেসব কিছু সূর্যোদয়ের রশ্মি
কিংবা হেলান দেওয়া ভুল কুয়াশার চাদর;
সিঞ্চিত জলধারায় আলোড়িত নিকশ আঁধার;
অথবা ভোরের -জ্বলন্ত পর্বতচূড়া;
কিংবা সমুদ্র নিঃশ্বাসিত পশ্চিমা শূন্য বাতাশ ,
যা মসৃণ তরঙ্গ ইথারকে করে ফেলে দৃঢ়।
বিজ্ঞানীগন ,তোমাদের কথাতেও সন্দেহের বলয়
অনন্ত জিনিস দূরেও যায়না করা গোপন.
তাহলে পৃথিবীটা কত বড়?
পশ্চিমের তারার পিছনে কী আছে লুকিয়ে?
তোমরা কি কেয়ামত দিবসের কথা করেছ গণন ?
কিংবা স্রষ্টার মাহাত্ম্য করেছ কি পরিমাপন ?
--------
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মার্চ, ২০২২ সকাল ৭:৫৫
২৪টি মন্তব্য ২২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×