
'পাগল হয়ে যাব আমি পাগল হয়ে যাব'' অদ্ভুত এই রিংটোনে বেজে উঠল তুহিনের ফোনে বিকট শব্দে! স্বভাবতই আমি বিরক্ত হয়ে ভ্রু কুচকে ওর দিকে প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালাম। ও আমার বিরক্তিকে থোরাই কেয়ার করে একটু মুচকি হেসে - একটু ইশারা করে অপেক্ষা করতে বলে ফোনটা রিসিভ করে বলল, হ্যাঁ চাচ্চা কও।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম ওপাশে আমাদের সুবোধ কাজী।
তুহিন উনাকে কখনো চাচ্চা কখনো আঙ্কু কখনো মুরব্বী বলে ডাকে। কখনো তুমি কখনো আপনি সম্বোধন করে। দুজনের সম্পর্ক ভীষণ অম্ল-মধুর। তাদের সম্পর্কের রসায়নটা বলার আগে তুহিনের গল্পটা করে নিই।
তুহিন মূলত আমার ছোট ভায়ের বন্ধু- মহল্লার ছেলে। ছোটবেলার থেকেই চিনি ওঁকে। ওর বাবা বিদেশী একটা সংস্থায় বড় পদে চাকুরী করতেন। ভাইয়েরা সব উচ্চ শিক্ষিত।ও সুপ্রতিষ্ঠিত। পরিবারে সেই একটুখানি বিগড়ে গেছে- তুখোড় বুদ্ধিমান কিন্তু বাউণ্ডুলে স্বভাবের ( সে আর এক চরিত্র- তাঁকে নিয়ে অন্যদিন গল্প হবে)। চরম আড্ডাবাজ ও প্রেমিক পুরুষ। বন্ধুরা বলে ওর গিলা কলিজা কিচ্ছু নাই নাকি- পুরাটাই হার্ট। তবে যে বন্ধু আর মেয়েদের জন্য সে যখন তখন জান বাজি দিতে রাজী। সারাক্ষণ বক বক করে তবে চরম রসিক মানুষ। কখনো কাউকে বোরিং হতে দেয় না। ইন্টারে ভাল রেজাল্ট করার পরেও আর পড়াশুনা করেনি- কয়েক জায়গায় চাকুরীর চেষ্টা করে তিন মাস টেকেনি। ওর বন্ধুদের অনুরোধে আমি তাঁকে সুযোগ দিয়েছিলাম। তারপরে বিরাট ইতিহাস। অনেক অত্যাচার সহ্য করেছি তাঁর! সেও আমার জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়েছে- কষ্ট করেছে!
তবে অতি বুদ্ধিমান চাপাবাজ মানুষ সে- এত নিখুঁত মিথ্যে কথা বলে সেখানে ফাঁক খুঁজে পাওয়া মুশকিল! বহুবার আমার এখান থেকে চাকুরী ছেড়ে চলে গিয়ে কয়েকমাস ঘুরে ফের ফিরে এসেছে। আমি অতি নরম মনের কঠিন প্রকৃতির মানুষ। আমি আমার টেকনিক্যাল কাজের সব খুঁটিনাটি জানি- কোন মানুষকেই আমার একান্ত প্রয়োজন নেই। থাকলে ভাল না থাকলে নেই। বিকল্প উপায়ে চালিয়ে দেই। এটা সবাই জানে।
তুহিন আমাকে 'ভাইয়া' বলে ডাকত। তাঁর ডাকটা বড় বেশী আন্তরিক ছিল!
****
সুবোধ কাজীকে সবচেয়ে দুর্দান্ত-ভাবে হ্যান্ডল করে তুহিন। প্রায় প্রতিদিন সুবোধ কাজী সন্ধ্যে নাগাদ ভীষণ গোস্বা হয়ে আমার কাছে এসে নালিশ দেয়- বস, তুহিনের সাথে আমি কোথাও যাব না।
-কেন কি হয়েছে?
- পুরাটা বলা যাবে না। ও বহুত উল্টাপাল্টা কথা বলে।
আমি মনে মনে হাসি।
ঠিক তক্ষুনি তাঁর পেছন পেছন তুহিন এসে হাজির। হাসতে হাসতে নিজের টাক মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে (ও বলা হয়নি তুহিনের অল্প বয়সেই টাক পড়ে গিয়েছে) বলে, কি মুরুব্বী মাইন্ড খাইছেন নাকি?
- এই দেখেন বস কথার ছিঁড়ি দেখেন? ও সারাক্ষণ আমারে খোঁচাইতে থাকে।
খোঁচাইলাম কই, আপনারে কইলাম; এই জিনিসটা একটু ধরেন। আপনি কন, পারুম না- আমার কোমরে ব্যথা! আপনারে কইলাম ওই-দোকান থেকে ওইটা নিয়া আসেন আপনি কন তুমি নিয়া আস, আমার হাঁটুতে ব্যথা। আপনের গিট, গাঁট, কোমর, নলি, নালা কোন জায়গায় বিষ ব্যথা নাই কন দেখি?
আমি খালি কইলাম, পাগলা কুত্তায় দাবড়াইলে ঠিকই তো 'উসাইন বোল্টে'র মত লৌড়াইবেন। খারাপ কি কইছি?
- ওই যে ওই যে, তুমি ওই উসাই বোল্ট- ফোল্টের কথা কইলা ক্যান?
তুহিনের তখন হাসতে হাসতে পেটে খিল লাগার দশা! আরে চাচ্চা, উসাইন বোল্ট, পৃথিবীর সেরা দৌড়বিদ! তুমি তো বাড়া দিন দুনিয়ার কোন কিছুর খবর রাখ না।
-হইল 'উসাইন বোল্ট' তা তুমি একটা বে-ধর্মীর সাথে আমারে তুলনা করবা ক্যান?? ' পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কাতারে দাঁড়িয়ে পড়া 'সুবোধ সাহেব' হার মানতে নারাজ!
***
এই হল তাদের খুনসুটির বিষয়বস্তু! তুহিন আর সে যেন, সাহিত্যের পাতা থেকে উঠে আসা সত্যিকারের 'রম্য চরিত্র'।
সারাক্ষণ তাদের খুটখাট চলতেই থাকে। তুহিন মজা করলেও সুবোধ সাহেব কিন্তু ভীষণ বিরক্ত তাঁর প্রতি- কিন্তু বিরাগ হয়ে কথা বন্ধ করতে পারে না প্রয়োজনে বারবার তুহিনের কাছে আসতেই হয়।
তাঁর ফোনের অত্যাচারে তুহিনের মাথার বাকি যে কয়টা চুল ছিল সেগুলোও পড়ে যাবার দশা! সে কারণেই সে নাকি ফোনের রিংটোনে সেই বিশেষ গানটি সংযোজিত কুরেছে। ওই রিংটোন বাজলেই দূর থেকেই সে সচকিত হয়; ঘনঘন টাকে হাত বোলায়- ' ঈশ ঈশ' করে শব্দ করে- চেহারায় কালো ছায়া নেমে আসে।
মুড ভাল থাকলে অবশ্য, একটু শরীর দুলিয়ে নাচে আর আর ঠোট মিলিয়ে গায়' পাগল হয়ে যাব আমি পাগল হয়ে যাব'।
পাগল হয়ে যাব আমি পাগল হয়ে যাব!!!
~কারো মনে চাইলে একটু গানটা শুনে আসতে পারেন।
***
বাইরে থেকে কোন কিছু কেনাকাটা করে ফ্যাক্টরিতে ঢোকার সময়ে ভয়াবহ একটা বিধ্বস্ত চেহারা নিয়ে আসেন! তুহিন আমাকে চুপি চুপি বলেছে, সে বহুবার লক্ষ্য করেছে। ফ্যাক্টরির গলির মুখে ঢোকার আগে সে চনমনে ভঙ্গীতে থাকে - গলিতে ঢুকলেই একেবারে ভেঙ্গেচুরে হাঁটতে থাকে।
তুহিন আশে পাশে থাকলে, মালপত্র হাত থেকে নামাতেই, ফিচেল হাসি দিয়ে তুহিনের প্রথম প্রশ্ন, কি চাচ্চা- আজকে কি কি আকাম করলেন?
আর যায় কই। অগ্নিশর্মা তখন সুবোধ কাজী! এই মিয়া তোমার কি মনে হয় আমি খালি আকাম করি? খালি ফালতু কথা কও ক্যান?
কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হয়ে যায় কাজে কামে নিশ্চিতভাবে বেশ কিছু গড়বড় হয়েছে। যেখানে সুবোধ কাজী থাকবে সেখানে গড়বড় হবে না সেটা হতেই পারে না।
দিনের বাকিটা সময় তুহিন হাসে আর নরম স্বরে খোঁচায়। ওদিকে সুবোধ কাজী গোস্বায় মুখ ফুলিয়ে থাকে আর বলে' আমি আর কোথাও যামু না- এর পর থেকে বস রে কইও অন্য কারো পাঠাইতে।'।
***
* আমার মাইক্রো কোম্পানীতে চাকুরির কোড অব কন্ট্রাক্টে থাকে ' প্রয়োজনে মালি'কে হাল চাষ করতে হবে' বসে থাকার কোন সুযোগ নাই।
**মাথার মধ্য প্লট সাজানো আছে- চোখের সামনে চরিত্রগুলো ঘোরাফিরা করছে। তাই টপাটপ লেখা প্রসবে কষ্ট হচ্ছেনা তেমন।**
আগের দুই পর্বঃ
সুবোধ কাজী~১
সুবোধ কাজী~২
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১১:৪৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




