বহুদিন ব্লগে নিজের গল্প লিখি না। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মনস্তাত্ত্বিক-ভাবে জটিল হয়ে যাচ্ছি।ইদানীংকালের লেখায় সে ভাব স্পষ্ট।
আজকাল নিজের গল্প বাদ দিয়ে ‘বনের মোষ’ তাড়াচ্ছি। বুঝে না বুঝে জটিল থেকে জটিলতর বিষয় নিয়ে গাল-গপ্পো করছি। অথচ কত-শত নিজের গল্প জমে আছে- কিংবা প্রতিনিয়ত কতই না গল্প জমা হচ্ছে। আমার লেখালেখির শুরু যখন তখন কল্পনাতেও আসেনি কোন একদিন ব্লগ হবে, কিংবা সামাজিক মাধ্যম সারা বিশ্বের লেখকদের মনের ভাব প্রকাশের একটা বড় মাধ্যম হয়ে উঠবে। টুক টাক নিজের মনে লিখতাম- ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিনি কখনো।
আমার আজকের লেখা তখনকার সময়ের ‘তিন চাকায় বাঁধা জীবন’ নামের একটা সিরিজের খণ্ডিত অংশ। এই সিরিজটা ছিল রিক্সা চালকদের বিচিত্র জীবন আচার আচরণ নিয়ে বাস্তব ঘটনা। আমি ধারনা করছি ব্লগের প্রায় সবাই জীবন চলার পথে এমনতর কিছু ঘটনা দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন। আমার পাশাপাশি সবাই তাদের সেই ঘটনাগুলো শেয়ার করবে বলে আশা করছি।
***
সাল ২০০০; খুব ভোরবেলা । ভাল করে আলো ফোটেনি । শীত সমাগত তাই চারিদিক ঘিরে আছে হালকা কুয়াশার চাদর। আমি আসছিলাম আমার এক বন্ধুর বাসা থেকে সারারাত জেগে আড্ডা দিয়েছি । আড্ডা শেষে সবাই যখন ঘুমোবার বন্দোবস্ত করছিল তখন আমি বের হয়ে এসেছি , উদ্দেশ্য বাসায় গিয়ে ঘুমাব- কারন নিজের বিছানা ছাড়া আমার ঘুমটা ভাল হয়না ।
হালকা একটা টি শার্ট পরে ছিলাম যদিও একটু একটু শীত করছিল তবে শীতটা উপভোগ করছিলাম । গলি থেকে বের হয়ে প্রধান রাস্তায় এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম রিক্সার জন্য । কিন্তু এত ভোরে হয়তো রিক্সা নিয়ে কেউ বের হয় না মিনিট দশেক এভাবে অপেক্ষার পরে এভাবে দাড়িয়ে না থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়াই সমীচীন মনে করলাম। ওখান থেকে আমার বাসার দূরত্ব ছিল প্রায় চার কিলোমিটারের মত । এটুকু পথ হেটেই যাওয়া যায় কিন্তু রাত্রি জাগরণের জন্য শরীরটা খুব অবসন্ন লাগছিল । হাটতে হাটতে প্রায় কিলোমিটার খানেক চলে এসেছি কিন্তু রাস্তা একদম ফাকা একটা রিক্সাও নজরে আসছিল না চারিদিকে সুনসান নীরবতা এই আমাদের ঢাকা শহর ভাবাই যাচ্ছিল না মনে হচ্ছিল আমি হয়তো ভুল করে অন্য কোথাও এসে পরেছি । নিস্তব্ধতা ভেদ করে শুধু দু’য়েকটি ট্রাক দুরন্ত গতিতে শব্দের ঝড় তুলে চলে যাচ্ছিল । আচমকা কোত্থেকে এক রিক্সা চালক আমার পাশ ঘেঁষে তার রিক্সা নিয়ে দাঁড়াল ।
হাসি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করল ’যাবেন?’
আমি অবাক হলাম আরে এযে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি। ভাড়া বা গন্তব্য কিছুই না বলে তার রিক্সায় চেপে বসলাম।
চালকটি সিটে বসে হেলে-দুলে মনের সুখে রিক্সা চালাচ্ছিল।তার রিক্সা চালানোর ধরন নাদুস-নুদুস চর্বি বহুল দেহ ও সুখী চেহারা আমাকে বিস্মিত করল।
তাকে দেখে আমার বদ্ধমূল ধারনা হল নিকট অতীতে এর অবস্থা নিশ্চয়ই সচ্ছল ছিল। আকস্মিক কোন দুর্ঘটনার জন্যই হয়তো সে বাধ্য হয়েছে রিক্সা চালাতে; কিন্তু রিক্সা চালানোর ধরণ দেখে মনে হচ্ছে রিক্সা চালিয়ে সে বেশ মজা পাচ্ছে ও ব্যাপারটাকে সে দারুণভাবে উপভোগ করছে। তার যে শারীরিক গঠন তাতে রিক্সা চালাতে তার কষ্ট হওয়ারই কথা- তাছাড়া আমি যা ভেবেছি তেমন পরিস্থিতিতে যদি কেউ বাধ্য হয় রিক্সা চালাতে তাহলে তার মানসিক অবস্থা কি হবে তা সহজেই অনুমেয়। স্ব ভাবতই তার চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ পরতে বাধ্য। আমার খটকা লাগল তাকে জিজ্ঞেস না করে পারলাম না,’ভাই আপনে কি নতুন রিক্সা চালান ?’
সে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে রহস্যপূর্ণ হাসি হেসে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল ,’না’।
’কিন্তু আপনার রিক্সা চালনা দেখে তো মনে হচ্ছে আপনি নতুন চালক?’
সে মুখ না ঘুড়িয়েই আমার প্রশ্নের উত্তর দিল তবে এবার সংক্ষিপ্ত নয় বিস্তারিত। যদিও কথা বলছিল রিক্সা চালাতে চালাতে কিন্তু আমার শুনতে একটুও সমস্যা হচ্ছিল না কেননা রাস্তা ছিল একদম ফাঁকা নিরিবিলি।
’জন্ম তার এক অতি দরিদ্র পরিবারে। অর্থনৈতিক দীনতার জন্য জীবনের শুরু থেকেই চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে ,তার বাবা খুব অল্প বয়স থেকেই তাকে বাধ্য করত বিভিন্ন কষ্টকর কাজ(তখনকার কিশোরের দৃষ্টিতে)করার জন্য । তবে বাবার অলক্ষ্যে মায়ের প্রচেষ্টায় সে কয়েক ক্লাস পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে।অন্য সবার মত সেও স্বপ্ন দেখত বড়লোক হবার। ভাবত; এই পরিবেশ থেকে পালিয়ে গেলেই সে নিশ্চিত কয়েক বছরের মধ্যে বড়লোক হয়ে যাবে ।তবে কিভাবে এ চিন্তা কখনই তার মাথায় আসেনি। প্রায়ই সে সুযোগ খুঁজত বাড়ি থেকে পালানোর তবে সুযোগ পেলেও সাহসে কুলোতো না। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার অরো অবনতি হল,তখন সে সবে কৈশোর পেরিয়েছে। একদিন চরম সিদ্ধান্ত নিল,সাহসে ভর করে একটি ট্রাকের পিছনে চেপে পালিয়ে আসল ঢাকা।
কপর্দক শূন্য অবস্থায় কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারল কি ভুলটাই না সে করেছে। ক’দিনেই তার দ্রুত বড়লোক হবার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। তখন বেঁচে থাকার সম্ভাব্য যে কিছু করতে সে প্রস্তুত। কোন পথ না পেয়ে অগত্যা আদিম ব্যবসা ভিক্ষাবৃত্তি শুরু করল।
বেশ কিছুদিন ভিক্ষা করেছিল। যে বস্তিতে থাকত সেখানকারই একজনের অনুপ্রেরণায় সে ভিক্ষা পেশা ছেড়ে রিক্সা চালাতে শুরু করল। তখন ঢাকায় রিক্সার সংখ্যা ছিল নগণ্য। বছর তিনেক রিক্সা চালানোর পর তার মাথায় একটা ব্যবসায়িক বুদ্ধি চাপল;নিজের কিছু জমানো টাকা ছিল। তাই দিয়ে সে দুটো জরাজীর্ণ রিক্সা কিনে অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চলার উপযোগী করল তারপর সেগুলো কিস্তিতে বিক্রি করল।
তবে বিক্রির আগে ক্রেতার(চালক) সাথে চুক্তি (মৌখিক)করল যতদিন তারা কিস্তির টাকা শোধ না করতে পারবে ততদিন তাকে ভাড়া দিতে হবে। বস্তিবাসী দরিদ্র ক্রেতারা সানন্দেই তার এই শর্ত মেনে নিল।
কয়েক বছরের মধ্যেই এভাবে সে অনেকগুলো রিক্সা বিক্রি করল। আয় যখন বাড়তে শুরু করল তখন সে রিকসা চালানো ছেড়ে দিল। পরিবর্তে সে খুব অল্প দামে একটা জায়গা কিনে রিক্সা গ্যারেজ করল। সেখানেই শুরু করল পুরনো রিক্সা জোড়াতালি দিয়ে নতুন রিক্সা বানানোর কাজ।
হাতে তার তখন প্রচুর কাঁচা পয়সা। দু’জন কর্মচারী রেখে তাদের কে গ্যারেজের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সে হাত পা ছাড়ল। জীবনের বেশীর ভাগটাই সে অতি কষ্টে কাটিয়েছে এবার একটু বিশ্রাম নিতে চাইল। প্রায় সারাদিন শুয়ে বসে কর্মহীন দিন যাপন করতে লাগল।
অলস জীবন যাপন ও সুস্বাদু ভোজন তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করল। স্বভাবতই সে দ্রুত মুটিয়ে যেতে থাকল- সেই সঙ্গে আলগা হতে থাকল তার শরীরের মজবুত বাঁধন।
এর পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের জীবাণু এসে স্থায়ী বাসা বাঁধতে লাগল সেই চর্বি-বহুল আপাত সুখী দেহে।
রোগ সারাতে অগত্যা তাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হল। ডাক্তার ঔষধের পাশাপাশি তাকে পরামর্শ দিল ওজন কমাতে। বছর দুয়েক ধরে সে অনেক ভাবে চেষ্টা করেছে, কিন্তু ওজন তো কমছিলই না বরং আরও বেড়ে যাচ্ছিল। শেষ মেষ সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার পুরনো পেশা অর্থাৎ রিক্সা চালনাকেই বেছে নেয়ার।
কথা বলতে বলতে আমার বাসার কাছে এসে পড়লাম। রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিতে চাইলে সে কোন মতেই নিল না।বলল,’আপনাদের দোয়ায় আল্লা আমাকে অনেক দিয়েছে!’
বিস্মিত আমি তাকে শেষ প্রশ্ন করলাম,’আপনার স্বপ্ন কি পুরন হয়েছে?’
আমার প্রশ্ন তাকে কিছুটা হয়ত বিব্রত বা বিভ্রান্ত করল! সে মুহূর্তকাল চুপ থেকে ঘামে ভেজা চকচকে মুখে আমার দিকে চেয়ে বলল,’জ্বী,এখন আমি শতাধিক রিক্সার মালিক ,মিরপুরে আমার নিজের চারতলা একটা বাড়ি আছে। ছেলেমেয়েদের ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি। এর থেকে বড় স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য আমার ছিল না।’
কথা শেষ করে সে বিদায় নিয়ে রিক্সা ঘুড়িয়ে চলে গেল। আমি তার গমন পথের দিকে চেয়ে রইলাম। তার হেলে দুলে রিক্সা চালানো দেখে মনে হচ্ছিল পুরনো পেশায় ফিরতে পেরে সে দারুণ খুশী? তবে সে অবশ্যই বিরল কিছু ভাগ্যবানদের মধ্যে পড়ে।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১০:২৭