somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুন্দরবনের টারজান (পর্ব-৩)

২৫ শে আগস্ট, ২০১৩ রাত ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৬ আগষ্ট, ২০১৩। সময় সকাল ৫টা ১০মিনিট। আমাদের জালি বোট খুবই ধীরে ধীরে সুন্দরবনের মূল ক্যানেল থেকে অনেক ভিতরে ছোট খালের ভিতর প্রবেশ করেছে। নিরবতার ঢেউ ঠেলে আমরা সামনে এগিয়ে চলেছি। প্রতি মুহূর্তেই বিপদের আশংকা। শব্দ এখানে নিষিদ্ধ। ছোট এ ক্যানেলের প্রবেশ করার পর সামান্যতম শব্দও আপনার জন্য বিপদের কারন হয়ে দাঁড়াতে পারে। দু’পারের গাছ দিয়ে ক্যানেলটি যেন একটি ছৈ নৌকার মতো ঢেকে দেয়া হয়েছে। নিরবতার যে একটি হৃদয়হরণ করা সৌন্দর্য্য আছে তা এখানে না এলে অনুভব করা যায় না।

ক্যানেলের ভেতর আমাদের জালি বোট প্রবেশ করার পর দেখলাম যে, বোটের দু’পাশ থেকে খালের পার ৫ থেকে ৬ হাত বা তার একটু বেশি হতে পারে। নিশ্চয় অনুমান করতে পারছেন যে, চাইলে বাঘ হালুম করে আপনার উপর লাফিয়ে পড়তে পারে। মনে হয়তো প্রশ্ন আসতে পারে যে, মরার জন্য এতো ভোরে এতো সংর্কীণ খালের ভেতর প্রবেশ করার প্রয়োজন কি। চুপিচুপি এতো ভোরে আমাদের বনের ভেতর আসার উদ্দেশ্য ঘুমভাঙ্গা হরিণদের দেখা এবং রাতে শিকার করে খেয়েদেয়ে ঘুমতে যাওয়ার আগে খাল পারে পানি খেতে আসা বাঘ মামাকে একনজর দেখা।

আমরা যখন ক্যানেলের একেবারে মাথায় পৌঁছালাম তখনো আমরা কোন হরিণ বা বাঘের দেখা পাইনি। বাঘের পা’য়ের ছাপ দেখে দেখে এক যায়গায় এসে টারজান বোট থামাতে বললো। বোট থামার পর কিছু কেওড়া গাছের ডাল কেটে আমাদের ঢেকে দেয়া হলো (এ্যাম্বুশ)। জালি বোট থেমে আছে। আমরা এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। এখানে নিয়ম হলো একজন আর একজনের পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসা। উদ্দেশ্য, যেদিক থেকেই বাঘ আসুক দেখা যাবে। সময় গড়াচ্ছে, আমরা বসে আছি, চারদিক নিরব, শুধু বাতাসের দমকে গাছের পাতার সাথে পাতার ঘর্ষণের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। এখানে নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও শোনা যায়। বনের এতো গভীরে গিয়ে নিরবতা, ভয়, ভাললাগা, মুদ্ধতা আর প্রকৃতির কোলে নিজেকে সপে দেয়ার এক অপূর্ব অনুভূতি কাজ করছিল।

এখানে কথা বলার নিয়ম নেই, কথা বললে কোন বন্য প্রাণী এখানে আসবেনা তাই পারস্পাকির যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ‘ইশারা’। টারজান আমাদের ইশারা করে দেখালো একটু দুরেই একদল হরিণ এসেছে। খাল পারে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে তারা পানি খেতে শুরু করলো। আমি ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তাদের পরপরই এলো একদল বানর। বানর দেখার পর মনে মনে আমি একটু ভয় পেলাম। ওরা গাছের ডালে ডালে যেভাবে ঝুলাঝুলি করছে তাতে আমাদের উপরে যে ডালগুলো আছে সেখানে না চলে আসে। তাহলে সব মাটি। আমি টারজানের দিকে তাকালাম। সে আমার তাকানোতে কি বুঝলো বলতে পারবো না। তবে সে কি বলল তা আমি বুঝতে পারলাম। সে তার হাতটা উঁচু করে আন্ডার আর্মের গন্ধ শুকে দেখালো এবং বোঝালো বানর আমাদের গায়ের গন্ধ বোঝে তাই তারা এখানে আসবেনা। বানর ও হরিণের দল পানি খেয়ে চলে গেলো। বিরক্তিকর প্রতীক্ষার প্রহর। অনেকক্ষণ পর একটি গুইসাপ (অনেকটা কুমিরের মতো দেখতে, ইংরেজীতে বলে মনিটরলিজার্ড) সাতার কেটে খাল পার হয়ে গেলো। এরপর সব হাওয়া। কোন কিছুই আর দেখা যায় না।

সময় বয়ে চলেছে, আমি টারজানের দিকে তাকাই। টারজান আমাকে ইশারায় বলতে চাইলো যে, “ভাই উতলা হলে ওয়াইল্ড লাইভ দেখা যাবে না। ধৈয্য ধরুন, এটা চিড়িয়াখানা না যে, আপনি খাঁচার সামনে গেলেন আর বাঘ দেখে চলে এলেন।” আমি কিঞ্চৎ হতাশ হয়ে গাছের ফাঁক ফোঁকরের ভিতর দিয়ে যতদুর চোখ যায় ততদুর দেখতে থাকলাম। যদিও বাঘ খুঁজতে থাকলাম কিন্তু মনে মনে আশা করছিলাম যেন বাঘ মামা আজ পানি খেতে এখানে না আসে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন আমি ভীতু টাইপের একজন মানুষ। ভাবতে পারেন; তবে আমি বাঁজী ধরে বলতে পারি যে, শুধু আমি না, এখানে আসলে বড় বড় সাহসী মানুষও ভয়ে চুপশে যাবেন।

হঠাৎ আমার নাকে একটা গন্ধ অনুভূত হলো। এটা নোনা পানি বা সবুজের গন্ধ না। মৃত-পঁচা গরু, কাদা আর ঘাস একসাথে হলে যে ধরনের তীব্র ঝাঁঝালো দূর্গন্ধ হয় প্রায় সে রকম। আসলে এটা ঠিক বর্ণনা করা যাবেনা। আমার স্ত্রী আমার দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো। মানে সেও গন্ধটা পেয়েছে। আমরা দু’জনই টারজানের দিকে তাকালাম। টারজান মাথা দুলিয়ে বোঝালো যে, মামার গায়ের গন্ধ। আমাদের সাথে থাকা স্কট দু’জনকে টারজান ইশারা করলো। তারা দু’জন তাদের বন্দুক রেডি করে যে দিক বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছিলাম সেদিকে তাক করে থাকলো। আমার হাতেতো আর বন্দুক নেই তাই আমি আমার ক্যামেরা রেডি করে বসে থাকলাম। আমার বউ যতটুকু আমার কোলের ভেতর আসা সম্ভব ততোটুকু ঢুকে গেলো। আমি কিছু বলতেও পারছিনা আবার সহ্যও করতে পারছিনা। কারন আমার বউ যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে তাতে বাঘ যদি সামনে আসেও আমি ছবি তুলতে পারবোনা। এমনো হতে পারে ভয়ে বউ আমাকে পানিতে ঠেলে ফেলে দিতে পারে। সেটা যদি সে করেও তবে অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা। কারন আমি নিজেও ভয় পাচ্ছি।

গন্ধটা আরে তীব্র হলো। এবার টারজান আমার বউয়ের সামনে এসে বসলো আর তার সহকারী আমার বউয়ের অন্য পাশে। মোটামুটি আমরা তিনজন তাকে ঘিরে রেখেছি। ও একটি কথা আপনাদের বলতে ভুলে গিয়েছি, আমরা এখানে আমাদের মেয়ে আদিবাকে আনিনি। টারজান ইশারায় আমার বউকে সাহস দিতে লাগলো আর চুপ থাকার অনুরোধ জানালো। আমি আশেপাশের গাছ গুলো দেখতে থাকলাম। কারন, বাঘ যদি গুলির শব্দে পালিয়ে না গিয়ে আমাদের আক্রমন করে তবে কোন গাছটাতে উঠে আত্মরক্ষা করা যাবে তাতো আগে থেকেই ঠিক করে রাখতে হবে, নাহলে বিপদের সময় রেসকিউ হওয়া যাবেনা। এমন সময় আমরা হালকা একটা র্গর্গ শব্দ শুনতে পেলাম। অন্য সময় হলে হয়তো শুনতে পেতাম না কিন্তু এখন শুনতে পেলাম কারন, অনেকক্ষণ নিরবতার ভেতর থেকে অনেক হালকা শব্দও কানে অনুভব হচ্ছে। আমার বউ আমার দিকে তাকালো আমিও তার দিকে তাকালাম। দু’জনের চোখেই ভয়। আমার ভয়টা আড়াল করার জন্য আমি ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মনেমনে বলতে থাকলাম, ‘বাঘ তুই আসিস না, মামা ঘরে ফিরে যা’। কিন্তু মামা আমার কথা শুনলো না। সে তার নামের মর্যাদা রেখেই রাজকীয় ভঙ্গীতে হেলে দুলে খালের পারে চলে আসলো। আমি ফ্রিজ হয়ে গেলাম। নড়াচড়া করা শক্তি যেন একা একাই শেষ হয়ে গেলো। পরিস্থিতিটা এরকম যেন ডিভিডিতে কোন কিছু পজ করে রাখা হয়েছে। কখন যে পজ ছাড়লো তা জানি না। এক সময় আমার মনে হলো একটি একটি দূর্লভ মূহুর্ত। একে অবশ্যই ক্যামেরা বন্ধী করতে হবে। অভ্যাস বসতো রোবোটের মতো ক্যামেরার বডিতে থাকা ছোট লেন্স খুলে ৪০০এমএম প্রাইম লেন্সটি লাগালাম। ট্রাইপডে ভালভাবে ক্যামেরা বসিয়ে ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে ফোকাস নিলাম। অতিরিক্ত টেনশনের করনে এক্সপোজার সেটিং না করেই একটি সার্টার রিলিজ করে ফেললাম। ছবি তুললে যে এতো জোরে শব্দ হয় তা আগে কখনো খেয়াল করিনি। শার্টারের শব্দে মামা একটু বিরক্ত হলেন। ঠিক আমাদের দিকেই তাকালেন। ভয়ের কিছু নেই তিনি আমাদের দেখতে পাবেন না কারন আমারাতো কেওড়া ডালের নিচে এ্যাম্বুশ করে আছি। এর ভেতর আমি এক্সপোজার কন্ট্রোল করে ফেলেছি। মামা আমাদের দিকে তাকানো অবস্থায় আমি আর একটি ক্লিক করলাম। এই ক্লিকটিই ছিল আমার জীবনের সব চেয়ে বড় প্রাপ্তি এবং সব থেকে বড় ভুল। শার্টারের শব্দ প্রথমবার আমলে না নিলেও দ্বিতীয়বার আর সে অবহেলা করলো না। শব্দ লক্ষ করে লাফ দিলো। বাঘ মামা যে ফিজিক্সে এতো পাকা তাতো আর আমাদের জানা ছিলনা। সে শব্দরে উৎস একদম নির্ভূল ক্যালকুলেশন করে প্রায় আমাদের বোটের উপর এসে পড়লো। আমাদের সাথে থাকা স্কটরাও অত্যন্ত অভিজ্ঞ তাই তারা তাদের দায়িত্ব সঠিক ভাবে পালন করলো। তারা ফাঁকা গুলি ছুড়লো এবং আমি মারা গেলাম। এতো কাছে থাকার পরও মৃত্যুর সময় আমি আমার বউকে বলতে পারলাম না, “জান আমি তোমাকে ভালবাসি।”

মৃত্যুর পর আখেরাতে আমি যখন পূনঃরবার জীবিত হলাম দেখলাম আমাকে ফেরেস্তারা কোন প্রশ্ন করছেনা, প্রশ্ন করছে টারজান। সে বলছে, “এখন কেমন লাগছে শিমুল ভাই?” আমি চোখ ঘুরাতেই দেখলাম আমার বউ বসে আছে। উঠে বসতে গেলাম দেখলাম মাথা তুলতে পারছিনা। টারজান বললো, “শুয়ে থাকেন, আপনার মাথায় আঘাত লেগেছে। আপনাকে পেইন কিলার ইনজেক্ট করা হয়েছে, দু’তিন ঘন্টা রেস্ট নিলে ব্যাথা ঠিক হয়ে যাবে।” আমি বোবা চোখে তাকিয়ে থাকলাম। কিন্তু সে চাহুনিতে অনেক প্রশ্ন। টারজান বললো, “মামা লাফ দিয়ে এসে আপনার উপরে যে ডালটা ছিল সেটার গেড়ায় পড়েছিল। মামার চাপে ডালটা জোরে আপনার মাথায় লেগেছে। মাথায় অনেক জোরে বাড়ি লাগায় আপনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন।” আমি কোন কথা বলতে পারলাম না। আমার চোখ দিয়ে এমনিই নোনা জলের ধারা বইত লাগলো। আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকাটা কত দামী তা আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। আমি আমার বউয়ের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। বউ আমার হাত ধরে পাশে বসলো আমাদের কিছু বলতে হলো না। আমরা দু’জনেই বুঝে নিলাম আমরা দু’জন দু’জনকে কতখানি ভালবাসি।

চলবে - - -
১৯টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিসিএস দিতে না পেরে রাস্তায় গড়াগড়ি যুবকের

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৫৫

আমাদের দেশে সরকারি চাকরি কে বেশ সম্মান দেওয়া হয়। আমি যদি কোটি টাকার মালিক হলেও সুন্দরী মেয়ের বাপ আমাকে জামাই হিসেবে মেনে নিবে না। কিন্তু সেই বাপ আবার ২০... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×