somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিন্দু থেকে বৃত্ত ( ম্যারিনা নাসরীন)

০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

লাশটি শাড়ি দিয়ে ঢাকা ছিল। সবুজ প্রিন্টের পুরনো ছেঁড়া খোঁড়া শাড়ি। একটি চোখ বেরিয়ে আছে। নিমীলিত, শান্ত, শ্রান্ত। দুটো মাছি উড়ছে। মাথার কাছে আগরবাতিতে মিহি ধোঁয়া। যুবকটি পায়ের কাছে। শীর্ণকায়, হালকা শ্মশ্রুমণ্ডিত, খালি পা। ঠোঁটে নেশার চিহ্ন। চোখে ঘোর। সামনে পেতেরাখা ময়লা গামছায় দুইটাকা,পাঁচ টাকা, দশ টাকা। পঞ্চাশ একশ টাকাও দুই একখানা দেখা যাচ্ছে। সাথে কয়েকটি বাগান বিলাস ফুল। ওপাশের কর্পোরেট অফিসের গাছ থেকেঝরে পড়েছে বোধ হয়। যুবকটি জোড়হাত, চুপচাপ। কথা বলছে তার পেছনে দাঁড়ানো মধ্য বয়স্ক লোকটি।
পোলাডার মায় মরছে।আফা কিছু দিয়া যান।
কয়েকজন দরিদ্র নারী-পুরুষ লাশটিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের চেহারায় দুঃখী মানুষের ছাপ। সুবেশী পথচারীরা কেউ কেউ উঁকি দিয়ে রাস্তা মাপছে। কোন কোনজন সেটিও করছে না।
লোকটি যোগ করে,
বুড়া বেডি ব্রিজডাই বইয়া ভিখ মাইগা খাইত। আইজ আইয়া দেখতাছি মইরা পইড়া রইছে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দুইপা এগিয়ে গিয়েছিল অন্তরা। আবার ফিরল।
দয়া করেন,টেকার লাইগা ছেড়া মায়ের লাশ বাড়িত লইবার পারতাছে না।
ব্যাগ থেকে খুচরা টাকার কয়েক খানা গামছায় ফেলে দিয়ে অন্তরা সামনে এগোয়।কত ছিল গুণে দেখেনি। ইচ্ছে করেনি।

একটু হাঁটতেই হাতের ডানে পরিবাগের ফ্ল্যাটগুলো দেখতে বেশ নান্দনিক।বাউন্ডারীর ভেতরে অনেকখানি খোলা জায়গায় ঘাস বিছানো। প্রতি ফ্ল্যাট থেকে নানা ধরণের ফুল গাছ লতা পাতাঝুলছে। এর আগে যাওয়া আসার সময় মাঝে মাঝে ভাবনা আসত এমন জায়গায় একটা ফ্ল্যাট থাকলে মন্দ হয়না। আজ কিছু মনে হল না।
লাশটি দ্রুত দাফন করতে না পারলেপচন ধরবে। একদিকে এই ফ্ল্যাট অন্যদিকে দাফনের অপেক্ষায় ফুটপাতের লাশ।কি অদ্ভুত সমান্তরালে তাদের অবস্থান!
অনেকগুলো রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু এলিফ্যান্ট রোডে যেতে কেউ রাজী নয়। কাছের খ্যাপে পোষায় না।
ও হাঁটতে শুরু করে। পাশে পাশে কত কত মানুষ যাচ্ছে, আসছে। হেঁটে, রিকশায়, গাড়ীতে। তারা কোথায় যায়? কোথা থেকে আসে? ওই যে মেয়েটি, পথের দিকে চোখ। চটি পায়ে। বিষণ্ণ, মায়াবী চেহারা। জামার ঝুল নিতম্বের উপর দুলছে। এই জামা এখন সেকেলে। এখন ফ্লোর টাচ জামার যুগ। রঙবেরঙের নানা ধাঁচের লেস মাটিতে গড়াগড়ি দেবে, হাসবে, নাচবে। আহ্লাদী মেয়েরা এক হাতে জামার খুঁট উঁচু করে হাঁটবে। মেয়েটি পাশ কেটে চলে গেল।
রিকশায় অল্প বয়সী দুজন ছেলে মেয়ে আসছে। প্রেমিক প্রেমিকা বোধ হয়। মেয়েটির ডান হাত ছেলেটির হাতের মুঠোয়। মুখে নির্ভরতার ছাপ। বৃদ্ধ রিকশাওয়ালা খুব ধীরে প্যাডেল করছে। চড়চড়ে রোদের ফোঁটা ফোঁটা ঘাম তার কপালে, নাকে, পাতলা চুলের ফাঁকে। এলোমেলো, বিক্ষিপ্ত। ওরাও অন্তরাকে অতিক্রম করল। ছেলেমেয়ে দুটির যুগল হাসি বাতাসে উড়ছে। কি নিয়ে হাসছে ?
সামনে বাটা মোড়।হঠাৎ একটি কালো প্রাডো বেয়াড়া ভাবে ফুটপাতের গা ঘেঁষে পায়ের কাছে থামল। অন্তরা চট করে দুপা পিছিয়ে আসে। মেজাজ বিগড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল । কিন্তু খোলা জানালার ওপাশে খুব পরিচিত মুখ দেখে থেমে যায়। রুবিনা। আগের মতই ঠোঁট দুটো টিয়ে পাখির ঠোঁটের মত লাল টকটকে করে রেখেছে।
এই অন্তরা, উঠে আয়।
পাঁচ বছর পরে আজ প্রথম দেখা! এমন আহ্বান একমাত্র রুবিনাই করতে পারে।
না রে, অনেক কাজ আছে। বরং তুই নেমে আয়, এখানেই কিছুক্ষণ কথা বলি।
মাতবরি করিস না। সামনেই বাসা। চল বাসা চিনে আসবি।
ওর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। শুনবে না। হয়ত রাস্তার মাঝেই স্ল্যাং কোন কথা বলে বসবে।সাথে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
রোদ তাপে ঘেমে শরীরটা নেয়ে উঠেছিল। গাড়ীতে বসে মনে হচ্ছে মেরুদন্ড বেয়ে বরফ শীতল পানি নামছে। এয়ার ফ্রেশনারের মিষ্টি গন্ধ। হালকা মেজাজের গান বাজছে,
সখী ভাবনা কাহারে বলে সখী যাতনা কাহারে বলে...
কিছুদিন আগে অন্তরা একটা সেকেন্ড হ্যান্ড করোলা এক্স কিনেছে। গাড়িটিতে স্টার্ট দিলে ইঞ্জিন খটমট করে রেগে মেগে ওঠে। অভিজাত প্রাডো, কত নিঃশব্দে গুরুগম্ভীর দেমাগি চালে চলছে!
রোদের মধ্যে হেঁটে হেঁটে কোথায় যাচ্ছিস ? তুই সেই আগের মত হিসেবী রয়ে গেলি। কেন চাকরী বাকরি কিছু করছিস না ?
রুবিনা কখনো সহজ ভাবে কথা বলতে পারে না। একটা হুল ফুটিয়ে দেবেই।
হিসেবী না হলে চলে? তোর মত বড়লোক নই তো। ছোট-খাট একটা চাকরী করছি। প্রাইভেট ফার্মে।
তারমানে গাধার খাটুনি? তুই পারিস বটে !
বাহ! টাকা দেবে খাটতে হবে না ? কিন্তু তুই তো খুব মৌজে আছিস দেখছি। ব্যবসা করছিস নাকি চাকরী ?
আমি ব্যবসা করব ? মেয়ে হয়ে জন্মেছি কি জন্য ? স্বামী আয় করবে আমি উড়াব। তাই না ?
বুঝেছি, লক্ষপতি ধরেছ।
লক্ষপতি নয়, বল কোটিপতি। বাবুর্চির রান্না খাই, গাড়ীতে ঘুরে বেড়াই, শপিং করি, আড্ডা দেই, আর কি চাই ? তোকে দেখে খুব খারাপ লাগছেরে। কত খেটে খুটে এত ভাল রেজাল্ট করলি। কি লাভ হল বল? একটা সরকারী চাকরী তো জোগাড় করতে পারলি না ।
লাভ হয়েছে। ও তুই বুঝবি না।
আমার বুঝে কাজ নেই বাপু অত কষ্ট করতে পারব না । কয়দিনের জীবন? আচ্ছা বাদ দে। বিয়ে করলি কাকে? ক্যাম্পাসের সেই গুড বয় শওকতকে ?
হ্যাঁ। ও ছাড়া আর কেউ রাজী হল না তো!
আহা ঢং! পাঁচ বছর চুটিয়ে প্রেমটা করল কে ? কি করছে ও এখন ?
একটা সরকারী কলেজের প্রফেসর।
শেষ পর্যন্ত কলেজের মাস্টার ?
রুবিনার কথা শুনে মন খুব খারাপ হল। চীন-মৈত্রী হলে প্রায় দুই বছর দুজনে এক রুমে কাটিয়েছে। উত্তর বঙ্গের ছোট্ট মফঃস্বলের মেয়ে রুবিনা। প্রথম প্রথম বেশ গেঁয়ো ছিল। একবার নুডুলস খেতে গিয়ে বমি করে সে কি লঙ্কা কাণ্ড! ঢাকার কিছু চিনত না। অন্তরাই ওকে সব চিনিয়েছ। সেই রুবিনা কয়েকদিনের মধ্যে নিজেকে আগাগোড়া বদলে ফেলল। প্রতিদিন নিউ লুকে ভার্সিটিতে হাজির হত। প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতা, যথেষ্ট সুন্দরী মেয়ে। তারপর রঙঢং কম জানত না। ওর পেছনে রোমিওদের লাইন পড়ে গিয়েছিল।রুবিনাও মউকা বুঝে বেছে বেছে বড় ঘরের এক একটা দুলালকে বরশী গেঁথে খেলিয়ে বেড়াতে লাগলো। একেক জনের মেয়াদ ছিল বড় জোর ছয় মাস থেকে একবছর। অন্তরা যখন দুপুরে রুমে বসে আলুভর্তা করছে রুবিনা তখন নামী হোটেলে বন্ধুর সাথে মুরগির হাড় চিবুচ্ছে। শওকত ছিল ক্লাসের গুড বয় টাইপের ছেলে। নিতান্ত ভদ্র, মুখচোরা,পড়ুয়া। সে যে কোন যাদুতে রুবিনার জালে আটকেছিল সেটা অন্তরা আজো বুঝে পায় না। আট মাসের মাথায় রুবিনার কাছে শওকতের ম্যানুফ্যাকচারিং ডেট যথামত এক্সপায়ার হয়ে গেল। শওকত খুব ভেঙে পড়েছিল। অন্তরার পাশে চুপচাপ বসে থাকত । একদিন তারা আবিস্কার করেছিল তাদের মধ্যে অদৃশ্য একটি সংযোগ সুতো ঝুলছে। আজো এই সুতো অটুট।
এত বছর পর শওকতের প্রফেশন নিয়ে রুবিনার তাচ্ছিল্য অন্তরার মনে বেশ খানিকটা হতাশার বিষণ্ণ বাতাস বইয়ে দিল। এভাবে না বললে পারত। অন্তরা সেদিকে না গিয়ে হালকা হতে চায়,
আমার কথা বাদ দে। তোর তো মালদার রোমিওর অভাব ছিল না। শেষ পর্যন্ত কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ল?
ধুর! কারো ভাগ্যেই নয়। আমি কি বোকা নাকি ? ওগুলো চুনোপুঁটি। টাইম পাস করা চলতে পারে। বিয়ে নয়। বাবা একটা পাত্তিওয়ালা দেখে বর পছন্দ করল। আমিও ঝুলে পড়লাম।
ছেলে মেয়ে কয়জন ?
একটা ছেলে । তোর ?
এক ছেলে, এক মেয়ে ।
সোনার চুড়ি ভর্তি হাত নেড়ে নেড়ে রুবিনা তার রাজপাটের গল্প শোনাচ্ছে। নাকে বসানো হীরের ফুল থেকে রঙধনু ঠিকরে পড়ছে। অন্তরা কিছু কথা শুনছে, কিছু শুনছে না। ভেতরে ভেতরে অস্থির লাগছে। বারোটা বাজতে চলল। সপ্তাহে এই একটা দিন ছুটি। সারা সপ্তাহে জমে থাকা নানা কাজ সারতে হয়। দুই ছেলেমেয়ে, ওদের বাবা ঘরে থাকে। অন্য দিন নটা ছটা অফিস সেরে ঘরে ফিরতে প্রায় আটটা বাজে। ছুটির দিনে অন্তরা বাচ্চদের পছন্দমত স্পেশাল কিছু রান্না করে। তারপর সবাই মিলে গল্প গুজব করতে করতে খাওয়া দাওয়া, আড্ডা।
শওকতের একটা বাতিক রয়েছে। শুক্রবার বিকেলে ও মোটেই ঘরে থাকতে চায় না। কোথাও না কোথাও ঘুরতে যাওয়া চাইই। কোন থিয়েটারে কি নাটক চলছে, কোথায় কোন সংগীতের অনুষ্ঠান,গ্যালারি গুলোর প্রদর্শনী, সবকিছুর খোঁজ খবর আগে ভাগে নিয়ে রাখে। তারপর বিকেল হলে ছেলেমেয়ে সহ হইহই করে ঘুরতে বের হয়। অন্তরাকেও শাড়ি পরে সেজেগুজে সাথে যেতে হয়। ছোট্ট গাড়ীটি ও নিজে চালায়। ফেরার পথে এটা খাও সেটা খাও। প্রথম প্রথম ওর এই পাগলামিতে বিরক্ত লাগত। এখন বরং না বেরুতে পারলে খারাপ লাগে। আজ জাতীয় নাট্যশালায় মহাকালের ‘শিখণ্ডী কথা’ দেখার প্ল্যান ছিল। রুবিনার পাল্লায় পড়ে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাবে।
এই যে চলে এসেছি। রুবিনার কথায় চিন্তার সুতো ছিঁড়ে যায়। সেন্ট্রাল রোডে বেশ উঁচু গেট পার হয়ে গাড়ীটি একটা প্রশস্ত পোর্চে ঢুকছে। ওর ফ্ল্যাট তিনতলায়। সাড়ে তিন হাজার স্কয়ার ফিটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। অল দ্য ফিটিংস আর ইম্পোর্টেড। স্বামী এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যবসা করেন তাই এই সুবিধা। ধানমন্ডিতে আর একটি বাড়ি রয়েছে। আগামী ইলেকশনে রানিং সরকারের নমিনেশন পাবার সম্ভাবনা উজ্জলতর। কেয়ারিং স্বামী,কেয়ারিং বাবা। রুবিনার রাজপাটের গল্পে এগুলো ঘুরে ফিরে বারবার আসছিল।
ও বাড়িয়ে বলেনি। ঝাঁ তকতকে ফ্ল্যাট। স্বচ্ছ কাঁচের মত ঝকঝকে টাইলসে অন্তরা সাবধানে পা ফেলে। ইলেক্ট্রিক্যাল সুইচ থেকে শুরু করে ঝাড়বাতি পর্যন্ত সবকিছুই বিলাসী। ডিম সাইজের বিশাল ড্রয়িং রুমে নরম তুলতুলে বিড়াল কুশনে পিঠ ডুবিয়ে অন্তরাচারপাশ নজর বুলায়। ভারী আসবাবে জমকালো ভাবে সাজানো। দেওয়াল জুড়ে দামী দামী ওয়াল শো পিস, পেইন্টিংস। কর্নার সেলফে বিভিন্ন সাইজের বনসাই। হালকা শেডের লাইট ঘরটিকে আলো আঁধারী করে রেখেছে। লো ভলিউমে ওর খুব প্রিয় একটা ইংরেজি গানের সুর বাজছে,
সুইট ডিসপজিশন
নেভার টু সিন
ওহ রেকলেস এবান্ডন
লাইক নো ওয়ানস ওয়াচিং ইউ...।
একেই বলে কপাল! স্টুডেন্ট লাইফে বন্ধুবান্ধব নিয়ে মৌজে কাটিয়েছে। আর এখন তো মহারানীর হাল! সূক্ষ্ম একটা ঈর্ষার হুল, একটা অব্যক্ত কষ্ট বোধ অন্তরার মনের কোণে খচ খচ করে বিঁধছে। ও খুব সচেতনভাবে সেটি লুকিয়ে ফেলে,
তোর ছেলে কোথায় ?
ও তো দেশে থাকে না । ওর বাবা দার্জিলিংয়ে পড়তে পাঠিয়েছে।
একমাত্র সন্তান, দূরে রেখে থাকিস কিভাবে ?
অভ্যাস হয়ে গেছে। রুবিনার মুখের উপর দিয়ে কালো এক খণ্ড মেঘ ভেসে গেল। ও একটু বদলে গেল।
অবশ্য উন্নত শিক্ষা দিতে হলে তো এটুকু কষ্ট করতেই হবে। ভাল করেছিস।
অন্তরা কথা ঘুরিয়ে ফেলে।
কথার ফাঁকে অল্প বয়সী একটা ছেলে ট্রেতে করে দু গ্লাস জুস নিয়ে এল। গ্লাস দুটি নজর কাড়া। নীচের সরু অংশ সোনালী রঙের। বর্ডারও সোনালী। শরীর জুড়ে ছোট্ট ছোট্ট বেগুনী ফুলের অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজ। জুশের উপর বরফের টুকরো ভাসছে। গ্লাসের গাঁয়ে জমে ওঠা ফোঁটা ফোঁটা পানি দেখে বৃদ্ধ রিকশাওয়ালাটির কথা মনে পড়ে। তার কপালে এরকম ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমেছিল। দেখতে এক ধরণের অথচ তাদের সৃষ্টি কাহিনী কত ভিন্ন!
অন্তরা কি ভাবছিস ? কোনটা খাবি ? অরেঞ্জ নাকি লেমন ? জুস খেয়ে চল আমার বাসা ঘুরিয়ে দেখাব। আজ এখানে লাঞ্চ করে যাবি।
লাঞ্চ! নারে, আমাকে বাসায় যেতে হবে। ছেলে বারবার ফোন করে পাগল করে ফেলছে। আমি না যাওয়া পর্যন্ত বাসার কেউ খাবে না।
রুবিনার মুখের উপর দিয়ে আবারো একটা ছায়া খেলে গেল।
আফা, মেলাক্ষণ হইল স্যার আইছে। আপনেরে না পাইয়া এমুন ক্ষ্যাপা ক্ষ্যাপছে, জিনিসপাতি ভাইঙ্গা ফালছে। আপনে ফুন ও তো নিয়া যান নাই।
হন্তদন্ত হয়ে আসা মেইডটি রুবিনার সামনে উত্তেজিত ভাবে হাত পা নাড়ছে।
রুবিনার চেহারা অস্বাভাবিক রকমের ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে কেউ ব্লটিং পেপার দিয়ে মুখের সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে।
আজ তো আসার কথা ছিল না!কোথায়? কখন এসেছে ? রুবিনার কণ্ঠ কাঁপছে ।
আপনের ঘরে। আপনে যাবার একটু পরেই আইছে।
অন্তরা, তুই একটু বস। প্লিজ কোথাও যাবি না। আমি আসছি। তোর সাথে অনেক কথা আছে।
ড্রয়িং রুমের এক প্রান্তের স্ক্রিনে ভারী পর্দা ঝুলছে। রুবিনা পর্দা সরিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত পায়ে সেদিকে গেল। অন্তরা বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। রুবিনার পিছু পিছু এগিয়ে গিয়েছিল কিন্তু পর্দা সরানোর আগেই একটা কর্কশ পুরুষ কণ্ঠে ও স্থানুর মত ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
কোথায় গিয়েছিলে?
একটু শপিংয়ে। তুমি কখন এলে?
আমি কখন এলাম সেটা নিয়ে তোমার কোন ভাবনা আছে? কার সাথে ডেটিং সেরে এলে সেটা বল।
এভাবে বলছ কেন? বললাম তো শপিং এ গিয়েছিলাম।
চোপ ফকিরনীর বাচ্চা! বাপ তো ছিল কাঠের বেপারী। কিসের এত শপিং ? আমি কিছু বুঝিনা তাই না ?
রুবিনা মিনমিন করে কি বলল, শোনা গেল না।
শাট আপ ইউ বীচ! চাবকে তোমার পিঠের ছাল তুলে দেব । সাপের পাঁচ পা দেখেছ? এরপর যদি কখনো ঘরে এসে না পাই লাত্থি মেরে ঘর থেকে বের করে দেব, মনে রেখ।
কিছুক্ষণ আগে রুবিনা তার স্বামী সম্পর্কে যে সব গল্প বলেছিল তার সাথে এখন ঘটে যাওয়া ঘটনার দূরতম মিল নেই। এই সিচুয়েশনে কি করতে হবে বুঝতে না পেরে অন্তরা ফিরে এসে সোফায় মূর্তির মত বসে থাকে। যেন রুবিনা ফিরে না আসা পর্যন্ত তার কোথাও যাবার নেই। কিছু ভাবার নেই।
রুবিনা এভাবে কেন বলেছিল ? বন্ধুকে দেখাতে যে সে কত সুখে আছে ? অনেক মেয়েই বাড়িয়ে গল্প করে আত্মসুখে মশগুল থাকে, কিন্তু এ যে আত্মপ্রবঞ্চনা!
বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছে। মূল গেট খোলার সাথেভারী জুতার মচমচে শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে। সম্ভবত রুবিনার স্বামী বেরিয়ে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর রুবিনা এল। এলোমেলো বিধ্বস্ত। মুখে সেই হীরের আলোর ঝলকানি নেই। ঠোঁট রক্তশুন্য। এই সময়ের মধ্যে ওর সাথে কি ধরণের জবরদস্তি ঘটেছে সেটার নির্লজ্জ সাক্ষী ওর গলার নখের আঁচড়।
এ কি অবস্থা হয়েছে তোর ? ঘৃণায়, রাগে অন্তরার কণ্ঠ কেঁপে ওঠে ।
রুবিনা কিছু বলে না। দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অন্তরা উঠে ওর কাঁধে হাত রাখে। চোখের কোন বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।মুছে দেয়,
ঠিক হয়ে যাবে। কাঁদিস না।
রুবিনা চুপ। আবার চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়ল।
রুবিনা একটা সত্যি কথা বল। তোর স্বামী কি এখানে থাকেন না ?
না,মাঝে মাঝে স্বামিত্ব জাহির করতে আসে।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি। এখানে কেন থাকেন না ?
আর একটা বিয়ে করেছে। সেখানে থাকে।
মাই গুডনেস! ভদ্রলোক তো একটা স্যাডিস্ট,স্কাউন্ড্রেল । এখানে পড়ে আছিস কেন ?
কি করব ? ছেলেকে নিতে দেবে না ওকে ছেড়ে কোথায় যাব ?
সার্টিফিকেট গুলো কি করেছিস ?
আছে কোথাও।
বাহ! সেটাও জানিশ না ? চাকরী করবি না ব্যবসা করবি না। স্বামীর টাকায় আয়েশ করবি। পড়ালেখা করছিলি কিসের জন্য? স্বামীর আয়ে কতখানি সুখ পেয়েছিস ?
কি পেয়েছি সেটা তো নিজের চোখে দেখলি।
দেখলাম বটে। কিন্তু দায় কার ? যাইরে, বাসার সবাই আমার জন্য অপেক্ষা করছে। পরে আরেকদিন আসব।
রুবিনা আকুল হয়ে দুইহাত জড়িয়ে ধরে,
অন্তরা, আমাকে একটা চাকরী জোগাড় করে দিবি? যে কোন ধরণের চাকরী। আমি তোর মত হেঁটে হেঁটে মার্কেটে যাব। ছেলেকে নিয়ে থিয়েটার দেখব। এই জীবন থেকে আমি পালাতে চাই অন্তরা। প্লিজ হেল্প মি।
রুবিনা তুই জানিস কি করতে হবে। কিন্তু এই আরাম আয়েশ ছেড়ে বেরুবার সাহস তুই হারিয়ে ফেলেছিস।
আমি পারব দেখিস।
আমি আবার আসব। তুই চিন্তা করিস না। ভাল থাকিস।
সেন্ট্রাল রোড থেকে পরিবাগ আসতে বেশি সময় লাগে না। সকালে দেখা লাশটি পিকআপে তোলা হচ্ছে। হাবলা ছেলেটি বাগান কিছু বাগান বিলাস মায়ের লাশের উপর ছড়িয়ে দিয়ে পাশে উঠে বসল। ছোট্ট একটু ভালবাসা, তবুও চোখের কোন ভিজিয়ে দেবার মত কতই না বড় ! অন্তরার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রুবিনার বিলাস ব্যসন দেখে কিছু সময়ের জন্য ঈর্ষা আর লোভের কাঁটায় যে ক্ষত তৈরি হয়েছিল সেখানে এখন গ্লানির জোয়ার।
ও আর দেরী করে না । ঘরমুখো পথে দ্রুত পা চালায়। ব্রিজের ওপারেই ছোট্ট ঘরটিতে রেণু রেণু হয়ে ছড়িয়ে আছে মধ্যবিত্ত সুখ। ঘরের কোণে, জানালার কার্নিশে,শওকতের শার্টের হ্যঙ্গারে, বাচ্চাদের বইয়ের ফাঁকে, মানিপ্ল্যান্টের শাখায়, এমনকি রান্নাঘরে নুনের কোটায়,অন্তরার টিপের পাতায়। সবখান থেকে বিন্দু বিন্দু সুখ নিয়ে একটি বৃত্ত তৈরি করবে। তারপর সেটা নিয়ে যাবে রুবিনার কাছে। ওকে শেখাবে কিভাবে সুখের বিন্দুগুলো বৃত্তে পরিণত হয়। বনসাই,পেইন্টিংস,ঝাড়বাতি,এসি,ফোমের বিছানায় ছড়িয়ে থাকা অপমান আর অবজ্ঞার চোরা কাঁটাগুলো রুবিনাকে উপড়ে ফেলতে শেখাবে।
ওকে পথ দেখিয়ে সেই বেদিতে নিয়ে যাবে, যেখানে নারী শুধু মানুষই নয়, নারী একটি মর্যাদার নাম।
( সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত আমার লেখা একটি ছোট গল্প)


সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৪
১২টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইসলামে পর্দা মানে মার্জিত ও নম্রতা: ভুল বোঝাবুঝি ও বিতর্ক

লিখেছেন মি. বিকেল, ১৯ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



বোরকা পরা বা পর্দা প্রথা শুধুমাত্র ইসলামে আছে এবং এদেরকে একঘরে করে দেওয়া উচিত বিবেচনা করা যাবে না। কারণ পর্দা বা হিজাব, নেকাব ও বোরকা পরার প্রথা শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×