কি দুঃসহ কয়েকটা দিন কাটালাম আমরা- কয়দিন কাটালাম মাঝেমধ্যে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! অনলাইন দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেন আশির দশকে ফিরে গিয়েছিলাম আমরা। পার্থক্য; বিটিভির পরিবর্তে অনেকগুলো নতুন রঙ্গিন বোতলে সেই পুরনো মদ ছিল শুধু।
এ’কদিন কেমন ছিলাম আমরা?
গতকাল রাতে টিভিতে কিছু মানুষের সাক্ষাৎকার দেখলাম তারা সেদিন প্রথমবার কার্ফ্যুউ শিথিল করার জন্য শুধুমাত্র বাধ্য হয়ে ঔষধ কেনার জন্য বাড়ির বের হয়েছেন। ওদের কথা শুনে ভাবলাম ওদের সাথে আমার কেমন থাকার তুলনা করলে হবে না।
আমার বাসায় একদিনের জন্য বেড়াতে এসে সপ্তার বেশী সময় আটকে গেল কিছু আত্মীয়, অনিচ্ছায় আমাদের বেকায়দায় ফেলে দেয়া আর বদ্ধ এক পরিবেশে আটকে যাওয়া ও বাড়ি ফেরার অনিশ্চয়তা নিয়ে তাদের দুঃশ্চিন্তা ছিল অন্য রকমের।
ইন্টারনেট বন্ধ হবার দ্বীতিয়দিন সন্ধ্যের বাসায় ছাদে উঠে মুখোমুখি হলাম অন্য এক অভিজ্ঞতার; ফ্লাটের মালিকগনের আলাপচারিতায় রাজনীতির মেরুকরন, ছাত্র আন্দোলনের ভিন্ন মোড়, ভয়ঙ্কর সহিংসতা, জ্বালাও পোড়াও,সরকারের নিশ্বংস হত্যাকাণ্ড, মাথামোটা নেতাদের নির্বুদ্ধিতা, চাকুরি ব্যাবসা নিয়ে ভবিষ্যত উৎকণ্ঠার পাশাপাশি নেট না থাকায় সন্তানদের অত্যাচারে কিভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছেন তাঁর ভয়ঙ্কর চিত্র তুলে ধরে একেকজনের সে এক করুন আর্তি দেখে আঁতকে উঠলাম! শুধু কি তাই- ঘরে ঘরে ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক থাকায় অনেকেই ডিশের লাইন কেটে দিয়ে এখন অনেক 'অনলাইন সফটওয়্যারে' টিভি দেখেন- তারা আছেন ভয়াবহ বিপাকে- পুরো যেন গুহাবাসী থাকার অবস্থা!
আর কেউ কেউ আরো ভাল সার্ভিসের আশায় ডিজিটাল ডিশ সার্ভিস প্রোভাইটারের তারবিহীন সংযোগ নিয়ে ঐ গোলমেলে অবস্থায় আছেন- তারা মিনিটে মিনিটে আত্মীয় স্বজন ইয়ার বন্ধুদের কাছে খবর নেন, বর্তমান পরিস্থিতি কি?
আর রঙ্গীন নতুন বোতলে পুরনো মদ সাজিয়ে রাখা টিভি কর্তারা ঘন্টার পর ঘন্টা একই খবর ব্রেকিং নিউজ বলে দেখিয়ে যাচ্ছেন- তাদের লজ্জা শরমের বালাই নেই, কখনো খুব দরদী হলে কোন দুঃসাহসী সাংবাদিক বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে, মাথায় হেলমেট লাগিয়ে, আইনশৃংখলা বাহিনীর থেকেও বহুদুর নিরাপদ দুরুত্বে দাঁড়িয়ে, কয়েক ঘন্টা আগের সংবাদ পরিবেশন করেন। নতুন কোন খবর নেই- দিন দুনিয়া সব শান্ত বলে মনে হচ্ছে ভেবে দোকানের সব বিরিয়ানির মশলা শেষ হয়ে যায়।
বুড়োভামরা যেমন তেমন- পুলাপানের শান্ত রাখা সে এক বিশাল কর্ম। গৃহ অভ্যান্তরে বাবা মায়েরা যে পরিমান যুদ্ধ করেছেন এ কদিন তাদের সন্তানদের নিয়ে তা অকল্পনীয়!
আমাদের আড্ডার আজিজ ভাই দুইনম্বর দিন টিকতে না পেরে শেষমেষ কার্ফ্যুউ ভেঙ্গে এক দুপুরে শরনাপন্ন হলেন ডিশ ব্যাবসায়ীর দ্বারে- এখুনি তাঁর লাইন লাগবে। খবর না শুনলে তিনি মারা যাবেন। লাইন লেগেছিল পরদিন এগারটায়- তাঁর সিরিয়াল নম্বর ছিল ১০১!
এর থেকে ভয়াবহ অবস্থা যাদের প্রিপেইড গ্যাস আর বিদ্যুৎ লাইন- প্রায় সবারই লাল বাত্তি জ্বলে ট্যা ফ্যা শুরু করেছে মিটার! তারা আছে তাদের টেনশন নিয়ে- গ্যাস আর বিদ্যুৎ গেলে খাবে কি আর এই গরমে ও অন্ধকারে বাঁচবে ক্যামনে?
গ্যাস নিয়ে সে কি হুজ্জোতি! শনিবার নমঃ নমঃ করে রোববার সকাল দশটায় প্রায় সবার বিদ্যুৎ চলে গেল। অনলাইন ব্যাঙ্কিং এ কোন সুযোগ নাই-বুথ প্রায় সবগুলো বন্ধ, খোলা থাকলেও সব কার্ড কাজ করে না, না হয় টাকা নেই। সবাই দৌড়াচ্ছে বিদ্যুৎ অফিস পানে। সেই অসহনীয় রোদ আর গরমে সে কি ভীড়! বাসা থেকে বউ বাচ্চা বুড়োদের মিনিটে মিনিটে ফোন আর কতক্ষন, গরমে যে সিদ্ধ হলাম! যারা এই খবর রাখেনা তারা গুজব ছড়িয়ে ছিল যে, অমুক অমুক যায়গায় বিশাল আন্দোলন হচ্ছে- ব্যাস শুরু হয়ে গেল! চিলে কান নিয়ে গেল বলে কিছু লোক পড়ি মড়ি করে ছূটছে নিজ গৃহপানে আর কিছু লোক দৌড়াচ্ছে আন্দোলন দেখার জন্য।
আমাদের আড্ডার আশেপাশে সব মিলিয়ে তিন কিসিমের লোক থাকে; একদল উগ্র সরকার সমর্থক, একদল নিরপেক্ষ নয় কিন্তু দুই তালে চলে, আর এক পক্ষ উগ্র সরকার বিরুদ্ধ বাদী। এর মধ্যে কেউ কেউ লাঠি নিয়ে গেছেন আন্দোলনকারীদের দমন করতে কিন্তু সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি, তারা পেছন থেকে গাই গুই চলে এসে হাতি ঘোড়া মারার গপ্পো করেছেন।
আরেক পক্ষ ভীষন উত্তেজিত, তারা কখনো; হাসিনা পালিয়ে যাবার অতি গোপন তথ্য দিচ্ছেন কানে কানে, কখনো; খালেদা আর নাই- কিন্তু আন্দোলন দমায় রাখতে পারবে না বলে সরকার চেপে রাখতেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কয়েকটা ট্রুপ অলরেডী এয়ারপোর্টে চলে আসছে এইসব খবর রটিয়ে যাচ্ছে! সারাদেশের ইন্টারনেট বন্ধ থাকার পরেও তারা এমন অতিগোপন স্পর্শকাতর খবর কোন ফেরেশতা মারফত পাচ্ছিল সেটা একটা ভাববার বিষয় বটে।
অতি উগ্র সরকারপন্থী বলছে যে, সব মিলায় পঞ্চাশজন মানুষ মরছে কি না সন্দেহ ( ঢাকা মেডিকেল কলেজের তথ্যমতে সেখানেই লাশ গিয়েছে ৬৯ জনের আর পরে মারা গেছে সম্ভবত ১৪ জন- বাংলাদেশের আর বাদবাকি হিসাব বাদ।) আর উগ্র বিরুদ্ধবাদীর মতে, মিনিমাম পাঁচ ( আপনি কি মনে করেছেন পাঁচশত? আরে না ভাই পাঁচ হাজার!!)
আমরা কার্ফ্যুর মধ্যেও দুপুরে -রাতে রাস্তার পাশে আড্ডা দিয়েছি। কত যে, বিচিত্র ( ইদানিং পুলাপান বলে ‘আজিব’) কাহিনী দেখেছি আর গুজব শুনেছি তাঁর ইয়ত্ত্বা নেই। তাঁর কিছু কথা ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।
সামহোয়্যার ইন ব্লগ এখন আর মেইনস্ট্রিম সোশ্যাল মিডিয়াতে নাই দেখে এতদিন যে কষ্ট বোধ ছিল আজ সেটা খানিকটা দূর হল সত্য। কখনো কখনো পর্দার আড়ালে থাকা ভাল- সবার নজর এড়িয়ে থাকা যায়।