আগের পর্বঃ হুন্ডিতে খাইলো দেশ; ব্লগারদের ভাবনা কি?
প্রথমেই প্রশ্ন থাকতে পারে হুন্ডি আর অর্থ-পাচার কি এক?
উত্তরঃ এক নয় কিন্তু একে অপরের পরিপূরক!
অর্থ-পাচার কেন হয় কিভাবে হয় এবং কোন কোন খাতে অর্থ-পাচার বেশী হয়? আমরা আজ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব। তবে গত পর্বের মত এখানেও ব্লগারদের অংশগ্রহণ খুব জরুরী- আমার থেকে অনেকেই অনেক বিষয়ে ভাল জানেন। ‘গত পর্বে এমনিতেই দিনটা শুক্রবার ছিল( ব্লগ খরার দিন) তাঁর উপরে ‘হুন্ডি’র মত খটমটে ব্যাপার। ভেবেছিলাম ব্লগারেরা এড়িয়ে যাবেন। কিন্তু আমি ভীষণ অবাক হলাম ব্লগারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে!!
লেখার শুরুতেই বলে নিচ্ছি; আমি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নই এবং পুরো নিবন্ধটা মোটেও পুরোপুরি অথেনটিক তত্ত্ব ও তথ্যপূর্ণ নয়। এখানে অনেক কিছুই ধারনাগত আলোচনা আছে তবে যৌক্তিক।
আপনি কি জানেন অর্থ পাচারের সবচেয়ে বড় খাত কোনটা?
সুইচ ব্যাঙ্কে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার কোটি টাকা জমা হচ্ছে যার বড় অংশ পাচার-কৃত। এদেশ থেকে পাচার করা অর্থে বিশ্বের বহু উন্নত দেশে বাড়ি গাড়ি কেনা হচ্ছে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লগ্নি করা হচ্ছে। নিশ্চিতভাবে দেশের অর্থ বা সম্পদ অবৈধ পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে এটা নির্দ্বিধায় আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশের জন্য ভীষণ ক্ষতির।
কিন্তু এই অর্থগুলো পাচার হচ্ছে কিভাবে? কেউ পকেটে করে দেশ থেকে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছে? যদি যায় তবে অন্য কোন দেশে বাংলাদেশী মুদ্রার কি কোন ভ্যালু আছে?
তাহলে? এবার ধরুন সেই টাকাকে ডলার বা অন্য কোন দেশী মুদ্রায় রূপান্তর করে লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। যিনি নিয়ে যাচ্ছে তিনি বৈদেশিক মুদ্রা পেলেন কোথায়?
সেজন্য দায়ী কে বা কাহারা? যদিও এইভাবে বড় বা মাঝারি অঙ্কের মুদ্রা বেশ কঠিন ও অপ্রয়োজনীয়। তবে এভাবেও পাচার হয় সেকথায় আমি পরে আসছি।
আর কি কি খাতে বড় অঙ্কের অর্থ পাচার হয়?
অবৈধ বা নিষিদ্ধ পণ্যের লেনদেনে। যেমন ড্রাগ কেনা বেচায়, সোনা কেনা বেচায়, বন্য প্রাণী ও তাঁর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, হিউম্যান ট্রাফিকিং ( মানব পাচার, মূলত; নারী-শিশু পাচার ও আদম ব্যবসা) সহ অন্য অনেক খাতে।
এর পর আসে আন্ডার ইনভয়েসিং আমদানীতে ও ওভার ইনভয়েস রপ্তানিতে। আন্ডার ইনভয়েস হয় মূলত ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য। এলসি'র অতিরিক্ত টাকাটা হুন্ডি করে পাঠানো হয়। ওভার ইনভয়েস হয় শুধুমাত্র টাকা পাচারের জন্য নয় এখানে আরেকটা খেলা আছে সেটা সবাই 'পয়েন্ট আউট' করে না।
ওভার ইনভয়েসঃ পণ্যের প্রকৃত মূল্য থেকে বেশী দেখানো। (মূলত গার্মেন্টস, পাওয়ার প্ল্যান্ট, সেবা-খাতের শুল্কমুক্ত পণ্য ও মেশিনারিজ )
আন্ডার ইনভয়েসঃ পণ্যের প্রকৃত মূল্য থেকে কম দেখানো। (রি-কন্ডিশন গাড়ি আমদানিতে অহরহ হচ্ছে)
বেশ কিছুদিন আগে একটা চামড়া-জাত পণ্যের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বেশ বড় অঙ্কের জরিমানা করা হয়েছিল একের পর এক জালিয়াতি করে রপ্তানিতে ওভার ইনভয়েসের জন্য। এই কেলেঙ্কারিতে বেশ নামী দামী সেই প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে এক্কেবারে পড়েছে।
তারা কেন ওভার ইনভয়েস করত? যদিও ওভার ইনভয়েস তারা মূলত অর্থ পাচারের উদ্দেশ্যে করত না( তবুও বিশাল অঙ্কের অর্থ-পাচার করেছে বলে প্রমাণিত হয়েছে) কিন্তু অর্থ পাচারের সাথে তারা জড়িয়ে পড়েছিল।
বাংলাদেশ সরকার চামড়া রপ্তানিতে ১০ ভাগ নগদ প্রণোদনা দেয় আর চামড়া-জাত পণ্যের জন্য দেয় ১৫%
কিভাবে অর্থ-পাচার হল( মুল বিষয়টা ধারনাগত)
রপ্তানির জন্য একটা মেয়েদের ব্যাগের সর্বোচ্চ দাম ধরা যায় ৪০ মার্কিন ডলার। এই মূল্যের প্রতিটি ব্যাগের বিপরীতে রপ্তানিকারক সঠিক কাগজপত্র দাখিল করলে ৬ ডলার ক্যাশ ইনসেনটিভ পাবেন।
ধারনা করছি ওরা যেটা করেছে ( তথ্য আছে); নিজেদের একটা প্রতিষ্ঠান (অন্য নামে) খুলেছে দুবাইতে (ট্যাক্স ফ্রি ওপেন মার্কেট)। সেখান থেকে কার্যাদেশ দিয়েছে ৫০০০০ চামড়ার ব্যাগের। দাম ২০লক্ষ ডলার।
এখান থেকে পাঠিয়েছে ক্যানভাসের ব্যাগ। শুধু চামড়ার একটা হ্যান্ডল বা ট্যাগ দিয়ে এটাকে চামড়ার ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছে। যার মূল্য ২/২.৫ ডলার সর্বোচ্চ। সেই ব্যাগ সেখানে কম দামে বা বেশী দামে অন্য কোথাও এক্সপোর্ট করছে বা স্থানীয়ভাবে স্টক-লট হিসেবে বিক্রি করছে। অথবা আগে থেকে এমন সস্তা ব্যাগের অর্ডার নিয়ে এলসি খুলছে।
বিশ লক্ষ ডলার হুন্ডির মাধ্যমে ফের সেদেশে চলে যাচ্ছে। রপ্তানিকারক সরকার ও দেশকে সব ধরনের বাঁশ দিয়ে প্রতিবার তিন সাড়ে তিন লক্ষ ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে।
এভাবে তারা নাকি পাঁচ হাজার কোটি টাকার উপরে হাতিয়ে নিয়েছিল।
এবার আসুন আরেকটা অর্থ-পাচারের গল্প শুনি;
বিষয়টা খুব স্পর্শকাতর যা অনেককেই বিব্রত করবে। আমি কোন ধর্ম-পন্থীকে হেয় করারর জন্য এই তথ্যগুলো দিচ্ছি না।
ঘটনার শুরু দেশভাগের পর থেকেই। দেশ ভাগের সময়েই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বড় একটা অংশ এদেশ থেকে চলে গিয়েছিল বা বিতাড়িত হয়েছিল। ঠিক সেইভাবে ওপার থেকেও বহু মুসলিম সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে এদেশে শরণার্থীর মত আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু এদের দুপক্ষের কেউই দুই দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পায়নি। তারা সাধারণ নাগরিকের মতই জনস্রোতে মিশে গিয়েছিল।
দেশভাগের পরেও এই ধারা অব্যাহত ছিল। তবে এবার বেশ গোপনে, রাতের আধারে! দীর্ঘদীন ধরে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে অতি সঙ্গোপনে যেন কাক পক্ষীও টের না পায় সেইভাবে হঠাত একদিন বাড়িঘর ফেলে রেখে তালা মেরে, স্বজাতি কারো জিম্মায় রেখে কিংবা গোপনে কারো কাছে বিক্রি করে দিয়ে হুট করে পালিয়ে যেত।
এই ধারা এখনো অব্যাহত আছে, কিছুটা গোপনে কিছুটা ওপেন সিক্রেট। কেন তারা যাচ্ছে; সংখ্যা লঘু থাকার কারনে, ধর্মীয় কারনে, অস্তিত্ব সংকটে ভুগে, জীবন নাশের আশঙ্কায়, উন্নত জীবনের লোভে নাকি ওপারের আত্মীয় বন্ধুদের প্রলোভনে সে কথায় আমি যাচ্ছি না।
আমার স্কুলে সহপাঠীদের মধ্যে ৩০ ভাগ হিন্দু ছাত্র ছিল আর শিক্ষক ছিল অর্ধেকের কাছা কাছি। কিন্তু এখন ছাত্রের আনুপাতিক হার নেমে এসেছে ১০ শতাংশের কমে। শিক্ষকদের কথা নাই-বা বললাম। আমার জীবনে আমি কোনদিন ওখানে হিন্দু মুসলিমদের মধ্যে অসম্প্রীতি দেখিনি। হিন্দুরা ব্যবসা শিক্ষা সব সব ক্ষেত্রেই বেশ প্রভাবের সাথে আছে। কিন্তু দিন দিন তাদের সংখ্যা কমছে। অনেকেরই শুনতে পাই পরিবার পরিজনকে ওপারে রেখে এসে এখানে ব্যবসা দেখ ভাল করছে। বছরে দু’চারবার ওপারে যাচ্ছে পরিবার পরিজনের সাথে দেখা করতে আর সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে যতটুকু পারে অর্থ আর সোনা গয়না। এমন ঘটনা বা কাহিনী একজন দু’জনের নয় শতকরা ৭০ ভাগের। সবাই এদেশে হয় টাকা কামাচ্ছে ওপারে নিয়ে যাচ্ছে অথবা অপেক্ষা করছে সহায় সম্পদ ধীরে সুস্থে বিক্রি করে সব অর্থ কড়ি একসাথে গুছিয়ে চিরতরে পারি জমানোর। এসব কথা লিখতে গেলে অনেক কথাই আসে তবে আমি পাকিস্তান আমলের কথা ধরছি না; শুধু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে যত লক্ষ হিন্দু এদেশ থেকে ওদেশে পারি জমিয়েছে তারা প্রত্যেকেই অর্থ, সোনা রূপা, গয়না,এন্টিক( জমিদার আমলের তৈজস পত্র, গয়না,কষ্টি পাথর সহ অন্যান্য মূর্তি ইত্যাদি) সহ অনেক দামী সম্পদ এদেশ থেকে নিয়ে গেছে বা পাচার করেছে এবং এখনো করছে।
এ বিষয় নিয়ে কোন সরকারই আলোচনায় যায় না। কেন যায় না। এটা মূলত রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ। বিষয়টা খোলসা হলে বহির্বিশ্বের কাছে ভুলভাবে উপস্থাপনের সম্ভাবনা আছে। সবাই ভাববে এরা ধর্মীয় ও সামাজিক নিপীড়নের জন্য এদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
কিন্তু আমি বহুভাবে আলোচনা ও বিচার করে দেখেছি। বিষয়টা তেমন মোটেও নয়। ধর্মীয়, সামাজিক ও অস্তিত্ত্ব সঙ্কটের কারনে কিছু মানুষ ওপারে গেছে এবং যাচ্ছে সত্য কিন্তু বেশীরভাগ যাচ্ছে উন্নত জীবনের লোভে। ভারতের মত শক্তিধর একটা দেশের নাগরিকত্ব লাভের জন্য।
এদের পাচার করা অর্থ ও সম্পদের হিসাব কোনদিনও জানা যাবেনা। ওপার থেকে মাঝে মধ্যে হুমকি আসবে বাংলাদেশ থেকে এত কোটী লোক অবৈধভাবে ওদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। কিন্তু কত হাজার লক্ষকোটি টাকা ও সম্পদ তারা নিয়ে গেছে সে হিসেব ও কেউ দিবে না কেউ চাইবে ও না।
*কেউ স্বীকার করুক আর না-ই করুক আমার ধারনা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশী অর্থ-পাচার হয়েছে এই খাতে।
***
আপনি কি জানেন আমদানিতে ওভার ইনভয়েস হয়?
হয় খুব বেশী রকমের হয়- এটা মূলত টাকা পাচারের সবচেয়ে বড় খাত!
এখানে চলে বড় বড় গেমারদের খেলা।
আমদানিতে সেই সব ক্ষেত্রে ওভার ইনভয়েস হয় মূলত যেই পণ্য ট্যাক্স ফ্রি বা একান্তই মামুলি ট্যাক্স।
এর মুল খাত হচ্ছে গার্মেন্টস সহ রপ্তানিমুখী বিভিন্ন-কারখানার মেশিনারিজ ও জনস্বার্থে দেশীয় উৎপাদনের সাথে জড়িত কিছু ফ্যাক্টরির কাঁচামাল, মেশিনারিজ ও পণ্যের।
দেশের ব্যবসায়ী,আমলা ও রাজনীতিবিদদের একতা বড় অংশ(যারা মূলত টাকা পাচার করে) এই খাতে পাচার করে বলে ধারনা।
ধরুন আপনি একটা পাওয়ার প্ল্যান্টের অনুমতি পেলেন। প্ল্যান্ট মেশিন কিনলেন রিফার্বিস্ট (রি কন্ডিশন)। দরাদরির পরে দাম নির্ধারিত হোল ২৫ মিলিয়ন ডলার।
একে-তো পাওয়ার প্লান্ট তাঁর উপরে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতার জোরে; বেশ বড় অঙ্কের ব্যাঙ্ক লোণ ও অতি অল্প মার্জিনে এল সি খোলার অনুমোদন পেলেন। মেশিন বিক্রেতাদের সাথে যোগসাজশে ক্রয় মূল্য দেখালেন ৩৫ মিলিয়ন। ১০ মিলিয়ন প্রথমেই গাপ (হজম করা)। কইয়ের তেলে কই ভাজা আর কাহাকে বলে। * হিসাব কিতাব কিংবা ধারনায় ভুল হইলে আওয়াজ দিয়েন।
আরেকখানা খাত যেটার জন্য দায়ী ইপিজেড এর বিদেশী ইনভেস্টরেরা। এখানে কিছু প্রবাসী ও দেশী যৌথ ইনভেষ্টর ও জড়িত আছে। ইপিজেডে অবস্থিত ফ্যাক্টরির পুরো রপ্তানিমুখী হওয়ার দরুন রপ্তানিতে সম্পূর্ণ ট্যাক্স ওয়েভার(ছাড়) পায়(সম্ভবত) এবং বিদেশী অর্থলগ্নি কারকেরা তাদের লভ্যাংশ নিজ দেশে নিয়ে যেতে পারেন।
কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে, বৈধভাবে টাকা নিয়ে গেলে এই দেশে এবং তাঁর নিজের দেশে দুইখানেই বেশ বড় অঙ্কের ট্যাক্স দিতে হয়।
দুপক্ষের কিংবা এক পক্ষের এই ট্যাক্স ফাঁকি দেবার জন্য তারা অন্য একটা রাস্তায় টাকা পাঠায়। সেটা হচ্ছে আমদানিতে ওভার ইনভয়েস করে। ইপিজেডের সব ফ্যাক্টরিরই যে কোন মেশীনারিজ আমদানিতে কোন ট্যাক্স দিতে হয় না!
ধরুন টাকা যাবে জার্মানিতে। জার্মান থেকে একটা ‘বয়লার’ আনল ২ লাখ ডলার দিয়ে কিন্তু সেটার মূল্য দেখানো হোল ৪ লাখ ডলার। বয়লার বিক্রেতা অতিরিক্ত টাকা(যদি ট্যাক্স দিতে হয় তবে সেটা বাদ দিয়ে) বাকি টাকা ওই দেশে সেই কোম্পানিকে প্রদান করল। এখানে আরো কিছু বিষয়াদি ও ঘাপলা আছে যার বিষয়ে আমি পুরোপুরি অবগত নই। সম্ভবত ‘সিস্টার কনসার্ন’ ছাড়া ওইসব দেশে এই লেনদেনটা করা সম্ভব নয়!
তবে কাহিনী সত্য।
আমার আলোচিত উপরোক্ত বিষয়গুলো নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা কিংবা সমালোচনা করা যেতে পারে।
প্রিয় ব্লগার আপনার কি অর্থ পাচারের অন্য কোন খাত সন্মন্ধে সম্যক ধারনা আছে? জানার অপেক্ষায় রইলাম …
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:২১