আমাদের বাজারে সারাবছর মাছই বিক্রি হত আর এক পাশে হাস মুরগীর ডিমাশে পাশের দশ বিশ পঞ্চাশ গ্রাম আর চরের মানুষ সদাই পাতি আনাজ মাছ দুধ নিয়ে আসত সেখানে বিক্রি করতে। বেশ বড়বাজার ছিল সেটা- এখন আরো বড় হয়েছে। সপ্তাহে দুটো হাট বসত। সেই হাটে অন্য সব কিছুর সাথে ছাগল আর মুরগী বিক্রি হত। গরু কদাচিত আসত। গরু বিক্রি হত আরো বড় হাটে। আমি ছোট বেলায় আমাদের বাজারে এমনি দিনে কোনদিন মাংস বিক্রি করতে দেখিনি। হাটবারে কখনো সকনো একটা গরু জবাই হলে হুলস্থুল পড়ে যেত! কিন্তু যে কসাই জবহ করত তাঁর কম্মো সাবাড় হত। সারাদিন একটা গরু পুরো বিক্রি করতে গিয়ে সে ঘেমে-নেয়ে সারা হত। বেশীরভাগ মানুষই একপোয়া, আধা-কেজি মাংস নিত। তারপর কত বেছে বেছে। শেষ মেষ একগাদা হাড়-গোর আর চামড়া নিয়ে সে যে কি বিপাকে পড়ত। তবে তখন মানুষ সেধে সেধে চর্বি নিত তখন, কিন্তু মাগনা দিতে হত!
সারা বছর শাক-সব্জী ডিম আর উদরপূর্তী করে মাছ খেতাম আমরা। পদ্মার পাড়ে বাড়ি হওয়ায় মাছের অভাব ছিল না কখনো। গোয়ালন্দে দক্ষিন বঙ্গের সবচেয়ে বড় মাছের মোকাম ছিল। সারারাত বড় বড় মাছের আড়ত থেকে ট্রাকে করে মাছে এসে ওখানে বরফ দিয়ে প্যাকিং হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে যেত। আমরা গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে আড়তের বরফ ভাঙ্গার ধুপ ধুপ করে শব্দ পেতাম!
২০কেজির রুই ৩০ কেজির কাতল ৪০/৫০কেজির পাঙ্গাস কত খেয়েছি তাঁর ইয়ত্বা নেই। আর ইলিশ ছিল নিত্য দিনের খাবার। কিছু না থাকলেই- ইলিশ ভাজা ইলিশের চচ্চরি, ইলিশের ঝুড়ি, ইলিশের ডিমের দোপেঁয়াজি -চলেছেই এসব। ফ্রিজ ছিলনা তখন। সিজনে প্রচুর ইলিশ আসত মোকামে। এছাড়া আমার আব্বা এক জেলেকে তখনকার দিনে ৫০০ টাকা ধার দিয়েছিল- সে প্রতিদিন তাঁর জালে ধরা বড় একটা ইলিশ মাছ পাঠাত আমাদের বাড়িতে। আব্বা রাতে বাসায় আসলে দুহাত ভর্তি ইলিশ থাকত। তিনি ভয়ানক ইলিশ পাগল মানুষ ছিলেন। এত ইলিশ ক্যামনে খাব!
মা এগুলো কেটে ধুয়ে পিস করে মাঝারি মাটির হাড়িতে শুধু বেশী করে লবন দিয়ে শীকেয় তুলে রাখতেন। ব্যাস হয়ে গেল। সিজনের পরে কয়েক মাস ধরে এই হাড়ির ইলিশ দিয়ে দিব্যি চলে যেত। রান্নাঘরে এমন খান বিশেক হাড়ি ঝোলানো থাকত। সেই নোনা ইলিশ বাজারের কেনা নোনা ইলিশের মত বাজে স্বাদ নয়। একটু লবন বেশী হলেও আমাদের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল। তবে কি তেলে ভরা সরেস সে মাছ। কখনো কাঠালের বিচি আর কচি ডাটা দিয়ে, কখনো আলুবেগুন দিয়ে পোড়া-পোড়া চচ্চড়ি হত। লাকড়ির চুলার সে রান্না ছিল অমৃত। আউশ চালের মিঠে মিঠে ফেনা ওঠা ভাত আর সরিষার তেলে সেই ইলিশ ভাজি সাথে একটা মরিচ পোড়া সহযোগ সদ্য পাঁচফোড়ন দেয়া মশুর দাল হলে তো কথাই নেই। লবন দেয়া ইলিশের বড় বড় ডিম ডোম-ডোম পিয়াজ আর কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাজি আর শুকনো লঙ্কা- এখন সে দিন পেলে নির্ঘাত খেতে খেতে মরেই যাব।
কিন্তু কেন যেন মাংস আমাদের তেমন বরাতে জুটত না। মুরগীটা খেতাম শুধু কোন আত্মীয় বাড়িতে এলে। হাটবার হলে বাজার থেকে কিনে আনতাম- নাহয় কোন গরিব প্রতিবেশী টাকার অভাবে বিক্রি করত কিংবা নিজেদের মুরগী হাত-পা ছিলে জাল-পোলো দিয়ে ধরে বহু কসরতে ধরে আল্লাহু আকবর আল্লাহু আকবর বলে জবাই করতাম। সেই একখানা/ দু'খানা মুরগীর বিশজন ভাগীদার। মা ঠিকই এক টুকরো করে রাখত আমাদের জন্য -সাথে একটু আলি একটু চামড়া, কলিজা, গিলে বা মাথা। রান্নার সময়ে সারা বাড়ি গন্ধে ম ম করত। দারুণ একটা উৎসব উৎসব ভাব হত সেদিন।
বিয়ের অনুষ্ঠানেও তখন গরু জবাই হত না বিশেষ একটা। সম্ভবত প্রচুর হিন্দু অতিথি হবার জন্য। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাসি জবাই হত। আমরা তখন রাস্তা দিয়ে ঘুরে বেড়ানো আল্লার ষাড় দেখেছি- দিল্লীর সেই মানত করা গরুর মত। সারা বছরে দু'চারবার বিয়ে বা অন্য সুবাদে সেই খাসির মাংস খাওয়া হত। আর গরুর মাংস; মনে করতে পারি ভাল করে বছরে ওই একবারের কথা;
সেটা কোরবানীর ঈদ।
সারা বছর অপেক্ষা করে থাকতাম ওই একদিনের জন্য। গরু কেনায় হুলস্থুল, গরু দেখায় সারাদিন যেত- সে যেন এক গরুময় ঈদ! কোরবানীর ঈদের সন্ধ্যে থেকে শুরু করে বাকি চার পাঁচটা দিন - কষানো থেকে শুরু করে ঝুরা মাংস পর্যন্ত উতসবটা শুরু হত গরু দিয়ে শেষ হত গরুর মাংসের শেষ টুকরোর সাথে ভীষণ বিষাদে( এই নিয়ে কথা হবে অন্য কোনদিন)। আমরা ওইতো ওই পাঁচদিন মাত্র গরুর মাংস খেতাম বছরে- তারপরেও কেমনে বলি- এখন গরুর মাংস জোটে না। বাঙ্গালীর কপালে কবে ইচ্ছেমত গরুর মাংস জুটেছে?
****
আমাদের সেই বাজারের তিন কিলোমিটারের মধ্যে আরো চারখানা ছোট বাজার হয়েছে। ধরে নিই ৩০/৪০ বছরে মানুষ বেড়েছে ৪ গুন। শেষবার গত বছর যখন পরিচিত আছে বলে তেমন ছোট একটা বাজারে ভোর সাতটায় গিয়ে দেখি পর পর চারখানা কসাইয়ের দোকান। ভোর পাচটা থেকে নাকি গরু কাটা শুরু হয়েছে। সেকেন্ড রাউন্ড চলছে। প্রতিদিন এখানে নুন্যতম ১৬ খানা গরু বিক্রি হয়। দম ফেলানোর ফুসরত নেই কারো। তেল চর্বি ছাট কাট বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা কেজি। কেউ জাত কসাই না- মাংস কাটছে আবোল তাবোল- কার সাথে কি দিচ্ছে কি মেশাচ্ছে আল্লা মালুম। যারা মাংস নিচ্ছে তারা সবাই মোটেও অবস্থাপন্ন নয়।
****
২০১৮ সাল স্থানঃ নিকেতন। সন্ধ্যেয় একজন কসাই শেষবারের মত তাঁর যন্ত্রপাতি গোছাচ্ছে। কাল থেকে এখানে সে আর মাংস বিক্রি করবে না। গ্রামে চলে যাচ্ছে সে। জিনিসপত্র গোছানোর সাথে সাথে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে সে। কোন এক শুভাকাঙ্ক্ষী জিজ্ঞেস করল, মনে মনে কি কচ্ছিস রে?
~ কচ্ছি। হেরা সারাদিন এসিতে শুয়ে বইসে কাটাবি, কাম কাজ কিছু করবি না। চাকর বাকর দিয়ে হাত পা টিপাবি, এসি গাড়ি দিয়া ঘুরবি, হোটেলে গিয়ে গপাগপ গিলবে আর নাক ডাকি ঘুমাবি। তাঁর পর ডায়াবেটিস, হাটের রোগ, পেশার হলি সব দোষ হয় শালার গরুর গোশের। শালার এত যহন দোষ গরুর গোশশ-ই আর বিকরি করব না। গ্রামে চলি যাব- ওহেনে গিয়ে গরুর গোশতো বিকরি করবো- হেগোরে হাটের রোগও হয় না গরুর গোশেরও দোষ হয় না।
****
১৯৮০ সালে আদমশুমারি মতে ঢাকার লোক সংখ্যা ছিল ৩২ লাখের আশেপাশে আর আর এখন ২ কোটি ৩২ লাখ তাঁর মানে লোক সংখ্যা প্রায় আটগুন বেড়েছে। মানুষ বাড়ার সাথে সাথে ঢাকা মেট্রোর আয়তন ও বেড়েছে। যাই হোক সত্তুরের দশকে যারা ঢায় ছিলেন তারা কি বলতে পারেন একটা মহল্লায় তখন কি পরিমান গর জবাই হত প্রতিদিন- আর এখন কি পরিমান হয়? ওদিকে মাংসের তুলনায় কতগুন বেশী ইলিশ খেতেন আর এখন কতগুন খান? আমার ধারনা মানুষ আটগুন বাড়লেও পুরো ঢাকায় পঞ্চাশগুন গরু মহিষ খাসী বিক্রি বেড়ে গেছে !
আমার ধারনা সারা বাংলাদেশে প্রতিদিন সত্তুরের দশকে দুহাজার গরু জবাই হত কিনা সন্দেহ- আর এখন বছরে ১ কোটির আশে পাশে গরু জবাই হয়( কোরবানি বাদে) তাঁর মানে তাঁর মানে প্রতিদিন প্রায় ২৮০০০। আপনি মানেন না মানেন ৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে মাত্র কিন্তু গরু খাচ্ছি আমরা চৌদ্দ বেশী।
****
তথ্যঃ একটা সাইটের তথ্য বলছে যে বাংলাদেশীরা মাথাপিছু ৩.৫ কেজি গরুর মাংস খায় প্রতিবছর - আরেকটা সাইটে জানাচ্ছে যে না সেটা ৪.৫ কেজি। আর আমেরিকানেরা গরুর মাংস খাচ্ছে মাথাপিছু ২৬ কেজি । পাকিস্তান ৬.২ কেজি। এই ডাটায় ভারত থাকবে না কেননা তাদের অধিবাসীদের বড় একটা অংশ নিরামিষভোজী। পাকিস্তানীরা অনেক বেশী মাংসপ্রেমী। সেখানে তারা মাত্র আমাদের থেকে ১.৭ কেজি গরুর মাংস বেশী খায়-বিষয়টা ভেবে দেখার।।
* ছবি-টবি সব নেট থেকে ধার করা মাল।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩ বিকাল ৩:২৩