কিছুদিন আগে ''দি পিয়ানিস্ট'' নামের অস্কার বিজয়ী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একটা মুভি দেখেছিলাম। পোল্যান্ডের একটি পিয়ানো বাদকের জীবন নিয়ে এ মুভির কাহিনী এগিয়ে চলে, এবং সাথে সাথে ফুটে ওঠে জার্মান সৈন্যদের নির্মমতার চিত্র। মুভির এক পর্যায়ে, জার্মান সৈন্যরা পোল্যান্ডের ইহুদিদের অন্যান্য পোলিশদের থেকে আলাদা করে, তারা তাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবার আশ্বাস দেয়। জার্মানরা এরপর পোল্যান্ডের সেই ইহুদিদের একটা ট্রেনে তুলে দেয়, সব ইহুদি পরিবার বেঁচে থাকার আশায় সেই ট্রেনে চরে, এদের অধিকাংশই ট্রেনে মারা যায়, আর বাকিদের গ্যাস চেম্বারে মারা হয়।
আমরা অনেকেই এই কাহিনী জানি, কিন্তু আমরা কি জানি, যে আমাদের দেশেই ১৯৭১ সালে নিরীহ হিন্দু মাড়োয়ারিদের ভারতে পাঠানোর নাম করে পাকিস্তানীরা গণহত্যা চালিয়েছিল?
উত্তর একটাই: জানতাম না... অন্তত আমি জানতাম না...
সময়টা তখন ১৩ই জুন, ১৯৭১।
প্রতারক পাকিস্তানি বাহিনী সৈয়দপুরের হিন্দু মাড়োয়ারিদের নিরাপদ আবাস ভারতে পৌঁছে দেওয়ার নামে সৈয়দপুর স্টেশনে জড়ো করে। একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়। সকালে ট্রেনটি স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়ায়। সারি সারি মাড়োয়ারি হুড়মুড় করে উঠে বসে ট্রেনে। এর আগে ২০ জন তরুণী আর নববধূকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে যায় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী। পরে জানা যায়, ওই তরুণীদের সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে অফিসারদের উপহার দেওয়া হয়। ট্রেনটা দুই মাইলের মতো পথ অতিক্রম করে। খুব ধীরে চলছিল ট্রেনটি। শহরের গোলাহাটের কাছে আসতেই থেমে যায় বিশেষ ট্রেনটি। এরপর কম্পার্টমেন্টের একটা দরজা খুলে যায়। ওই দরজা দিয়ে কম্পার্টমেন্টে ঢুকে কয়েকজন বিহারি, ওদের হাতে চকচকে রামদা। একইভাবে প্রতিটি কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়ে রামদা হাতে বিহারিরা। বাইরে উঁকি দিতেই দেখা যায় পাকিস্তানি বাহিনী গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে, সবার হাতে ভারী আগ্নেয়াস্ত্র। পালাবার পথ নেই। এ সময় বিহারিরা চিৎকার করে বলে উঠল, ‘মালাউনকা বাচ্চা! তুমলোগকো মারনে কি লিয়ে সারকারকা কিমতি গোলি কিউ খারচ্ কারু?’ অর্থাৎ বিধর্মীর বাচ্চা! তোদের মারার জন্য সরকারের মূল্যবান বুলেট কেন খরচ করব? এই বলে এলোপাতাড়ি রামদা দিয়ে কোপাতে থাকে ট্রেন থেকে একজন একজন করে বের করে। ওই হত্যাযজ্ঞের নাম দেওয়া হয় অপারেশন খরচাখাতা।
পাকিস্তানি বাহিনীর সেই অপারেশন খরচাখাতায় ৪৩৭ জন নিরীহ হিন্দু মাড়োয়ারিকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ওই হত্যাযজ্ঞ থেকে কোনোরকমে সেদিন প্রাণে বেঁচে যান প্রায় ১০ জন যুবক। তাঁরা ট্রেন থেকে নেমে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে দিনাজপুর হয়ে ভারতে পালিয়ে যান।
এই গণহত্যার সাথে ''দি পিয়ানিস্ট'' এর সেই গণহত্যার মিল রয়েছে, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, সব পশুর বৈশিষ্ট্যই এক... ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীন দেশে যারা আজও সেই পাকিস্তানীদের দালালী করে, তারাও পশু।
আজও যখন তাদের মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হয়নি, আর কখনই হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১২ রাত ১১:২৭