সামনের নির্বাচনে অনেকেই চরমভাবে হতাশাগ্রস্থ হবে যদি এই টার্মে হাসিনা সরকার ক্ষমতায় না আসে।
কেন? তবে কি তারা আওয়ামীলীগের অন্ধ সাপোর্টার? না সুবিধাভোগী? ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। এই মুহুর্তে তারা শেখ হাসিনার বিকল্প কাউকে দেখছে না। আমিও মনে হচ্ছে এই দলের বাইরে নই -আমার মত অনেকেই ভাবছে অন্য যে কোন দল ক্ষমতায় এলে দেশটা ছ্যাড়াবেড়া হয়ে যাবে।
তাঁর মানে দেশটা কি এই মুহুর্তে ছ্যাড়াবেড়া অবস্থায় নেই।?
জ্বালানী-বিদ্যুতের এই অবস্থা কেন? দ্রব্য মুল্যের নিয়ন্ত্রন ভার কার হাতে? এর উর্ধমুখীর পাগলা ঘোড়াকে কেন থামানো যাচ্ছে না? সাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের এই দুরবস্থা কেন?
এটা নির্বাচনের বছর। এক দল আন্দোলন করছে তত্ত্ববধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের জন্য। ওদিকে দেশী বিদেশী চাপ আছে সুস্থ্য ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য।
চারিদিকে চাপ চাপ আর চাপ- এই মুহুর্তে সরকারের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকার সাধারণ জনগনকে না ক্ষেপানো আগামী নির্বাচনে নিজেদের গায়ের চামড়া বাঁচানোর জন্য প্রয়োজন অন্তত দ্রব্যমুল্যের লাগাম টেনে ধরা। প্রয়োজনে রিজার্ভের উপর ঝুঁকি নিয়ে পর্যাপ্ত তেল কয়লা গ্যাস আমদানী করে ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখা। গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জন্য সারা বিশ্বের আবহাওয়া ভয়ঙ্কর বিরূপ আচরন করছে। গরম এবার বিগত দিনের সব রেকর্ড ভঙ্গ করছে। এই গরম আর দ্রব্যমুল্যে মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা! শুধু উচ্চবিত্ত বাদে দেশের বাকি সব নাগরিকের ত্রাহি অবস্থা! যেখানে যাবেন একই কথা বিদ্যুৎ আর দ্রব্যমূল্য নিয়ে আলোচনা। মানুষ বাইরেও টিকতে পারছে না ঘরেও না। ব্যাপারটা কেউ কোন আমলেই নিচ্ছে না।
নির্লজ্জের মত মন্ত্রীরা যখন তখন একটা বয়ান দিয়েই খালাস;
আশা করা যাচ্ছে এই মাসের মধ্যে বিদ্যুতের সমস্যার কিছুটা সমাধান হবে।
অন্যান্য দেশের তুলনায় এখনো বাংলাদেশের দ্রব্যমুল্য সহনীয় পর্যায়ে আছে।
আর কতদিন এইসব বয়ান আর বাণী দিয়ে চলবে???
শতকরা নব্বুইভাগ সাধারণ মানুষের এইবারের বাজেট নিয়ে কোন আগ্রহ ছিল না। অথচ এক সময়ে আমরা বাজেটের দিনে টিভির সামনে সেঁটে থাকতাম। রাস্তা ঘাটে মানুষ রেডিও কানে ধরে রাখত।
বাজেট শেষে এবার সবারই একই প্রশ্ন; কোনটা কোনটার ফের দাম বাড়ল?
আমার এক পরিচিত দশ দিন আগে এয়ার কন্ডিশন কেনার টাকা দিয়ে আসছে শো-রুমে কিন্তু এখনো বুঝে পান নাই। গতকাল আমি একটা স্ট্যান্ড ফ্যান কেনার জন্য কমপক্ষে বিশখানা শো-রুমে ঘুরেছি, সবার স্টক শেষ। ওয়ালটনের শো-রুম পর্যন্ত বলছে; এক সপ্তাহ আগে ওরা চাহিদা দিয়েছে এখনো মাল আসেনি।
আই পি এস এর চৌদ্দ হাজার টাকার ব্যাটারি ২৫ হাজার টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিদিন সারা দেশ জুরে হাজার হাজার আইপিএস বিক্রি হচ্ছে। নাভানা, রহিম আফরোজ, হ্যামকো ব্যাটারি সাপ্লাই দিতে গিয়ে অস্থির। প্রতিটা আই পিএস এ জমা হচ্ছে একটু একটু করে শত শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ!
অটোরিক্সার তান্ডবে মানুষ কোণঠাসা।
সারা দেশের অলি গলি রাজপথ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে লক্ষ লক্ষ অটো রিকসা। এরা প্রতিদিন গিলে খাচ্ছে প্রয়োজনীয় শত মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। লাইসেন্স ছাড়া এইসব মোটরযান থেকে প্রতিদিন প্রশাসন থেকে দলীয় পর্যায়ে শত কোটি টাকা চাঁদা বানিজ্য হচ্ছে। ওদিকে পঙ্গু হাসপাতালগুলোতে ৮০% রোগী ভর্তি হচ্ছে; এইসব রিক্সা আর মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার জন্য।
সেদিন আশুলিয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের কাছে জানতে চাইলাম এই এলাকায় ফ্যাক্টরির সংখ্যা কত?
তারা বলল, তাদের লিষ্টে ৩৩০০ এর মত ছোট বড় মাঝারি ফ্যাক্টরি আছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা এর থেকেও বেশী।
আশুলিয়ার কোন কোন ফ্যাক্টরিতে ২৫-৩০ হাজার ওয়ার্কার কাজ করে। বিশাল তাদের কর্মযজ্ঞ আর বিদ্যুদের চাহিদাও অনেক। এক ঘন্টা ফ্যাক্টরি বন্ধ রাখার উপায় নেই।
অথচ ওই এলাকায় প্রতিদিন এভারেজ ১০-১২ ঘন্টা বিদ্যুৎ থাকে না। প্রতিদিন হাজার হাজার জেনারেটরে লক্ষ লক্ষ লিটার ফুয়েল লাগছে। টান পড়ছে জ্বালানী তেলের রিজার্ভে আর অন্যদিকে পরিবেশ হয়ে পড়ছে চরম উত্তপ্ত!
চরম প্রতিযোগীতামূলক এই বিশ্ববাজারে নিজেদের অস্তিত্ত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করতে গিয়ে শুধু জ্বালানী তেলের মুল্য দিতে গিয়ে অনেক ছোট ফ্যাক্টরি মুখ থুবড়ে পড়ছে। এ অবস্থা শুধু আশুলিয়ার নয়-সারা দেশের।
[আপনি কি জানেন যে,কমার্শিয়াল বিদ্যুৎ লাইন নিতে ট্রান্সফর্মার থেকে শুরু করে তাঁর খুটি মিটার সব নিজের টাকা দিয়ে কিনতে হয়?
এরপরে চরম হাস্যকর ও অমানবিকভাবে প্রতি মাসে প্রিপেইড (পোষ্ট পেইড নয় কিন্তু) লাইনের জন্য প্রায় দুই হাজার টাকা চার্জ দিতে হয়- সে আপনি বিদ্যুৎ ব্যাবহার করেন বা না করেন। বিদ্যুতের মুল্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই চার্জ বেড়ে যায়!]
আগে যারা দেড়-দুলাখ টাকা বেতন পেত- দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি হলে তাদের গায়ে তেমন কোন আঁচ লাগত না। কিন্তু এখন লাগছে। দ্রব্য মুল্যের অসহনীয় উর্দ্বগতি মানুষকে ভোগাচ্ছে ভীষণ।
শাসকেরা এখনো বিষয়টা গায়ে মাখতে চাইছে না। ফাঁকা বুলি আর হুমকি ধামকি দিয়ে জনগনকে 'বাইল্যা বুঝ'* দিতে চাচ্ছে-কিন্তু সেটা খুব বেশী কাজে লাগছে বলে মনে হয় না।
এ সবকিছুই সামনের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলকে ভোগাবে। প্রধানমন্ত্রী আফসোস করে বলেন এত উন্নয়ন করার পরেও মানুষ যদি আমাদের ভোট না দেয় – তাহলে আর কিছু বলার নেই।
মানুষ দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখে এই নিয়ে আলোচনা সমালোচনা করে এটা ঠিক কিন্তু তাঁর পরেই প্রায় সবার মাথায় ঘুরপাক খায় দুর্নীতির প্রসঙ্গ। যতবর প্রজেক্ট ততবড় দুর্নীতি। সরকার যতই বলুক দেশের ৯৫ ভাগ মানুষকে কোনভাবেই কেউ বোঝাতে পারবে না যে, কোন এক প্রজেক্ট একেবারে স্বচ্ছ ছিল সেখানে কোন দুর্নীতি হয়নি।
রাশিয়া উক্রাইনের যুদ্ধের দোহাই দিয়ে তেলের দাম গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম কয়েক দফা বাড়িয়ে যখন সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উতপাদনের রেকর্ড বাজিয়ে – ঘরে ঘরে বিদ্যুতের সাফল্যগাথা প্রচার করে সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে যখন লেজে গোবরে পাকিয়ে ফেলে তখন আর যা-ই হোক একে বুদ্ধিমত্বার দ্বারা সরকার পরিচালনা বলে না।
পত্রিকা ও অনলাইন মিডিয়ার কল্যানে এদেশের নাবালক পুলাপাইন ও জানে নয় মাস ধরে বাকিতে কয়লা নিয়ে দাম পরিশোধ করতে না পেরে চলমান কয়লা চালিত তাপ বিদ্যুতকেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এটা যে বন্ধ হবে তা আগে থেকেই সরকারের টপ টু বটম সবাই জানত। কয়লার দাম পরিশোধ ও নতুন কয়লা আমদানীর জন্য প্রচুর সময় হাতে থাকার পরেও কে বা কাহার ইশারায় এর উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি।
এতদিন কয়লা দিয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হল সেগুলো কি মাগনা সরবরাহ ও বিতরণ করা হয়েছে? সে টাকা কই গেল? অনেকের মনেই এই প্রশ্ন।
উত্তরঃ সে টাকা আছে যায়নি কোথাও। কিন্তু কয়লা কিনতে হবেতো রিজার্ভের টাকা মানে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। আর ঘাপলাটা ওখানেই। কেন সরকার ২৮/৩০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ থাকার পরেও এই নির্বাচনী বছরে কয়লা আমদানী করতে পারছে না?
এর একটাই উত্তরঃ আই এম এফ এর কাছে এখন দেশ ও দেশের অর্থনীতির হাত পা বাঁধা। বর্তমান সরকার নির্বাচনের আগে দৃশ্যমান দেশের বড় মাপের কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও দেশের বড় ধরনের বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য আই এম এফ থেকে লোন নিতে বাধ্য হয়েছে। আই এম এফ সুযোগ বুঝে সম্ভব অসম্ভব কিছু শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে। আর তাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়েই সবকিছু ভজঘট পাকিয়ে ফেলেছে।
লোনের দ্বীতিয় কিস্তির টাকা পাবার জন্য অমুক সময়ে রিজার্ভে এত টাকা থাকতেই হবে এই মুহুর্তে আই এম এর একটা শর্ত। এমনিতেই শত চেষ্টা করে সেই টার্গেট ছুতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে- তাঁর পরে যদি কয়লা সহ আরো কিছু বড় মাপের আমদানীকৃত পণ্য ও কাঁচামালের দাম এই মুহুর্তে শোধ করতে হয় তবে সব কিছু গিট্টু লেগে যাবে।
আই এম এফ এর লোন ক্যান্সেল হলে বিশ্ব ব্যাঙ্ক সহ অন্যান্য সাহায্য সংস্থারও পাইপ লাইনে থাকা লোন ও সাহায্য বাতিল হবার সম্ভাবনা থাকে।
সরকার একটা মাইনক্যা চিপায় পড়ছে। কিছু অর্বাচীন লোভী,দালাল ও ধান্দাবাজ, ক্ষমতালোভী লোকের পরামর্শে স্মরণ কালের সবচাইতে নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। নিজেদের জালে এমন করে পেঁচিয়ে গেছে যে, সে জাল গলে তো দূর কি বাত কেটেও বেরিয়ে যাবার উপায় নেই। বিদ্যুতের বর্তমান সঙ্কট নিরসনের জন্য একমাত্র ‘আল্লা ভরসা’ ঝড় বৃষ্টি কিংবা জুন জুলাইতে শীতের আগমন ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
***
* ভাবনাটা কিছুটা সত্যের মিশেলে আমার কল্পনা প্রসুত- ভুল ভ্রান্তি থাকা অস্বাভাবিক নয়। ব্লগারেরা এই বিষয়ে কি ভাবেন?
• এটা আমাদের এলাকার ভাষা। ‘বাইল্যা বুঝ’ মানে আলগা বুঝ যা অনেকটা বালির বাঁধের মত।
*খোদ ঢাকায় বসে আমি এই লেখার সময়ে দু’বার লোড শেডিং এর কবলে পড়েছি।*
কেউ আরো জানতে চাইলে লিঙ্কের আর্টিকেলটা পড়ুনঃ
আইএমএফ ঋণের শর্ত রিজার্ভের প্রকৃত হিসাবায়ন করতে হবে জুনের মধ্যে
ছবি-স্বত্ত্বঃ শেরজা তপন