তখন ঢাকা কলেজে পড়ছি। পড়াশুনা থেকে কার্ড খেলায় টান বেশী। কলেজে যাবার সপ্তা খানেকের মধ্যে সমমনা বন্ধু জুটে গেল। যে ক্লাস ভাল লাগে না সেটাতে ফাঁকি দিয়ে উপরে কম রুমের পাশের উঁচু নিচু ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে বসে পড়তাম তাস বিছিয়ে। এক সময় ক্লাসের সবচেয়ে নিরীহ ভদ্র অভিজাত গুডি বয় স্যালেক্স ও আমাদের দলের সাথে জুটে গেল। রঞ্জন আর ভুলু দু'জনে হরিহর আত্মা একজনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ আরেকজনের চাটগাঁ। কিন্তু ওদের পরিবার থাকত পুরাণ ঢাকায়। দু'জনেই একসাথে কলেজে আসত একসাথে বের হয়ে যেত। ভুলু একটু গম্ভীর হলেও রঞ্জন হাসিখুশি মজার মানুষ। ধনবান ব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ এর ছেলে সুঠাম দেহ, ঝকঝকে চেহারা। ক'দিনেই আমার সাথে ভাব জমে গেল! কার্ড খেলার পাশাপাশি ছবি তোলার বেশ সখ ছিল আমার। একদিন কলেজের ছাদে সবাই মিলে নেকগুলো ছবি তুলেছিলাম। রঞ্জন তাঁর এক কপি করে নিজের পয়সায় প্রিন্ট(ওয়াশ) করে নিল।
এভাবেই চলছিল কলেজে দারুণ আড্ডায় গল্প খেলা আর মাঝে মধ্যে বিরক্তিকর একঘেয়ে ক্লাস এর সাথে।
***
একদিন খেলার ফাঁকে রঞ্জন আমাকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলল, দোস্ত তোর জন্য দারুণ এক চমক আছে।
আমি বেশ উতলা হলাম জানতে, কি বন্ধু ক'না?
কমুনে তাঁর আগে দুবাই ( কিংবা হংকং মার্কেট) মার্কেটের নিচের দোকানের সিঙ্গারা খাওয়াবি। (মার্কেটের ওভার ব্রিজের সাথে যে ক্রোকারিজ ও গিফট সপের মার্কেটটা আছে তার একদম শেষ মাতায় ডানে একটা দোকান ছিল- সেখানকার সুস্বাদু সিঙ্গারার সাথে 'দই ধনেপাতা তেঁতুলের টক' দিয়ে চমৎকার একটা চাটনি দিত। সেটার লোভেই বারবার যেতাম)।
সিঙ্গারা খাবার পরে যেই ঘটনা শুনলাম; তাতে আমার হার্ট-বিট বন্ধ হবার উপক্রম!
সে আমাদের ছবিগুলো তাঁর এলাকার বান্ধবীদের দেখিয়েছে। তন্মধ্যে একজন নাকি আমার ছবি দেখে ক্রাশ(ব্যাপক অনুরাগ) খেয়েছে। সে নাকি আমার সাথে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করছে।
আমি বুঝলাম না, আমার মত দুবলা পাতলা, অতি নিরীহ এলেবেলে সুরতের একজন যুবকের প্রেমে শুধু ছবি দেখে ঢাকার কোন আধুনিকা তরুণী প্রেমে পড়তে পারে সেটা আমার ধারণ মধ্যে তো না-ই বাইরেও নাই। আমার মাথা চক্কর দিতে লাগল! নারী-ভীতি আমার তখনও কাটেনি তাঁর উপরে মেয়ে নাকি ভীষণ ফর্সা দারুণ লম্বা ও যুতসই ফিগার। শুনেই আমি ঢোক গিলতে লাগলাম- কিন্তু ঢোকটা গলার অর্ধেকখানি গিয়ে আটকে গিয়ে হাঁসফাঁস করতে লাগল।
***
কি মাইরি স্বপ্ন দেখছি না-তো!
- দোস্ত আমি মাইয়ারে কইছি তোরে একদিন নিয়া যাব। কবে যাইবি ক? নাইলে আমার ইজ্জত থাকব না।
আমি ওর দিকে ভীষণ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালাম, ও শালা না জানি আমাকে কোন আজাগা কু-জায়গায় ফাঁসিয়ে দেয়। ওর চেহারা দেখে বুঝার চেষ্টা করছিলাম, ওর ধান্দাটা কি?
আমার ভিতরে তখন শুকিয়ে গেছে। মাথার মধ্যে টিপ টিপ করছে- বুকটা মাঝে মধ্যে আবেগে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে!
ওদিকে রঞ্জন ভ্যান ভ্যান করে যাচ্ছে, কবে যাবি ক? - এখন অবশ্য ওর সাথে তাল দিচ্ছে ভুলু। সে ও সে তরুণীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ!
অবশেষে ভীষণ ইচ্ছা(!) স্বত্বতেও রাজী হয়ে গেলাম।
কথা হল সামনের শুক্রবারে বারোটার সময়ে আমি পুড়ান ঢাকার বলধা গার্ডেনের সামনে থাকব।
বলধা গার্ডেনের নাম শুনেছি শুধু তখনো জায়গাটা চিনি না।
***
শুক্রবারের আগের দুই/তিনদিন আমার ব্যাপক সাজ-গোজের মহড়া চলল। নির্দিষ্ট দিনে একেবারে শার্প ১২ টায় এরে-ওরে জিজ্ঞেস করে বলধা গার্ডেনের মুখের কাছে গিয়ে দাড়ালাম।
খানিক বাদেই রঞ্জন আর ভুলু আসল। তিন বন্ধু মিলে কোলাকুলি গলাগলি হইল। কথার ফাঁকে ফাঁকে আমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। রঞ্জন বহুত চাল্লু মাল। আমার ভাব-গতিকে ও বুঝে ফেলল, কাহিনী কি?
হেসে বলল,ওয়েট কর মাইয়া আইবো।
চল গার্ডেনের ভিতরে যাই। বলধা গার্ডেনে ঢুকে আমি তাজ্জব! কাঠখোট্টা ভিড় জ্যামে ঠাসা পুরাণ ঢাকার মরুর মধ্যে এটা যেন মরূদ্যান। স্বল্প পরিসরে ছায়া শীতল ঘন সবুজে ঘেরা পরিবেশ। তবে এত নামী দামী বাগানের পরিসর এত ছোট হবে তা ভাবিনি। কত শত বাহারি অচেনা গাছে দারুণ যত্নে বেড়ে উঠছে।
ওয়াক ওয়ের পাশ ঘেঁষে খানিক দূরে দূরে বিশ্রামের স্থান। বেঞ্চির চারপাশে গাছে লতায় এমনভাবে ঘিরে আছে যে ভিতরের আদমকে দু/চার হাত দূর থেকেও ঠাহর করা কষ্ট।
তাঁর একটাতে বসতে বসতে রঞ্জন চোখ টিপে কইল, এ জায়গা নাকি কপোলদের জন্য উত্তম স্থান!!!
এর কয়েক মুহূর্ত বাদে গেটের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ও বলল, ও-ইতো আইছে। যাই আগায়ে নিয়ে আসি।
আমি তখন ফিট হবার উপক্রম!
মেয়েটা ভীষণ ফর্সা -ঠিক আছে। কিন্তু লম্বা বলতে এমন তালগাছ সাইজ ওই শালাতো আমাকে বলেনি। কমপক্ষে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চি হবে। আর যুতসই ফিগার বলতে; মেদ ভুঁড়ি নেই কিন্তু এমন রেসলার বডি। এমন দশাসই আজদাহা ফিগারের রমণীর কথা তা আমি কস্মিনকালেও ভাবিনি। ও আল্লা কোন জায়গায় ফাঁসলাম!!
মেয়েটা এসে পরিচয় পর্বের আগেই ধপাস করে আমার পাশে মানে ঠিক গা ঘেঁষে বসল। মনে হল পার্কটা একটু কেপে উঠল।
খুব সদা-হাস্য উচ্ছল তরুণী। ওদিকে আমার বুকের ভিতরে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। আনত নয়নে বসে আছি - কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না।
তরুণী একাই বক বক করছে আর আমার জ্ঞাতি গুষ্টির খবর নিচ্ছে। ভাবটা যে সে পাত্রী দেখতে এসেছে।
আচমকা রঞ্জন আর ভুলু বলল, দোস্ত একটু বয়। আমরা একটু বাইরে থেকে হালকা স্ন্যাক্স নিয়ে আসি।
খাইছে, শালারা আমারে-তো বাঘের মুখে রেখে যাচ্ছে। লজ্জা শরমে কইতেও পারলাম না- দোস্ত আমারে ফালায় যাইস না।
ওরা যেতেই মেয়েটা আরো খানিক ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল আমার পাশে। আমি একটু চাপতে গিয়ে দেখলাম জায়গা নাই।
দু চার কথা শেষেই দেখি সে ঘর সংসার বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আলাপ শুরু করে দিয়েছে।
ও মা এ মাবুদ আমারে কই আইনা ফাঁসাইল। ওর ভাব-ভঙ্গীতে মনে হচ্ছে শেষ মেষ রেপড টেপড হয়ে না যাই।
এখন আমার ইজ্জত বাঁচানো ফরজ হয়ে গেছে!!!
আমি ফ্যাসফ্যসে কণ্ঠে কথা বলছি আর এদিক ওদিন নজর ঘুরিয়ে রঞ্জন-ভুলুকে খুঁজছি। শালারা গেছে তো গেছেই আসার নাম নেই।
আমি তখন ঘেমে নেয়ে অস্থির! প্রেম ট্রেম এর পার্ট শেষ -সে একা একাই বকর বকর করে যাচ্ছে। আর সইতে না পেরে শরীরে ভীষণ শক্তি সঞ্চয় করে আচমকা আমি উঠে দাঁড়ালাম।
মেয়েটা আমার হাত চেপে ধরে বলল, কই যাও?
আমি কোনমতে হাত ছাড়িয়ে বললাম, এই একটু ওয়াশ রুমে যাব। বলেই হাটার ভঙ্গীতে দৌড়ে দৌড়ে গেট অভিমুখে ছুটলাম।
মাঝে একবার পেছন ফিরে দেখি; সে ভাংচুর হৃদয়ে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমার গমন পথ পানে- নিশ্চিত তখন বুঝে গেছে যে আমি ভাগছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুন, ২০২৩ সকাল ৮:৪৯