সবার জীবন থেকে হারিয়ে গেল আর একটি বছর। একজন মানুষের জীবনে তার কর্মস্থলটির একটি বিরাট ভূমিকা থাকে। কারণ দিনের বেশ কয়েকটা ঘন্টা, বছরের অনেকগুলো দিন সর্বোপরি জীবনের অনেক গুলো বছর তাকে কাটাতে হয় সেখানে। আর তাই সেখানকার সব ঘটনা দুর্ঘটনা, সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা তার জীবনে বেশ প্রভাব ফেলে। আমার জীবনের ১৫টি বছর কাটিয়েছি যেই কর্মস্থলটিতে এ বছর এতগুলো ঘটনা ঘটল যা আমার জীবনে অনেক স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বছরের শুরুর দিকে দীর্ঘ ১১ বছর চাকুরী করে অবসর নিলেন কলেজ অধ্যক্ষ। আর তার পথ ধরে একে একে বিদায় নিলেন আরো ৪ জন সহকর্মী। তার মধ্যে একজন কলেজ এ্যডজুটেন্ট- চাকরীর মেয়াদ শেষ হ্ওয়াতে, একজন প্রভাষক অসুস্থ্যতার কারণে এবং দুজন শিক্ষক ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে স্বেচ্ছায় চাকরী ছেড়েছেন। তাদের মধ্যে কাউকে কাউকে নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে সমালোচনা থাকলেও তাদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল বেশ আন্তরিক। ব্যক্তিগত ভাবে তারা প্রায় সবাই আমাকে পছন্দ করতেন। বিশেষ করে অধ্যক্ষ ও এ্যাডজুটেন্ট স্যারদের প্রিয় পাত্র ছিলাম। হতে পারে সেটা আমি চুপচাপ থাকি বলে, কারো সাতে পাঁচে থাকি না, শিক্ষকতার দায়িত্ব ছাড়াও কলেজের বিভিন্ন কর্মকান্ড সঠিক সময়ে এবং আন্তরিকতার সাথে সবসময় করেছি বলেই হয়ত তারা আমাকে পছন্দ করতেন। তাদের সবার শুণ্যস্থান পূরণ করে এসেছেন নতুনরা। কিন্তু তাদের সাথে সেই রকম সম্পর্ক আর হবে কিনা বুঝতে পারছি না।
বছরের মাঝামাঝি এসে অনৈতিক কর্মকান্ডের (?!) কারণে চাকরী হারাতে হল দুজন নিরীহ এবং নিবেদিত, অফিস সহকারী ও একজন পিয়নকে। এবং এই দুজন ব্যক্তিও আমাকে পছন্দ করত। সত্যি কথা আমিও তাদের খুব পছন্দ করতাম। সেই প্রিয় মুখগুলোর সাথে আর প্রতিদিন দেখা হবে না। প্রতিদিন আর হাসি দিয়ে কোশলাদি বিনিময় হবে না।
বছরের শেষ মাসটিতে এসে বেশ বড় একটা ধাক্কা খেলাম। আমার কর্মস্থলের প্রিয় মানুষগুলোর মধ্যে আর একজন মানুষকে হারালাম চিরদিনের জন্য (তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি)। তার এই অসময়ে চলে যাওয়াটা আমাদের মেনে নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে। যিনি দীর্ঘ কয়েকটি বছর ল্যাব সহকারী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। শুধু ল্যাব সহকারী হিসাবেই নয় এর বাইরেও তাকে কলেজের বিভিন্ন কাজ আন্তরিকতার সাথে পালন করতে দেখেছি। বিশেষ করে প্রতি বছর কলেজের বার্ষিক অনুষ্ঠানের মঞ্চ সজ্জার কাজে উনি ( এবং চাকুরীচ্যুত পিয়ন) আমাকে যে ভাবে সার্বক্ষণিক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন তাদের অভাব আমাকে প্রচন্ড কষ্ট দেবে। কিন্তু এসব কিছু মেনে নিয়েই আমাদের বেঁচে থাকতে হবে । এগিয়ে যেতে হবে সামনের দিকে।
বছরের শেষ দিনটির আগের দিন বিদায় জানালাম আমাদের প্রতিষ্ঠানটির জন্ম লগ্ন ১৯৭২ থেকে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন সবচেয়ে প্রবীণ যেই শিক্ষক তাঁকে। তাঁর বিদায় দেয়াটা কষ্টের হলেও তার সাথে আমাদের কিছুটা তৃপ্তি ছিল। দীর্ঘ এত গুলো বছর শেষ করে শেষ দিনটি পর্যন্ত তিনি সুস্থ্য সবল দেহে শেষ কর্মদিবস পালন করতে পেরেছেন। এবং তাঁকে তাঁর শেষ কর্মদিবসটিতে আমরা সব শিক্ষকরা মিলে ছোট একটা সমাবেশ করে বিদায় দিতে পেরেছি। তাছাড়া একজন শিক্ষক হিসেবে যতটুকু সম্মান প্রাপ্য তার কিছুটা হলেও তিনি পেয়েছেন যা তাঁর পূর্ববর্তী অবসরে যাওয়া অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকারা কেউ পাননি।
এতগুলো বেদনা বিদুর ঘটনার মধ্যে প্রাপ্তির যে সুখ ছিল তা হল দীর্ঘ ৩৭ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম বারের মত অনুষ্ঠিত হল এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের পূণর্মিলনী অনুষ্ঠানে। যেখানে দেখা হয়েছে অনেক প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে। যারা আজ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পেশায় কর্মরত, কেউ কেউ ভাল ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভাল বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করছে। ভাল লাগল যখন দেখলাম চেনা জানা মুখ গুলো ছাড়াও যখন অচেনা মুখ গুলো এসে সালাম করে জিজ্ঞেস করেছে স্যার কেমন আছেন? আপনি এখনো আগের মতই আছেন। মাঝে মাঝে আপনার কথা মনে হয়। কেউ কেউ পরামর্শ চেয়েছে কেউ বা আমার সাথে ছবি তুলেছে। এই যে প্রাপ্তি এটাইতো একজন শিক্ষকের জন্য বড় আনন্দের।
এই সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে সাথি করেই প্রতিটি মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে অজানা ভবিষৎ এর দিকে।
সবাই ভাল থাকুন, নিরাপদে থাকুন। নতুন বছর সবার জীবনে সুখ না হোক অন্তত দুঃখ কষ্ট বয়ে না আনুক এই প্রত্যাশায় সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ২০০৯ সকাল ৯:৩৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




