সমকালে প্রকাশিত একটি লেখা ভাল লাগলো নানান কারনে। প্রথমতঃ লেখাটি একজন মুক্তিযোদ্ধার লেখা এবং সঙ্গতঃ কারনে এখানে দেশাত্ববোধ প্রকাশিত হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এশীয় মহাসড়ক এবং ট্র্রানজিট বিষয়ক যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান সময়ে তারও প্রকৃত অভিমূখ পরিচ্ছন্ন হবে। ধন্যবাদ লেখক ও মুক্তিযোদ্ধা সেতাব উদ্দিনকে।
এশীয় মহাসড়ক এবং ট্র্রানজিট বিষয়ক জটিলতা
সেতাব উদ্দিন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার উষালগ্ন থেকেই 'কারও সাথে বৈরিতা নয়_ সকলের সাথে বন্ধুত্ব' নীতিতে অটল থেকে তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে আসছে। আর প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সবসময় তার বন্ধুত্বের হাত প্রসারিত। বিশেষত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের বন্ধুত্ব রক্তে লেখা। তবে ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রশ্নে অতীতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে হাজারও বদনাম ছড়ানো হয়েছে, এখনও হচ্ছে। 'মসজিদে আজানের বদলে উলুধ্বনি হবে, দেশ ভারত হয়ে যাবে, ভারতের কাছে দেশ বেঁচে দেবে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে মুখ্যমন্ত্রী হতে বেশি পছন্দ করেন'_ এমনি আরও কত মিথ্যা কথাবার্তা শুনতে শুনতে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে! প্রথম দিকে মানুষ এসব মিথ্যা কথায় কিছুটা বিভ্রান্ত যে ছিল না তা নয়; কিন্তু এখন মানুষ বুঝে গেছে এবং সে কারণেই মানুষ ২০০৮-এর নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। এখন আবার 'এশীয় মহাসড়কের' সঙ্গে বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার প্রশ্নে আইএসআইয়ের এদেশীয় এজেন্টরা মরিয়া হয়ে দিগ্গি্বদিক ছোটাছুটি শুরু করেছে। কারণ ভারত লাভবান হবে এমন কাজ তারা করতে দেবে না। বাংলাদেশ লাভবান হবে সে বিষয়ে ওদের কোনো তোয়াক্কা নেই। বাংলাদেশ নিজেদের লাভ করতে গিয়ে কেন ভারতকে সুবিধা দেবে, তা হবে না। কিন্তু কার স্বার্থে এই এশীয় মহাসড়ক তথা ট্রানজিটবিরোধীরা কাজ করছে, তা গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার। ক'দিন আগে প্রধানমন্ত্রী সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে বলেছেন, 'জুজুর ভয় দেখিয়ে এশীয় মহাসড়কে যুক্ত হওয়া থেকে বাংলাদেশকে বিরত রাখা যাবে না। আমরা এশীয় মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই।' প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিয়ে ২৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক সমকালে ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ 'এশীয় মহাসড়কের তাৎপর্য' শিরোনামে যে নিবন্ধ লিখেছেন তাতে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, 'জুজুর প্রশ্ন আদৌ ওঠে কী করে যখন এ পর্যন্ত সংসদে বা সংসদের বাইরে কোথাও এশীয় মহাসড়ক ও তাতে আমাদের সংযুক্ত হওয়ার বিপক্ষে কোনো কিছু উচ্চারিত হয়নি।' পাঠক লক্ষ্য করুন, পরক্ষণই তিনি লিখছেন, 'তবে কোথাও কোথাও প্রতিবাদের গুঞ্জন উঠেছে একটি বিশেষ 'মহাসড়ক'কে আমাদের সরকারের অনুমোদন দেওয়ার বিপক্ষে। কেননা সেই সড়কটি বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকারান্তরে ভারতকে স্থায়ীভাবে ট্রানজিট সুবিধা দিতে যাচ্ছে।' তাহলে কী দাঁড়াল ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা এবং কোথাও কোথাও প্রতিবাদের গুঞ্জন। আর এজন্যই তো প্রধানমন্ত্রী জুজুর ভয় দেখানোর কথা বলেছেন।
আমি শুরুতেই বলেছি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ 'কারও সাথে বৈরিতা নয়_ সকলের সাথে বন্ধুত্ব' নীতিতে বিশ্বাসী। সুতরাং তৃতীয় কোনো দেশের স্বার্থ দেখার জন্য আমরা নিজ স্বার্থ বিসর্জন দেব, ভারতকে ট্রানজিট দেব না, তা হতে পারে না। দেব এবং নেব এটিই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য। এম আবদুল হাফিজ শুরুতেই লিখেছেন, 'অথচ ক্ষমতারোহণের আগ পর্যন্ত দলের বিশেষ বৈদেশিক নীতিপ্রবণতা অজ্ঞাতই থেকে যায়। এর অর্থ এই নয় যে, অতঃপর ক্ষমতাসীন দল যে কোনো বৈদেশিক নীতি-উদ্যোগ বা সিদ্ধান্ত বিধিবহির্ভূর্ত, জনস্বার্থবিরোধী স্বেচ্ছাচারী উপায়ে নিতে পারবে। কেননা জনগণ দলটিকে ক্ষমতারোহণে ভোট দিয়েছে তাদের স্বার্থ সম্পৃক্ত আছে এমন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে, তাদের স্বার্থ ও আশা-আকাঙ্ক্ষাবিরোধী পদক্ষেপ নিতে নয়।' অবশ্যই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাবিরোধী কোনো পদক্ষেপ মহাজোট সরকার নেবে বলে আমরা জনগণ মনে করি না। লেখক শুধু ক্ষমতাসীন বলতে আওয়ামী লীগকেই ইঙ্গিত করেন। কিন্তু তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন মহাজোট সরকার ক্ষমতায়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি জনগণের জানা আছে। জনগণ এ-ও জানে, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারতকে কোনো সুবিধা দিলেও জনগণের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ করবে না।
২৮ আগস্ট দৈনিক সমকালে ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজের লেখা 'ট্রানজিট তৎপরতার নেপথ্য কথা' শিরোনামে আরেকটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছে। তিনি শুরু করেছেন এভাবে, 'তারা এ অসাধারণ বিনিয়োগ থেকে অবশ্যই কিছু লাভের আশা করে থাকবে। আফটারঅল আন্তর্জাতিক সম্পর্কে ফ্রিলান্স বলে কিছু নেই_ উভয়পক্ষ সে সম্পর্কে অবশ্যই অবগত ছিল।' উভয় পক্ষ বলতে তিনি বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারকে বুঝিয়েছেন। হঠাৎ করে একটি দেশ ১ কোটিরই বেশি শরণার্থীর বোঝা বইতে গিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছে, এটিকে তিনি অসাধারণ বিনিয়োগ বলেছেন। তিনি নিশ্চিত করেছেন ভারত সরকার এ থেকে লাভের আশা করেছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকার তা জানত। ভারতের সাহায্য-সহযোগিতাকে তিনি তার নিজস্ব কায়দায় বর্ণনা করেছেন, 'ভারতীয় নেতৃত্ব অবশ্যই ভেবে থাকবে যে, একটি স্বাধীন বাংলাদেশ পরবর্তীকালে তাদের কৃতব্যয়ভার কোনো না কোনোভাবে পরিশোধ করবে। তাদের কল্পনায় একথা উদয় অবশ্যই হয়েছিল যে, এরপর একটি কাটছাঁট পাকিস্তানকে সামাল দেওয়া সহজ হবে এবং কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ বন্ধুসুলভ নব্য স্বাধীন বাংলাদেশও অনুগত থাকবে।' আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় আইএসআই তাদের কল্পনায় ভারত সরকারের ভাবনাগুলো দেশ-বিদেশে যেভাবে প্রচার করত এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সরকারকে মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছিল এ নিবন্ধে সেটা লক্ষ্য করা যায়। তার দুটি লেখাতেই স্ববিরোধিতা প্রকটভাবে লক্ষণীয়। একদিকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ভারতের তোষণকারী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং বাংলাদেশকে দুর্বল একটি দেশ হিসেবে উল্লেখ করছেন। অন্যদিকে রৌমারী এবং বেরুবাড়ী সীমান্তে ভারতীয়দের এমনই শিক্ষা দিতে সক্ষম যে, ওই বৃহৎ শক্তির পক্ষে তা ভুলে যাওয়া সহজ নয়। রৌমারী সীমান্তের ঘটনাটি আওয়ামী লীগ সরকার আমলেই ঘটেছিল, সেকথা লেখকের মনে হয়তো নেই_ তা না হলে আভাস-ইঙ্গিতে আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে, জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে, বিধিবহির্ভূতভাবে কাজ করেছে বলে উল্লেখ করতেন না। করতেন নাইবা বলি কী করে, যেখানে বঙ্গবন্ধু সম্পাদিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তির বিষয়ে তিনি লিখেছেন, '২৫ বছর মেয়াদি চুক্তিটি ছিল ভারতের ইচ্ছার অনুকূলে একধাপ অগ্রসর ব্যবস্থা। এবং চুক্তি ভারতের কৌশলগত ইচ্ছাগুলো বাস্তবায়নে সাহায্যকারী হয়েছিল।' তার এ বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রয়োজন। তা না হলে এ বক্তব্য মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে ধরে নিতে হবে। সুকৌশলে স্বয়ং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাকে দোষারোপ করার জন্যই তিনি এ মন্তব্য করেছেন, বিশ্বাস করতে হবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সর্বোচ্চ সতর্ক ছিলেন। পাকিস্তানের জেল থেকে ছাড়া পেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র মাটিতে পা দিয়েই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেছিলেন, অবিলম্বে তার সৈন্য ফেরত নিয়ে যেতে। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে কালবিলম্ব না করেই মহান ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নেন। সবকিছুকেই সন্দেহের চোখে না দেখে বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস, আস্থা, সততা এবং সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতেন। আমাদের বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনারও সেই সততা, বিশ্বাস এবং সাহস আছে।
ব্রিগেডিয়ার (অব.) এম আবদুল হাফিজ তার নিবন্ধে লিখেছেন, '১৯৯৬ সালে ২১ বছর রাজনৈতিক বনবাস থেকে ক্ষমতায় ফিরলেও ভারতকে ট্রানজিট দিতে সাহস পায়নি।' তিনি এরপরই আবার মনের মাধুরী মিশিয়ে লিখেছেন, '১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার মনমোহন সিং বা গুজরালের তুলে ধরা টোপে এতটাই প্রলুব্ধ হয় যে সরকারের কিছু কিছু শীর্ষ নেতা ভারতীয় নেতাদের ট্রানজিটের গুণকীর্তনে বিভোর থেকে তারা জাতীয় স্বার্থকে (হধঃরড়হধষ রহঃবৎবংঃ) সম্পূর্ণ ভুলে গেলেন।' তাহলে কি ওই সময় ট্রানজিট দিয়ে দিয়েছিল? একেই বলে দ্বিচারিতা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকে আমরা ২৪ বছর পাকিস্তানি সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আমাদের ভাষা-সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রক্ষার জন্য লড়াই করেছি। ধারণা করি এম আবদুল হাফিজ তখন পাকিস্তানে ছিলেন। আমরা ৯ মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ করেছি এবং দেশকে স্বাধীন করেছি_ বোধকরি তখনও তিনি ওই পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন। তা না হলে কী করে লেখেন, 'কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ বন্ধুসুলভ নব্য স্বাধীন বাংলাদেশও অনুগত থাকবে।' অনুগত আছে নাকি? কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকা আর বন্ধুসুলভ থাকার অর্থ কি অনুগত থাকা? রৌমারী এবং বেরুবাড়ী সীমান্তের কথা লিখেছেন, 'তখন তো আওয়ামী লীগ সরকারই ক্ষমতায় ছিল।' আমরা দেশবাসী এশীয় মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত হতে চাই। কাজেই 'নেব এবং দেব' ভিত্তিতে নিজস্ব নিয়ন্ত্রণেই ট্রানজিট দিতে অসুবিধা কোথায়? এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টওর কথা, ঞযব ড়হষু ঃযরহম বি যধাব ঃড় ভবধৎ রং ভবধৎ রঃংবষভ উচ্চারণ করে বলতে চাই, 'ওহে মাঝি সব ভয় জয় করে দিতে হবে পাড়ি, নিতে হবে তরী পার।'
-সেতাব উদ্দিন : মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ বেতার

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




