পরদিন জানা গেল হার্ট এটাক করেনি- গ্যাস্ট্রিকে ভয়ঙ্কর চাপ দিয়েছিল। এমন চাপ যে বুকের ভয়ঙ্কর ব্যথায় নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছিল।
হাসপাতালে নেবার পরে ডাক্তারও উপসর্গ দেখে ভেবেছিল তেমনটাই। প্রথমেই চিকিৎসা সেভাবেই শুরু করেছিল। পরে চেক টেক করে দেখে গ্যাসের সমস্যা।
***
মাত্র দু সপ্তাহের আগের কথা; আমাদের আড্ডায় দেলোয়ার ভাই নামে মধ্য বয়স্ক এক ভদ্রলোক মাঝে মধ্যে আসেন বসেন গল্প করেন। বয়স ষাট হবে। অল্প সময়ের মধ্যে রিটায়ার্ড করবেন। গায়ের রঙ বেশ চাপা- ছয় ফুটের মত লম্বা মানুষ, বয়সের জন্যই মনে হয় একটু নুয়ে হাঁটেন। বিরলকেশী মানুষ। ভয়াবহ কৃপণ মানুষ। কাউকে এযাবৎ এক কাপ চা খাইয়েছেন বলে শোনা যায়নি।
তাঁর ধারনা তিনি খুব রস করে কথা বলেন কিন্তু আমাদের কাছে তাঁর কথাগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বিরক্তিকর ও একঘেয়ে। ভাষা বরিশালের আঞ্চলিকতায় দুষ্ট। আমরা আড়ালে তাঁকে ছামা ভাই বলে ডাকি। 'ছামা' ভাই নামের আড়ালে তাঁর আসল নাম হারিয়ে গেছে। আড্ডার অর্ধেক সভ্য তাঁর আসল নামই জানে না। দু চারজন অবশ্য সরাসরিই তাঁকে ছামা ভাই বলে সন্মোধন করে। ভদ্রলোকের একটা গুন- কখনোই কোনভাবেই রাগ করেন না।
কথা বলতে বলতে লাইন ছেড়ে পাটক্ষেত দিয়ে ট্রেন চালান মাঝে মধ্যে। একবার এই নিয়ে আমার সাথে মৃদু তর্কাতর্কি হয়েছিল। তিনি একটু গোস্বা করেছিলেন। ঘটনা এমন; তাঁর মা নাকি ১১৬ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন। সেটা আট বছর আগের কথা। তিনি নাকি তাঁর ছোট ছেলে।
আমি যখন বললাম, আপনার মায়ের মৃত্যুর সময়ে আপনার বয়স ছিল ৫২ তাহলে আপনার জন্ম হয়েছিল মায়ের ৬৪ বছর বয়সে এইটা কেমনে সম্ভব???
যাই হোক মাঝে মধ্যে তাঁকে নিয়ে মজা করতাম বেশ। তাঁর এখানে একমাত্র ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল আণবিক শক্তি কমিশনের মাল্টু ভাই( ছদ্ম নাম)। মূলত তাঁর কারণেই আমরা মাঝে মধ্যে বিরক্ত লাগলেও তাঁর কথা হাসি হাসি মুখে শুনতাম।
মাঝে মধ্যে অসুখ বিসুখের কথা ওঠে। তিনি বলেন, একটু ডায়াবেটিস, একটু কিডনির সমস্যা, প্রেশারটা একটু হাই। বুকে ব্যথা হয় মাঝে মধ্যে; আরে ভাই বুঝি গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা- সার্জিল(গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ) মেরে দেই ঠিক। আর হাটা হাটা করি- ডায়াবেটিক মোটামুটি কন্ট্রোলে। বাসায় প্রেশারের মেশিন রাখছি- নিয়মিত মাপি। ওষুধ তো খাই- ঠিকই আছে।
ডায়াবেটিক, প্রেশার যখন আছে – বুকের ব্যথার জন্য ডাক্তারের কাছে যান না কেন?
আরে ধুর ডাক্তারের কাছে গেলেই দিন দুনিয়ার টেস্ট আর গাদা গাদা ঔষধ দেবে। ফাউ পয়সা খরচ করার দরকার কি। হায়াত মউত আল্লার হাতে- আল্লা যখন নিয়ে যাবার যাবে। যতই চেষ্টা করি আমি আপনি আটকায় রাখতে পারমু কন? হেইয়া… শুরু হোতো তাঁর মিনিট পাঁচেকের বয়ান।
বার দিন আগে রাত বারটায় বুকে ব্যথা শুরু। গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ 'সার্জিল' খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা রাত দেড়টার দিকে ভয়াবহ বুকে ব্যথা সাথে নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম দেখে ছেলেমেয়ে জরুরী ভিত্তিতে হার্ড ফাউন্ডেশনে নিয়ে গেল। আই সিউ'তে ভর্তি। পরদিন সন্ধ্যে পর্যন্ত এনজিওগ্রাম করতে পারছিল না, ডায়াবেটিক আর রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে আসছিল না বলে। মাল্টু ভাই। বিকালে তাঁর সাথে দেখা করে একসাথে বসে ভাত খেয়ে খোশ গল্প করে আসলেন।
রাত নয়টায় তিনি মারা গেলেন!!! অতি স্বাভাবিক মৃত্যু- কোন ঝামেলা নেই প্যাঁচ-ঘোচ নেই।
চারিদিকে শুধু, হার্ট ফেইলরের রুগী। হাসপাতালে যাবার সময় পাচ্ছেনা- রাস্তায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। হাজার হাজার কিডনির রোগী- কিডনির আক্রমণে দিশেহারা মানুষ।
ওদিকে আরেকটা নীরব ঘাতক ইদানীং ভয়ঙ্কর-ভাবে গ্রাস করছে দিনে দিনে; অন্ত্রের ক্যান্সার!
ভেজাল, ভাজা পোড়া আর অনিয়ন্ত্রিত খাবারের জন্য আমাদের ৯৮ ভাগ বাঙ্গালী কিশোর বয়স থেকে গ্যাস্ট্রিকে আক্রান্ত হই! সেই থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত একে সঙ্গী করে ভয়ঙ্কর দুর্বিষহ এক জীবন কাটাই।
বুকে ব্যথা পেটে ব্যথা পিঠে চাপ ব্যথা , গলা জ্বললে বুক জ্বললে গ্যাস হলে বমি হলে কখনো পাউডার গুলে, কখনো লিকুইড গিলে, কখনো ট্যাবলেট চুষে আর ক্যাপস্যুল গলঃধকরন করে প্রশান্তি উপভোগ করি।
আমাদের গলা থেকে শুরু করে তলপেট পর্যন্ত কোন জ্বালা বিষ ব্যথা শুরু হলে আমরা গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা মনে করে চিকিৎসা শুরু করি। এদেশে একেবারে অগম্য পল্লীর মুদী দোকান থেকে শুরু করে পাঁচতারা হোটেলে পর্যন্ত গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ দেদারসে বিক্রি হয়। মানুষ কিনে খায় মুড়ি মুড়কির মত। আমি ও আমার চারপাশের মানুষ এর ব্যতিক্রম নয়।
আমরা টেস্টের ভয়ে- কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে আছি জেনে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ব এই ভয়ে। এদেশের ডাক্তাররা ফাউল- টেস্টের রেজাল্ট একটাও ঠিক আসেনা, আজাইর্যা গাদা গাদা টাকা খরচ। ভুল রোগ ধরা পড়লে জীবন শেষ- এইসব ভেবে আমরা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ খেয়ে খুব সহজেই অন্য ভয়ঙ্কর কিছু রোগের শুরুটাকে অবহেলা করে বাড়তে দিচ্ছি। খবর পাচ্ছি ক্যান্সার,কিডনি ও হৃদরোগের একেবারে শেষ পর্যায়ে। যখন আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার রাস্তা থাকে না।
আমাদের এই গ্যাস্ট্রিক কি শুধুমাত্র ভেজাল খাবার, অপরিমিত খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত তেল চর্বি ভাজা পোড়া খাবারের জন্য?
মোটেও নয়।
আপনি কি জানেন এই ধরনের গ্যাস্ট্রিক সেটা থেকে পেপটিক আলসার ও শেষমেশ ক্যান্সারে রূপ নেয়ার জন্য দায়ী যে ব্যাকটেরিয়া তাঁকে বলা হয়
Helicobacter pylori (H. pylori)।
যার আক্রমণে দিশেহারা পৃথিবীর কমবেশি পঞ্চাশ-ভাগ মানুষ।
এই ব্যাকটেরিয়া সংক্রামনশীল মানে চুমুর মাধ্যমেও একজনের দেহ থেকে অন্যজনের দেহে যেতে পারে। আপনি যখন আপনার বাচ্চাকে ঠোটে চুমু খাচ্ছেন তখন যে মিলিয়ন ব্যাকটেরিয়া ট্রান্সফার করছেন তাঁর সাথে এই ‘হেলিকোবেকটর পাইলোরি’ নামে ভয়ঙ্কর এই ব্যাকটেরিয়াও চালান করে দিচ্ছেন। আমার ধারনা বাংলাদেশের ৯৫ভাগ মানুষ এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের স্বীকার। আসুন আগে আমরা এই ব্যাকটেরিয়া সন্মন্ধে কিছু জেনে নিই;
*****
(পুরো তথ্য অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা, এখানে আমার কোন জারিজুড়ি নেই। তথ্যগত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পাররে- যার ভালভাবে জানার অনলাইন থেকে নিজ দ্বায়িত্বে জেনে নিবেন। আমি কোন চিকিৎসা বিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞানের ছাত্র নই। বিজ্ঞানীরা এখনো এই ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা করছেন। পুরোপুরি পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষ হয়নি। এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাঁর থেকে কিছু অংশ আমি তুলে আনার চেষ্টা করছি।)
***
ওভারভিউ
Helicobacter pylori (H. pylori) সংক্রমণ ঘটে যখন Helicobacter pylori (H. pylori) ব্যাকটেরিয়া আপনার পেটে সংক্রমিত হয়। এটি সাধারণত শৈশবকালে ঘটে। পাকস্থলীর আলসারের একটি সাধারণ কারণ (পেপটিক আলসার), H. pylori সংক্রমণ। বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ এই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের স্বীকার বলে ধারনা করা হয়।
বেশীরভাগ লোকই বুঝতে পারে না যে তাদের এইচ. পাইলোরি সংক্রমণ হয়েছে কারণ তারা কখনও এ ব্যাকটেরিয়া থেকে অসুস্থ হয় না।
**************Helicobacter pylori (H. pylori)**************
লক্ষণ
এইচ. পাইলোরি সংক্রমণে আক্রান্ত অধিকাংশ লোকের কখনই কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ থাকবে না। কেন কিছু মানুষের উপসর্গ বা লক্ষন প্রকাশ পায় এবং কেন কিছু মানুষের লক্ষন প্রকাশ পায় না তা স্পষ্ট নয়। সম্ভবত কিছু কিছু নির্দিষ্ট ডি এন এ ধারী মানুষ H. pylori- এর ক্ষতিকর প্রভাবের বিরুদ্ধে বেশি প্রতিরোধ নিয়ে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
যখন এইচ. পাইলোরি সংক্রমণের সাথে লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দেয় , তখন সেগুলি সাধারণত গ্যাস্ট্রাইটিস বা পেপটিক আলসারের সাথে সম্পর্কিত এবং এতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে:
আপনার পেটে (পেটে) ব্যথা বা জ্বলন্ত ব্যথা বা জ্বালা পোড়া
পেটে ব্যথা যা আপনার পেট খালি থাকলে আরও খারাপ হতে পারে
বমি বমি ভাব
বুকে পেটে পিঠে চাপ ব্যাথা( যা গ্যাসের চাপের ব্যাথা বলে আমরা ধরে নিই)
ক্ষুধামন্দা
ঘন ঘন চুকা দুর্গন্ধযুক্ত ঢেঁকুর
পেট ফোলা
অনিচ্ছাকৃত ওজন হ্রাস
**** এইচ পাইলোরির আক্রমনে গ্যাস্ট্রিক থেকে পেপটিক আলসার****
কখন ডাক্তার দেখাবেন
আপনি যদি গ্যাস্ট্রাইটিস বা পেপটিক আলসার হতে পারে এমন কোনো লক্ষণ এবং উপসর্গ লক্ষ্য করেন তাহলে আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করুন। আপনার যদি নিন্মের লক্ষণগুলো থাকে তবে অবিলম্বে চিকিৎসা সহায়তা নিন:
১. গুরুতর বা চলমান পেট (পেটে ও বুকে) ব্যথা যা আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে পারে
২. রক্তাক্ত বা কালো ট্যারি ( আলকাতরা) মল
৩. রক্তাক্ত বা কালো বমি বা বমি যা কফি গ্রাউন্ডের মতো দেখায়
এইচ. পাইলোরি সংক্রমণ অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে চিকিত্সা করা হয়।
এইচ. পাইলোরি: পেটের ক্যান্সারের নীরব হুমকি
H. Pylori হল এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যা পেটে প্রদাহ সৃষ্টি করে। জীবাণু দ্বারা দূষিত খাবার খাওয়ার ফলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত হতে পারে, যা এড়ানো কঠিন কারণ আমরা যে খাবার গ্রহণ করছি তার উপাদানগুলির উত্স আমরা কখনই জানি না।
H. Pylori ব্যাকটেরিয়া পেটে প্রদাহ সৃষ্টি করে যার ফলে দীর্ঘস্থায়ী পেটে ব্যথা হয়। দীর্ঘায়িত এইচ. পাইলোরি সংক্রমণ পেটের আস্তরণের বৃদ্ধিকে উদ্দীপিত করবে, যা "পেটের ক্যান্সার" হতে পারে।
হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (HP) হল একটি গ্রাম নেগেটিভ, সর্পিল-আকৃতির ব্যাকটেরিয়া, যা বিশ্বের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যার পাকস্থলীকে সংক্রমিত করে। এটি বর্তমানে বিশেষত পাকস্থলী অঞ্চলে সংক্রমণ-সম্পর্কিত ক্যান্সারের সবচেয়ে সাধারণ কারণ হিসাবে বিবেচিত হয়
তবে লক্ষণগুলো নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। পেটে ব্যথা বিভিন্ন কারণের কারণে হতে পারে। তবুও, যদি ৪ সপ্তাহের মধ্যে ব্যথার উন্নতি না হয়, ডাক্তারের পরামর্শ মত সঠিক কারণ খুঁজে বের করার জন্য রক্ত পরিক্ষা কিংবা এন্ড্রোস্কোপি অথবা ক্লোনোস্কোপি বা অন্যজাতীয় পরিক্ষা করা।
****
পরিশেষে আমার পরামর্শঃ
পেট পোড়া বুক পোড়া জ্বালা ব্যথা( বুক চিন চিন করছে হায় মন তোমায় কাছে চায় টাইপের) এইসব থাকলে আজাইর্যা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ না খেয়ে ডাক্তার দেখান আর ভাল একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে এই রক্ত পরীক্ষাটি করান;
***** তবুও বলছি; আইন আর চিকিৎসা নিজের হাতে তুলে নিবেন না****