স্বাধীনতার কয়েক বছর পর বাংলাদেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে আমি এক পাকিস্তানিকে খুন করার সুখ পেয়েছিলাম। আমি ছিলাম এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত চমৎকার একটি ছাত্রাবাসে। ওটার নাম ছিল গ্রান্টভবন। একেবারে পাহাড়ের পায়ের কাছে সবুজের ভেতর ছিল ছাত্রাবাসটি। আমার জানালায় এসে পাখা মেল তো উত্তর সমুদ্র থেকে উড়ে আসা গাঙচিলেরা। গ্রান্টভবনে ছাত্র এবং ছাত্রী একত্রে বাস করতো
ওখানে আমাদের নিজেদের রান্না করে খেতে হতো। রান্না ঘর ও খাবার ঘরটি ছিল সবার জন্য। ওখানেই বিদেশী ছাত্রদের দেখা হতো। বন্ধুত্ব গড়ে উঠত। আমার কক্ষের কয়েক কক্ষ পরেই বাস করতো এক পাকিস্তানি ছাত্র। তার সাথে আমার নিয়মিত দেখা হতো রান্না ঘরে। আমরা কখনই কেউ কাউ কে হাই বলিনি,হ্যালো বলিনি। বরং প্রতিবার দেখা হলে আমরা পরস্পর পরস্পরকে বুক ভরে ঘৃণা করেছি। একে অপরকে মনে মনে খুন করেছি। কোন এক গ্রীষ্মে, জুন মাসের বিকেলে ক্লান্ত হয়ে উঠেছি কোন রুপময়ী না দেখে। আমি আমার চারতালার জানালার পর্দা সরিয়ে দেখতে পাই, সেই পাকিস্তানীটি , যাকে আমি প্রাণ ভরে ঘৃণা করেছি সে এক সোনালী চুলের রূপসীর সঙ্গে বসে আছে বাগানের সবুজের ভেতরে। অনর্গল কথা বলছে পাকিস্তানী। মেয়েটি হাসছে। বাতাসে তার সোনালী চুল উড়ে উড়ে পুরো বিকেলকে সোনালী রঙ্গে রাঙিয়ে দিচ্ছে। সেই সোনা রঙ আমার জানলার ভেতর দিয়ে এসে ঢুকছে আমার ঘরে। ঢুকছে আমার বুকে। আমি বুঝতে পারছিলাম যে পাকিস্তানীটি ওই সোনালী চুলের মেয়েটির ফর্সা মাংসের জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। কোন মেয়ের মনের জন্য পাকিস্তানীরা কাতর হবেনা। ওরা মেয়েদের হৃৎপিণ্ড নয় ওরা ভালোবাসে নারীর শরীর।
মেয়েটি যদি এক রাতের জন্য পাকিস্তানীটির ঘরে যাই তাহলে পাকিস্তানীটি কি মেয়েটির সোনালী চুলের ঘ্রাণ নিবে সারা রাত জেগে? নাকি মেয়েটিকে ধর্ষণ করবে? আমি ভাবতে লাগলাম, পাকিস্তান, ধর্ষণ ,পাকিস্তান, ধর্ষণ। আমি রান্না ঘরে ঢুকি। পাকিস্তানী মেয়েটিকে নিয়ে রান্না ঘরে আসে। আমি রান্না শেষ করে খেতে বসি। ওরা রান্না শুরু করে। রান্না শেষে ওরা আমার সামনের টেবিলে বসে। পাকিস্তানীটি মুরগীর মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকে। আমি দেখতে পাই সে মেয়েটিকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে। মেয়েটি আমার দিকে তাকালে আমিও তাকাই। মেয়েটি হাসে আমিও হাসি। সে বলে, হ্যালো। আমিও বলি ,হ্যালো। এরপর মেয়েটি আমাকে বলে তুমি কন দেশ থেকে এসেছো? বাংলাদেশ থেকে , আমি বলি। মেয়েটি বলে , তোমাদের দেশেতো ভয়াবহ যুদ্ধ হয়েছে, পাকিস্তানীদের সঙ্গে? আমি বলি, আমরা ওদের পরাজিত করেছি, ওদের বিতাড়িত করেছি। মেয়েটি পাকিস্তানীটির দিকে তাকাই। পাকিস্তানীটি আমার দিকে তাকাই রক্ত চোখে। বাঙ্গালীরা তো বহু আগেই ওই রক্ত চোখকে পাত্তা দেইনি।আমি আবার উপেক্ষা করি। আমি জানতে চাই তুমি কন দেশ থেকে এসেছো? ফরাসী , মেয়েটা বলে। আমি মেয়েটিকে বলি তুমি বাংলাদেশ সম্পর্কে আর কি জানো? কিছুই না, মেয়েটি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলে। আমি বলি। তোমার দেশ সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি। মেয়েটি উৎসাহী হয়ে উঠে ,কি জানো?
আমি বলি, বলদেয়ার।
সোনালী চুল দুলিয়ে মেয়েটি চিৎকার করে উঠে, আমার প্রিয় কবি।
আমি বলি, র্যা বো।
মেয়েটি আমার টেবিলে এসে বলে, আমার আর এক প্রিয় কবি।
আমি বলি, মালার্মে।
মেয়েটি আবারো চিৎকার করে উঠে বলে, আমার আরেক প্রিয় কবি। অত্যান্ত প্রিয় কবি।
আমি বুঝতে পারলাম কবিদের নামগুলো পাকিস্তানীটির বুকে বুলেটের মতো গিয়ে বিঁধছে। রক্তাক্ত করছে। আমি ওকে আরো রক্তাক্ত করতে চাই। আমি ওই বর্বর কে খুন করতে চাই। আমি মালার্মের কবিতার কয়েকটি পঙক্তি আবৃতি করলাম। মেয়েটি আবৃতি করলো বলদেয়ারের। পাকিস্তানীটির বুকে কোন কবিতা নাই, আছে শুধু কাম ক্ষুধা, হিংস্রতা। কবিতায় কবিতায় বুক ভরে উঠছে মেয়েটির। বুক ভরে উঠছে আমার। আমি খাওয়া শেষ করে থালা বাসন পরিষ্কার করতে বেসনে গেলে মেয়েটির আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, আমি কি তোমার সাথে তোমার ঘরে যেতে পারি? আমরা কবিতা নিয়ে আলোচনা করবো। আমি বললাম অবশ্যই যেতে পারো; আমাদের আজকের সন্ধ্যাটি কবিতা দিয়ে ভরিয়ে তোলা যাবে।
পাকিস্তানীটি দরজা শব্দ করে বন্ধ করে বলল, আমি চললাম। মেয়েটি বলল, গুড নাইট।
এরপর ওই পাকিস্তানীটিকে আর কোন দিন গ্রান্টভবনে দেখিনি। আমি এক পাকিস্তানীকে খুন করে গ্রান্টভবনের দিনগুলো সুখে কাটিয়েছি।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




