
চিংড়ি মাছ ছিলে হলুদ দিয়ে রেখে যাচ্ছি- তুমিতো আবার খোসা সহ চিংড়ি খেতে চাও না। খোসা ছাড়ালে চিংড়িটা এত্তোটুকুন হয়ে যায়! মাথা কিন্তু ফেলে দিচ্ছি!
-মাথা ফেলছ কেন? মুচমুচে মাথা ভাজি কুড়মুড় করে খেতে ভাল লাগে।
গিন্নী একটু মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,- বয়স হচ্ছে খেয়াল আছে? মাথায় দুনিয়ার কোলেস্টোরেল। এমনিতেই চিংড়ি মাছ ডাক্তার খেতে নিষেধ করে।
এখন আর এর বেশী কথা বাড়াই না আমি। বিয়ের প্রথম প্রথম আমার বাপজানের উপদেশ ভুলে গিয়েছিলাম! তিনি বলতেন, 'পুকুর যত কাটবে তত বাড়বে আর কথা যত বলব তত বাড়বে'। জীবন মাঝপথ থকে একটু এগিয়ে পশ্চিমে হেলে যাবার পরে বুঝলাম বাপজানের কথার গুরুত্ব!!
-গরুর মাংস রান্না করে রেখে যাচ্ছি তবে ভাঁপ দিয়ে তেল ফেলে দিচ্ছি।
আমি ভীষন হতাশ কন্ঠে ফ্যাসফ্যাস করে বললাম, -মাংস ভাপ দিয়ে চর্বি ফেলে দিলে মনে সেদ্ধ কাঠ খাচ্ছি!
গিন্নী এবার ক্ষেপে উঠল, যদিও বেশ মায়াময় ক্ষ্যাপা! বাপের বাড়ি যাচ্ছেতো তাই এটা 'ফনা তুলে' ক্ষ্যাপা নয়।
-এজন্যই আমি বাসায় গরুর মাংস আনতে নিষেধ করি। তোমার বয়স হচ্ছে, এসব খাওয়া বন্ধ কর। চারিদিকে দেখছ কি অবস্থা?
-ওক্কে ওক্কে তোমার যেমন ইচ্ছে মনে চায় রেখে যাও।
-ইলিশ মাছও কেটে হলুদ লবন দিয়ে আগেই রেখে দিয়েছি ফ্রিজে ওই গোলাপি বক্সে আছে।
-ইলিশের ডিমগুলো কি ফেলে দিয়েছ?
এবার হেসে ফেলল সে,
-নাহ্ ওইটা ফেলি নাই। তোমার এত ফেভারিট খাবার কি ফেলতে পারি!
প্রতিবছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে অন্য হাজারও ঢাকাবাসী গৃহিনীর মত সেও 'নাইওরে' যায়। বাবা মারা গেছেন ছোটবেলায় তার মা আর ভাইদের কাছে মানুষ। এখনো ছোটই রয়ে গেছে তাদের কাছে। আদর আহ্লাদের কমতি নেই।
সেও কিছু হলে 'গেলাম ভাই-এর কাছে' বলে হুমকি দেয়!
ছেলে মেয়ের এখনো মামা বাড়ির টান আছে। তারাও কদিন আগে থেকেই গোছ-গাছ শুরু করতে দেয়। এবার দেশের পরিস্থিতি সহ বিবিধ কারনে ভ্রমন সংক্ষিপ্ত হয়েছে।
***
বছর পনের আগে এ সময়টার জন্য সারা বছর অপেক্ষা করতাম আমি। একা হতে চাইতাম, নিজেকে নিয়ে থাকতে চাইতাম, নিজের মত করে খাওয়া, ঘোরা ফিরা, চুটিয়ে আড্ডা, কার্ড খেলা, রাত জাগা সহ আরো কত কি করার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে থাকতাম।
আর এখন সেই রাত জাগা বন্ধুরা আর নেই! না হারিয়ে যায় নি; তারা জীবন জীবিকা নিয়ে ভয়ানক ব্যস্ত- ক্লান্ত! পরিবার থেকে বাইরে রাত কাটাতে নারাজ কিংবা অপারগ। কেউ কেউ রাত জাগার ধকল সামলাতে পারে না, কেউবা সুদীর্ঘ সময়ের জন্য প্রবাসী হয়েছে।
এখন রাতগুলো ভীষন নিঃসঙ্গ, বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর ও খানিকটা ভয়ের। আগে দিনগুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যেত এখন দিন কাটে ঘন্টা গুনে। তবুও এই ব্যাচেলার লাইফটা মাঝে মধ্যে আনন্দের! এখন আর ভোগ কিংবা উপভোগ নয় একদম নিজের মত করে কিছু সময় থাকা যায়। যখন খুশী খাইলাম, মনে চায় খাইলাম না হয় নাইবা খাইলাম, যখন খুশী স্নান করলাম। ঘুমের সময়টা ইচ্ছেমত - শব্দ করে মুভি দেখলে বা গান শুনলে কারো আপত্তি নেই। বিছানাটা গোছালাম না, মশারিটা ওভাবেই পড়ে রইল- রান্না ঘরে এঁটো বাসন যথাসময়ে ধোয়া হয় না।
আগে ফ্রিজে যোগাড় যন্ত করে যা রেখে যেত বন্ধু বান্ধব মিলে দু'দিনেই সাবাড়!
এখন গিন্নী খাবার সময়ের আশে-পাশে যখনি ফোন দেয়, বলি; ডিম ভাজি করেছি, ডিমের কাবাব করেছি, ডিম ভুনা করেছি কিংবা সব্জি রান্না করেছি- পৃথিবীর সহজতম রান্নাগুলো চুলোয় চাপাই।
-তাহলে আমি যে এত কিছু রেখে আসলাম!!
ওগুলো ওভাবেই পড়ে আছে- রান্না করতেও ইচ্ছে করে না খেতেও ইচ্ছে করে না।
-তা গরুর মাংসতো রান্না করে রেখে এসেছি।
-ওহ্ হো মাংসের কথা আমি ভুলেই গেছিলা! দেখি আজকে খাব।
বলি একথা, কিন্তু খাবার আগে হয় ভুলে যাই- নয়তো খেতে ইচ্ছে করে না।
জীবনটা এমনই; একসময় মনে হত আমার টাকা হলে এই খাব ওই খাব, এমনে খাব ওমনে খাব- আহা কত সপ্ন ছিল। ছোট বেলায় হাতে একটা কমলা নিতে একটা করে কোয়া চুষে চুষে খেতাম। শেষ হয়ে যাচ্ছে নাকি সেই ভেবে ভয়ে ভয়ে বার বার কোয়া খসানো কমলার দিকে তাকাতাম। তখন ঢাকা থেকে কোন আত্মীয় বেড়াতে গেলেই শুধু আঙ্গুর আর কমলার স্বাদ পেতাম। যারা এসব ফল খেত তাদের কতই না সুখী মানুষ ভাবতাম।এখন কমলা পচে যায়, আঙ্গুর থোকাতেই শুকিয়ে ঝড়ে পড়ে, ফ্রিজ থেকে আপেল বের করে ক'মাস আগে কিনেছিলাম তাই ভাবতে বসি; কিন্তু আদপে আমরা কি ছোট বেলার সেই সপ্নের সুখী মানুষ হয়েছি?
***
বউ বাপের বাড়ি গেলে ব্যাচেলার অবস্থায় সহজতম ডিমের কাবাবের রেসিপিঃ(অবিবাহিত ব্যাচেলারদের জন্য নয়)
পেঁয়াজ মোটা মোটা গোল গোল করে কেটে নিন- সাইজ কোন ম্যাটার না( যেমন মনে চায়)
দু কোয়া রশুন ছিলে খুন্তি বা ছুড়ির চ্যাপ্টা দিক দিয়ে থাবড়া দিয়ে থেঁৎলে নিন সাথে একটু আদা যদি রসুই ঘরে থাকে।(অনেক কিছুই হাতের নাগালে খুঁজে পাওয়া যাবে না অতএব 'নো টেনশন')
একটা বা দুটো কাঁচা মরিচ আগের উপায়ে থেঁৎলে অথবা চিঁড়ে নিতে পারেন (কাঁচা মরিচ না থাকলে শুকনো মরিচেও চলবে)
বাড়িতে যদি হামান দিস্তা থাকে তো ভাল না থাকলে নাই- মশলা পেশার ব্লেন্ডার (spice grinders) হলে চলবে, সেটাও না থাকলে 'কুছ পরোয়া নেহি'।
এবার মাঝারি সাইজের প্যান অথবা কড়াই নিন;
পেঁয়াজ মরিচ আদা রশুন প্যানে রাখুন, যদি ব্লেন্ডার বা হামান দিস্তা থাকে তো কালিজিরা,জিরা,তিন চারটা মেথি(অপশনাল),একটু মৌরি( অপশনাল) দুটো এলাচ, দুটো গোল মরিচ, দুটো লবঙ্গ আর একটা দারুচিনি নিয়ে আধভাঙ্গা করে নিন। আধ ভাঙ্গার অপশন না থাকলে ছেঁচে ভেঙ্গে কিংবা আস্তই দিন। এবার একটু হলুদ,লবন আর সরিষার তেল( না থাকলে যে কোন ভোজ্য তেল) দিয়ে মেখে অল্প আঁচে চুলোয় ঢেকে দিন। খানিক বাদে নেড়ে-চেড়ে আধাকাপ পানি দিয়ে ঢেকে দিন। মিনিট পাঁচ সাতেক বাদে একটা ডিমের খোসা ভেঙ্গে আলতো করে ছেড়ে দিয়ে কুসুমের উপরে একটু লবন ছিটিয়ে ঢেকে দিন। কুসুমটা একটু শক্ত হলে ডিমটা উল্টে দিয়ে দু'মিনিট পরে নামিয়ে টপাটপ ভাত দিয়ে খেয়ে ফেলুন।
~ কি বললেন, ভাত নেই!! তবে আর কি, ওটা আমি রাঁধতে পারি না। গোপন সুত্রে খবর পাইলাম; মিরোর আপু নাকি ২৫ রকমের ভাত রান্না করতে পারেন- উঁনার কাছ থেকে শিখে নিন। তাঁর বিশেষ এক পদের ভাত রান্নার পদ্ধতি জানা আছে যেটা কোনরূপ তাপ বা ভাঁপ ছাড়া হয়!!
* ধনে পাতা আর স্প্রিং ওনিয়ন বা পেঁয়াজ পাতাও দিতে পারেন। রান্না বেশী স্বাদ হয়ে গেলে পরে গিন্নীর হাতের খাবার খাইতে পারবেন না- সেইটা আবার আরেক দিকদারি!! গিন্নী চলে গেলে ইচ্ছে করেই একটু কম স্বাদযুক্ত খাবার খাবেন- তাহলে তাঁর অভাব উপলব্ধি করবেন ভালভাবে।
***
আসলেই কিন্তু আমাদের উপমহাদেশেই শতাধিক পদ্ধতিতে ভাত রান্না করে। বিশ্বাস হয় না???
দেখুন; ক্ষুদের ভাত, কলাপাতায় মোরা ভাত, বাশের কোঁড়লে ভাত, বসা ভাত, মাড় গালা ভাত, জাউ ভাত, নারিকেলের দুধের ভাত, জিরা ভাত, মাখন ভাত, আতপ চালের ভাত(স্টিকি রাইস), ফেনা ফেনা ভাত -এমন করে খুঁজে দেখুন কত পদের ভাত আপনিই খেয়েছেন। পোলাও, ফ্রাইড রাইস আর বিরিয়ানি- তেহারির শত পদ ধরলে বিশ্বজুড়ে হাজার পদের ভাতের রেসিপি আছে। আমাদের মিরোর আপু ২৫ পদের ভাতের রেসিপি জানবেন এখানে আর আশ্চর্যের কি আছে!!!
৬৪তম পোস্ট দিয়ে এবছর শেষ করলাম। সবাইকে নতুন ইংরেজী বর্ষের অগ্রীম শুভেচ্ছা!
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১:২০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



