somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মৃত্যুঞ্জয় ঘাট (ম্যারিনা নাসরীন )

১৬ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(সম্প্রতি দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত আমার ছোট গল্প )
ইলেকট্রিক পিলারের সাথে পোস্টারটি কৌণিক হয়ে ঝুলে আছে। সম্ভবত ঝড়ে হার্ডবোর্ডটি কাত হয়ে গিয়েছে অথবা যে ব্যক্তি পোস্টারটি টাঙিয়েছে সে আনাড়ি ছিল। আবার এমন হতে পারে কাজটি সে যত্নের সাথে করেনি। মিজানের মনে হল শেষের কারণটি হবার সম্ভাবনাই বেশি।
পোস্টারের উপরের দিকে বাম পাশে স্যুট টাই পরা ভদ্রলোকের ছবিটি ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। নীচে বড় বড় লাল হরফে লেখা “সংগ্রামী নেতা......ভাইয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম।” সৌজন্যে মেয়র প্রার্থী আরমান ভাই। সংগ্রামী নেতার নাম বৃষ্টিতে বোধ হয় মুছে গিয়েছে। ডানপাশে আরমান ভাইয়ের ছবি কিছুটা অস্পষ্ট হলেও চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু নেতার চেহারা এত পরিচিত লাগছে কেন ? কোথাও কি দেখেছে ? মিজান কিছুক্ষণ ভেবে হাল ছেড়ে দেয়। নেতা মানুষ, হয়ত পত্রিকার কোন খবরে দেখে থাকবে।
মার্চের মাঝামাঝি সময়। ভালই গরম পড়েছে। চাদর মুড়ি দিয়ে মিজান রিকশায় বসে ঘামতে থাকে। তার ধারণা ছিল মফঃস্বল শহর রাস্তা হবে ফাঁকা। ঢাকার মত যানজটের বালাই নেই। কিন্তু শহরটা যেমন বড়, রাস্তাগুলো সেই তুলনায় অপ্রশস্ত এবং ঘিঞ্জি। পুরো রাস্তা জুড়ে রিকশা আর টেম্পোর সারি পিঁপড়ার মত সার বেঁধে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। মিজান কবজি উল্টে সময় দেখে। সাতটা দশ। হাতে এখনো দুই ঘণ্টার বেশী সময় আছে। সিগারেটের নেশা হচ্ছে । সে সিগারেট ধরিয়ে ঠোঁটে ঝুলিয়ে রাখে, কিন্তু টানে না। পাশের বহুতল শপিং মলের গায়ে ‘মিড পয়েন্ট’ লেখাটি জ্বলছে আর নিভছে। মিজান মনে মনে তলা গুনতে শুরু করে। ঠোঁটের সিগারেট তখনো ক্লান্ত ভাবে পুড়ছে।
বেশ অনেকটা সময় পার করে তাদের রিকশা যানজট ছেড়ে একটা মোটামুটি প্রশস্ত রাস্তায় এসে পড়ল। হালকা বাতাসে গায়ের ঘাম শুকিয়ে শীতল হয়ে যাচ্ছে। মিজান চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে বসে।
নামেন, আইয়া পড়ছি।
দুইদিনের ঘুমহীন ক্লান্ত শরীর, কখন যেন ঝিমুনি ধরে গিয়েছিল! রিকশাওয়ালার কথায় মিজান চোখ খোলে । জায়গাটি যথেষ্ট অন্ধকার। একটু দূরে স্ট্রিট লাইট থেকে আসা হালকা আলোয় গাছপালা ছাড়া কিছু দেখা যাচ্ছে না। মিজানের মনে সন্দেহের দানা বাঁধে। সে রিকশাওয়ালাকে ধমক দেয়,
এই বেটা! এটা কোথায় আনলি ?
এডাই তো মৃত্যুঞ্জয় ঘাট। এই বরাবর চইলা যান। ছাম্নেই পাইবেন।
রিকশাওয়ালা তর্জনী দিয়ে যেদিকে নির্দেশ করল সেদিকে সরু একটি পায়ে চলা রাস্তা চলে গিয়েছে। ভাড়া মিটিয়ে মিজান সেদিকে এগুতে থাকে। দুপাশে ঘন বড় বড় গাছের সারি । কিন্তু চারদিক এত সুনসান যে সে নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে উঠছে। এভাবে অচেনা মানুষের কথায় অজানা জায়গায় হুট করে চলে আসাটা বোধ হয় ঠিক হল না। কিন্তু পার্টি দামী। হাত একদম খালি। ট্রিপটা হাত ছাড়া করার উপায় ছিল না।
মিজান পকেটে হাত ঢুকিয়ে ছোট শীতল যন্ত্রটির গায়ে স্পর্শ করল। নিজেকে শুনিয়ে বলল, তুই থাকতে ভয় কিসের ? বেশিদূর হাঁটতে হল না মিনিট দুই চলার পরে দেখল সামনে পানি থইথই নদী।
এখানে মৃত্যুঞ্জয় ঘাট কোথায় ? সে ঝোলা ব্যাগ থেকে পেন্সিল ব্যাটারি চালিত ছোট্ট টর্চটি বের করে। পায়ের কাছে উঁচু নিচু কিছু ইটের স্তুপ। খেয়াল করে দেখল সেটাই সিঁড়ি। ভাঙা, আধা ভাঙা সিঁড়ি বেয়ে সন্তর্পণে নির্দেশনা মত শেষ ধাপে গিয়ে বসে। অদ্ভুত! জায়গাটা খুব পরিচিত লাগছে। অথচ সে আজই প্রথম এই শহরে এল।
পায়ের কাছে শীতল পানির স্রোত। কাল ছিল দোল পূর্ণিমা। আজকের চাঁদটাও ছোট নয়। চাঁদের আলো পড়ে নদীর স্রোতকে মেটালিক সাপের মত দেখাচ্ছে। ওপারে নদীর ধারেই একজায়গায় আগুন জ্বলছে। আশেপাশে ছোট ছোট আলোর মশালের সাথে বেশ কিছু মানুষের অবয়ব যেন স্থির পেন্ডুলাম। নদীটি প্রশস্ত নয় ফলে শ্মশানঘাটের হরিবোল ধ্বনি বাতাসে ভর করে মৃত্যুঞ্জয় ঘাটে খুব সহজে পৌঁছে গিয়েছে। জোসনা ভেজা নদী, লতাগুল্মের বুনো গন্ধ আর চিতার ধোঁয়া এসব কিছুর মধ্যে দৃশ্যটি পুনরায় দেখল মিজান। চরের ধূধূ বুকে দশ এগারো বছরের বালকটি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে। বরাবরের মত সে বালকটিকে চেনার চেষ্টা করে ভাবনায় অতলে ক্রমশ তলিয়ে যেতে থাকে।
আসেন।
ভরাট পুরুষ কণ্ঠে মিজানের সমস্ত ভাবনা ছিন্ন হয়ে যায়। ক্ষিপ্র গতিতে সে পকেট থেকে পিস্তল বের করে আনে কিন্তু তার আগেই ওর পিস্তল ধরা হাতটি লোকটির সাঁড়াশির মত পাঞ্জায় আঁটকে পড়েছে।
লোকটি প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। চাদর দিয়ে পুরো মুখ প্রায় ঢাকা। আলো আঁধারির মধ্যে বেখাপ্পাভাবে ঝুলে থাকা তার নাকটা কেবল দেখা যাচ্ছে।
ভাই পাঠাইছে । চলেন।
আগন্তক আদেশের সুরে কথাটি বলে সিঁড়ি ভেঙে উঠে যাচ্ছে। মিজান নিঃশব্দে তাকে অনুসরণ করে।
নদীর পাশ দিয়ে ইট বিছানো সরু রাস্তা। ঝোপঝাড়ের ছায়া আর চাঁদের আলো মিশে রাস্তাটিকে তেলজলে আঁকা বনভুমির ক্যানভাসের মত লাগে। নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে সেই ক্যানভাসের উপরে রহস্যময় ছায়া ফেলে তারা হাঁটছে। মিজান খেয়াল করল লোকটি সাধারণের তুলনায় বেশ দীর্ঘকায়। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে চলে। গুপ্ত ঘাতক সম্প্রদায়ের নেতা আলমুত পর্বতের সেই বৃদ্ধ লোকটি মানুষ খুনের নেশায় ঠিক এই ভঙ্গীতে নেমে আসত যার নাক ঈগল পাখির ঠোঁটের মত বাঁকা ছিল।
কিছুদুর এগিয়ে লোকালয়। লোকালয় বলতে বস্তি এলাকা। রাস্তা থেকে একটু নীচে অসংখ্য খুপরি ঘর। বেশীরভাগ ঘর অন্ধকার তবে দুই একটিতে কুপি জ্বলছে। লোকটি মিজানকে নিয়ে তারই একটিতে প্রবেশ করে। দেশলাই জ্বালিয়ে মোমবাতি ধরিয়ে বলল,
টেবিলে খাবার আছে আপনি খেয়ে বিশ্রাম নেন। আমি ঠিক বারোটায় আসব।
সস্তা দামের চাদর বিছানো একটা চৌকি, পাশে ঘুনে খাওয়া টেবিল। মেঝেতে কেঁচোর তোলা চানাচুরের মত গুটি গুটি মাটি ছড়িয়ে আছে। মিজান আগে বহুবার বস্তিতে কাটিয়েছে সুতরাং তার কাছে নতুন কিছু নয়। লোকটির বেরিয়ে গেলে মিজান দরজা বন্ধ করে সটান শুয়ে পড়ে। খাবারের ঢাকনা আলগা করেও দেখে না। যেদিন মানুষ খুন করার মত কোন কাজ থাকে সেদিন সে পানি ছাড়া কিছু খায় না। খালি পেটে তার মাথা খুব ভাল কাজ করে।
দরজায় টুকটুক শব্দ হচ্ছে। মিজান চোখ খুলে টিনের বেড়ায় লাগনো ঘড়ির দিকে তাকায়। ঠিক বারোটা। লোকটি ঘরে ঢুকে বিছানার উপর দুই বান্ডিল টাকা ছুঁড়ে ফেলে,
গুণে নেন দুই লাখ আছে।
পাখির পরনে সাদা পাঞ্জাবী, নীল জিন্স, চোখে চশমা থাকবে। মাথায় হালকা টাক আছে। আমি চিনিয়ে দেব। তবে খুব সাবধান। উনার সাথে কিন্তু পিস্তল থাকে। হাতের টার্গেট খুব ভাল। গত সরকারের আমলে কয়েকটা খুনের আসামী ছিল।
শিকারকে ওদের ভাষায় পাখি বলে। মিজান বুঝতে পারে আজকের অপারেশন অত সহজ হবে না। তবে সে কোন প্রশ্ন করে না। কাউকে মারতে গিয়ে ফিরে এসেছে এরকম কোন ইতিহাস তার নেই।
সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে উনাকে খোন্দকার হাউজের সামনে পাওয়া যাবে। সাথে আমাদের ভাই থাকবেন। ভাই যখন সিগারেট ধরাবেন তখন কাজটি সারতে হবে। কোন সমস্যা বুঝলে আমি আপনাকে সংকেত দেব। কাজ শেষে এই শহরে এক মুহূর্ত দেরী করবেন না। আপনি আপনার মত চলে যাবেন।
লোকটি এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামে । তারপর আবার বলে,
আর কিছু জানার আছে ? আর একটা কথা, জীবিত রেখে ফিরে আসলে আপনার বেঁচে থাকা কঠিন হবে।
নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া মিজান কথা বলে না । এ ক্ষেত্রে সে কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করল না শুধু শীতল দৃষ্টিতে লোকটিকে কয়েক মুহূর্ত দেখল । তারপর টাকার বান্ডিল দুটি ঝোলায় ঢুকিয়ে ঘর থেকে বেরোবার জন্য প্রস্তুত হল ।
মূল শহর বস্তিটির কাছেই । হেঁটে যেতে দশ মিনিটের বেশি সময় লাগলো না । রাস্তা জনশুন্য । পুরো সময়টায় মিজান মাত্র তিন খানা রিকশার দেখা পেয়েছে। তার মধ্যে দুইখানায় কোন যাত্রী ছিল না। একজন পুরুষ দুই হাত দুদিকে মেলে এমনভাবে হেঁটে গেল যেন সে পাখি হয়ে উড়ছে। অন্য পুরুষটি টলমল পায়ে তাকে নিবৃত করতে চেষ্টা করছে। ঘেয়ো কুকুরের দল ময়লার মধ্যে খাবার খুঁজতে গিয়ে যতটুকু উত্তেজনা ছড়ায় সেটুকু ছাড়া শহরটিকে নগর বিচ্ছিন্ন কোন দ্বীপের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।
ডাস্টবিন পার হয়ে তারা অপেক্ষাকৃত নির্জন এবং অভিজাত এলাকায় এল। এখানে ময়লা ড্রেন বা কুকুরের উত্তেজনা নেই। দীর্ঘ নাক বিশিষ্ট লোকটি ঠিক আগের মত ঝুঁকে ঝুঁকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল। হটাৎ সে ঠোঁটে তর্জনী রেখে শিকারী কুকুরের মত দু পা পিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। মিজান সতর্ক হয়ে শ্যেন দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বুলায়।
কয়েক গজ দূরে রাস্তার বামপাশে আধুনিক ধাঁচে করা বিশাল দোতলা বাড়িটি রাজকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বাগানবিলাস ছাওয়া উঁচু গেটের দুপাশের গোল বাল্বের আলোয় রাস্তার কিছু অংশ আলোকিত। গেটের ঠিক উল্টো পাশে সাদা সাইনবোর্ডে কালো অক্ষরে লেখা ‘কাকনি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়’। লেখাটা চোখে পড়ার সাথে সাথে মিজানের মগজে কালো অক্ষর গুলো কিড়ার মত কিলবিল করতে শুরু করেছে। মাথায় অসহ্য ব্যথা। চোখ খুলে রাখা যাচ্ছে না। অথচ সামনের লোকটি ওকে ইশারায় কাছে ডাকছে। কেন এমন হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। কিছু সময়ের জন্য সে স্থির হবার চেষ্টা করে। মগজের সাদা পাতায় ততক্ষণে অক্ষর গুলি পিঁপড়ার সারীর মত পাশাপাশি দাঁড়িয়েছে। ওর ব্রেনের কোন একটি অংশ অনেকগুলো স্মৃতি নোটিশ আকারে প্লট বদলে বদলে চোখের সামনে এনে হাজির করছে। মা, বাবা, দাদী, জেবুন্নেসা শান্তি নিকেতন, কাকনী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৯৭১, গুলি, রক্ত, মৃত্যুঞ্জয় ঘাট।
স্কুলটি ঠিক তেমনই আছে যেমনটি আঠার বছর আগে ছিল। বামপাশের দোতলা বাড়ির জায়গায় ছিল একতলা টিনশেড, একটা টিউবওয়েল তার পাশে শিউলি ফুলের গাছ।
ছোট গেটের এক পাশের দেওয়ালের লেখা ছিল ‘জেবুন্নেসা শান্তি নিকেতন’। জেবুন্নেসা মিজানের দাদীর নাম। লেখাটি নেই তার বদলে দামী টাইলসে খোদাই করা ‘খন্দকার হাউজ’।
মিজানের দৃষ্টি ‘খন্দকার হাউজের’ গেটে স্থির হয়ে আছে । ওখানে রুমা নামের ওর ফর্সা রঙের তরুণী মা পকেট গেটে বাম হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। ডান হাত থেকে দুরন্ত ছেলেটি এক দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে কাকনী প্রাইমারী স্কুলের গেটে ঢুকে গিয়ে মুহূর্তে আবার ফিরে এল। দুহাত নাড়িয়ে সে চিৎকার করে বলছে,
মা এখনো দাঁড়িয়ে আছ কেন ? ঘরে যাও। ছুটির ঘণ্টা পড়লে আসবে।
মা হাসি মুখে তবুও দাঁড়িয়ে থাকে।
রেডি হন। পাখি চলে আসছে।
কানের কাছে চাপা শব্দে ব্রেনে চলমান সেলুলয়েডের ফিতা থেমে গেল। গেটের সামনে লাল রঙের একটি কার এসে দাঁড়িয়েছে । বাম পাশের দরজা খুলে প্রথমে যে লোকটি গাড়ি থেকে নামল তাকে চিনতে মিজানের একদম কষ্ট হল না। ইলেকট্রিক পিলারে ঝুলে থাকা পোস্টারের সেই আরমান ভাই। যে কিনা এই শহরের সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী। আরমান ভাই ঘুরে গিয়ে ডান পাশের দরজা খুলে এমন নত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়েছে যেন মহামান্য কেউ নামবেন। গাড়ি থেকে নেমে আসা দ্বিতীয় লোকটির পরনে জিন্সের প্যান্ট, সাদা পাঞ্জাবী, চোখে চশমা। মাথায় হালকা টাক । এই লোকই যে তার আজকের শিকার তাতে সন্দেহ নেই । কিন্তু লোকটির দিকে মনোযোগ দিতেই মিজানের শরীরের রক্ত খলবল করে উঠল। পোস্টারে দেখা সংগ্রামী নেতার আবছা ছবিটি ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে। মিজানের চোখের দৃষ্টিতে আগুন।
আজমল রাজাকার!
১৯৭১ সালের অক্টোবরের সেই রাতটি বেশ অন্ধকার ছিল। গভীর রাতে মায়ের ধাক্কায় মিজান ঘুম ভেঙে দেখল লম্বা দাঁড়ি আর টুপি ওয়ালা লোকটি ওর গা ঘেঁষে বসে আছে। মোচের ফাঁকের ঠোঁট ফেটে চৌচির। গায়ের নোংরা কাপড়ে বোটকা গন্ধ। উটকো লোকটি তার বিছানায় কেন ভেবে মায়ের উপর খুব বিরক্ত লাগছিল। কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই মিজান নোংরা লোকটির বুকে আকুল হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর মুখ থেকে শুধু তোলপাড় করা একটি শব্দ শুধু বেরিয়ে এসেছিল,
বাবা!
দীর্ঘ তিনমাস পর সে বাবাকে দেখছে। এগার বছরের মিজানের কাছে বাবা তখন মহানায়ক যিনি স্বাধীনতার যুদ্ধের বীর পুরুষ। ওইটুকু সময়ে যুদ্ধের গল্প শুনতে শুনতে মনে হয়েছিল সে দিব্য চোখে দেখতে পাচ্ছে বাবা কিভাবে গেরিলা এটাক করে হানাদার বাহিনীকে ধ্বংস পরাজিত করছে। দাঁতে পিন খুলে গ্রেনেড মেরে পাকিস্তানী বহর উড়িয়ে দিচ্ছে।
বাবার হাতে বেশী সময় ছিল না। তাকে আবার যুদ্ধে চলে যেতে হবে। দাদী বাবার হাত ধরে বললেন,
বাপজান না গেলে হয় না ?
দেশের কি হবে মা ?
দাদী আর কিছু বললেন না। তার হাতের তসবিহ বাবার মাথায় ছুঁয়ে দিলেন। মা খুব অসহায় ভঙ্গীতে বাবার দিকে চেয়ে ছিল। বাবা একটু হেসে বলল,
রুমা আমি যদি ফিরে না আসি, মাকে অযত্ন করো না। মিজানকে দেখে রেখ।
মায়ের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। বাবা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে মিজানকে বুকের মধ্যে বেশ কিছু সময় চেপে ধরে রাখল। মিজানের অস্থির লাগছিল। সে মায়ের কাছে শুনে শুনে যুদ্ধের অনেকগুলো ছবি এঁকেছে। ভেবে রেখেছিল বাবার পকেটে দিয়ে দেবে। কিন্তু একদম মনে ছিল না। মিজান বাবাকে ছেড়ে দৌড়ে নিজের ঘরে গেল।
তাড়াহুড়োর সময় কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না ড্রয়িং খাতা খুঁজতে খানিকটা সময় লাগল। কোন ছবিটা দেবে সেটাও ভাবতে সময় লাগছে। একটা ছবিতে বাবা পাকিস্তানী আর্মিদের দিকে রাইফেল তাক করে আছে। মাথার কাছে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। মিজান একটানে ড্রয়িং খাতার ওই পাতাটি ছিঁড়ে বের হতে যাবে সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল।
ড্রয়িং কাগজটি পকেটে রেখে মিজান দরোজার একটা পাল্লার আড়ালে দাঁড়িয়ে বাইরে যা দেখল তাতে শরীর হিম হয়ে এল। বাবার বুকে রাইফেলের নল লাগিয়ে খন্দকার দাদার ছেলে রাজাকার আজমল। আগে মিজান তাকে আজমল চাচা বলত এখন অন্যদের সাথে সাথে সেও আড়ালে আজমল রাজাকার বলে। লোকটা বাবাকে উদ্যেশ্য করে কিছু একটা বলছে। মিজান সেটা শুনতে পাচ্ছে না। বেশি সময় নয়, পর পর অনেকগুলো গুলির শব্দ হল। বাবার শরীরটা একটু দূরে ছিটকে পড়েছে। মিজান থরথর করে কাঁপছে। বুক চিরে ‘বাবা’ শব্দটা বেরিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু কোন শব্দ বের হল না। ওর বিস্ফারিত নীরব চোখের ফটোলেন্স একটি চেহারায় ঘনঘন শাটার ফেলছে যে চেহারাটিতে বাবার রক্তের ছিটায় এই মুহূর্তে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
মিজানের মগজে ঘূর্ণি থেমে গিয়েছে। টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো জোড়া লেগে হারিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ সময় ওর মাথায় এখন একটি চলমান চিত্র। এই মুখটিকে সে লক্ষ বার কল্পনায় আনার চেষ্টা করেও পারেনি। এই একটি মানুষ ওকে খুনি বানিয়েছে। আঠারটি বছর ধরে ও নিজেকে চিনতে চেষ্টা করেছে, পারেনি। মানুষের অনুগ্রহের টুকরোয় যে জীবন ওর অতিবাহিত করতে হয়েছে সেটা ওর নিজের ছিল না। মিজানের রক্ত চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। ওর ভেতর জেগে উঠেছে ঐশ্বরিক শক্তি। গেটের সামনে সে লোকটির কাছে এগিয়ে যাচ্ছে যে লোকটির মুখে লেগে রয়েছে ওর বাবার বুক থেকে ছুটে আসা ছোপ ছোপ রক্ত।
এই মিয়া কই যান ? মরবেন নাকি ? ভাইজান সিগারেট ধরাইছে ?
লম্বা লোকটির চাপা আওয়াজ মিজানকে থামাতে পারে না। মিজানের বাম হাত জামার বুক পকেটে যেখানে ওর বাবার জন্য আঁকা সেই ছবিটি এখনো সংরক্ষিত আছে। ডান হাত পিস্তলের বাটে। কয়েক সেকেন্ডে পিস্তলের সব গুলি মিজান খালি করে ফেলল । আজমলের রক্তে মিজানের মুখ ঠিক সেভাবে রক্তাক্ত হল যেভাবে ওর বাবার রক্তে আজমলের মুখ রঞ্জিত হয়েছিল। লোকটির শরীর নীচে পড়ে যাওয়া পর্যন্ত মিজান অপেক্ষা করল তারপর থু করে এক দলা থুতু ফেলে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে গেল।
সে ভোরে ওরা চলে যাবার অনেক পরে বাড়িটা লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। কে একজন মিজানকে ওর বাবার কাছে নিয়ে গিয়েছিল। খুব ইচ্ছে হয়েছিল মুখটা দেখে কিন্ত উপুড় হয়ে পড়ে থাকা বাবাকে দেখার সুযোগ হয়নি। চারপাশে মাছি উড়ছে। একটু দূরে শিউলি তলায় মা আর দাদী। কিছু শিউলি ফুল ও বোধ হয় পড়ে ছিল নাকি চোখের ভুল। পাশ দিয়ে একটা রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছে। দাদীর হাতে সাদা তসবির রঙ ও লাল। মিজানের চোখে পানি ছিল না ফলে সব স্পষ্ট দেখেছিল। কে একজন কানের কাছে ফিসফিস করে ক্রমাগত বলছিল। মিজান পালা, বাবা পালা।
বাড়ি থেকে এক দৌড়ে মিজান মৃত্যুঞ্জয় ঘাটে এসেছিল তারপর অনেকের সাথে নৌকায় নদী পার হয়ে ধূধূ চরে যখন ছুটছে তখন নদীর এপারের সবকিছু ঝাপসা। মা, বাবা, দাদী, গুলি, রক্ত, মৃত্যুঞ্জয় ঘাট, সব কিছু ধূলিময় ফটোগ্রাফের মত ঝাপসা।
মিজান ঘোরের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে মৃত্যুঞ্জয় ঘাটে চলে এসেছে নিজেও জানে না। ওপারের আগুন নিভে গিয়েছে। রাতের গভীরে রাত। মিজান গায়ের চাদর, টাকার বান্ডিল, আর ছোট্ট ভারী শীতল সঙ্গীটিকে এক এক করে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। নদীর বুকের মেটালিক সাপ গুলো একটু চঞ্চল হয় তারপর ¬¬¬¬-পুনরায় করগেটেড ভঙ্গীতে চলতে থাকে।
মিজান পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজটি বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে। মলিন হয়ে সেটি প্রায় শুকনো বাঁশ পাতার মত রঙ ধারণ করেছে। বাবার চেহারাটিও ঝাপসা তবে পতাকার সবুজ রঙের তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি। পতাকার বুকে হলুদ রঙে আঁকা মানচিত্রটি চাঁদের আলোয় ধূসর দেখায় ।
ধীরে খুব ধীরে একটি ছায়া কাগজটিকে গ্রাস করছে। মিজান কোন ধাতব যন্ত্রের ক্লিক শব্দটি শোনার প্রায় সাথে সাথে ধারালো ছুরির ফলা পিঠ থেকে বাম পাঁজর ফুঁড়ে বেরিয়ে এল। কোনরকমে সামলে নিয়ে পেছন ফিরে সে আততায়ীকে চিনতে চেয়েছিল এবার ছুরির আঘাতে ডান পাঁজর থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটল। নিয়ন্ত্রণহীন শরীর উল্টে পড়ার মুহূর্তে আলমুত পর্বত থেকে নেমে আসা কল্পনার সেই বৃদ্ধ লোকটিকে সে দেখতে পেল যার নাক ঈগলের ঠোঁটের মত বাঁকা ছিল।
অতঃপর মিজানের শরীর যখন বহমান নদীর গভীর থেকে গভীরে তলিয়ে যাচ্ছে তখন স্রোতের অনুকূলে রক্তের সাগরে ভাসছে, ওর বাবা, সবুজ পতাকা এবং ধূসর মানচিত্রে আঁকা পুরো বাংলাদেশ ।




সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:২৪
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×