আপন মাহমুদ। আপাদমস্তক কবি। সদ্য আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, মৌনতার অলৌকিক অঙ্গরাজ্যে। আপন মাহমুদ আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই তাৎক্ষনিকভাবে একটা লেখা লিখেছিলাম, এক পাখি উড্ডয়নের দৃশ্য সেখানে অনেকেই তার কবিতা পড়ার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ২০১১ এর বইমেলায় প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ সকালের দাঁড়ি কমা। এখান থেকে প্রথম দশটি সিরিজ কবিতা দিচ্ছি এখানে। মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া।
মা প্রজাপতি ও অন্যান্য ছায়া
মায়ের উদ্দেশে বাবা যে চুমুটা ছুড়ে দিয়েছিলেন বাতাসে
শুনেছি, সেই হাওয়াই চুমুটা থেকেই জন্ম নিয়েছিলো
পৃথিবীর প্রথম প্রজাপতি
মা, পৃথিবীর যেকোনো নারী থেকে যাকে কখনোই আলাদা করা
যায় নাÑ- তাকে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত-বিভ্রান্ত সেই প্রজাপতিটার
ডানা থেকে যখন টুপটাপ ঝরে পড়ছিল রঙের আকুতি- Ñরঙের
সেই অপচয় ঘোচাতেই সম্ভবত জন্ম হয়েছিলো পৃথিবীর আর
সব প্রজাপতির
মাকে বাবা খুঁজে পেয়েছেন সেই কবে! অথচ, তার মুুখের দিকে
তাকিয়ে কখনোই মনে হয়নিÑ- জীবনে একটাও প্রজাপতি তার
খোঁপায় বসেছে।
দুই
গোলাপ অথবা চন্দ্রমল্লিকার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক কেমন ছিল
জানি নাÑ- তবে কোনো এক শীতসকালে ঘরের পেছনে অকারণে
ফুটে থাকা কিছু ঘাসফুলের সঙ্গে মা আমার আলাপ করে দিয়ে
বলেছিলেন,‘ জীবনের যত কফ-থুথু আর উড়াল হারানোর
বেদনা আমি জমা রেখেছি এই ঘাসফুলের কাছে, এমনকি প্রসব
বেদনাও’Ñসেই থেকে যেকোনো নীল ঘাসফুলই আমার মায়ের
প্রতিনিধিত্ব করে- Ñযার আজো কোনো বাজারমূল্য নেই
এখনো শীত আসে পৃথিবীতে, আসে বসন্তÑগোলাপ অথবা
চন্দ্রমল্লিকারাও এখনো আলতা পরে পায়ে- Ñতবু পৃথিবীর যত
খুন, প্রতারণা আর ব্যর্থ-প্রেমের কবিতা নিয়ে আমি সেই
ঘাসফুলের কাছেই যাই
চোখ বন্ধ করে একটু দাঁড়াই...
তিন
আমার জন্মের রাতে একটাও নক্ষত্র খসে পড়েনি মাটিতে- Ñযদিও
আপন-আকাশ ভুলে মা আমাকেই তুলে ধরেছিলেন তার প্রার্থনার
করতলে- Ñপ্রার্থনা শেষে মা আজো চোখ মোছেন- Ñযে চোখে খুব
কাছের নক্ষত্রটাকেও ঝাঁপসা দেখায়!
বাবা রাজমিস্ত্রি, দাদি আত্মহত্যা করেছেন পেটের পীড়ায়Ñ- তবু
আমার কখনো সাব-কন্ট্রাক্টর কিংবা এলএমএফ ডাক্তার হতে ইচ্ছে
করেনিÑ- বরং নক্ষত্র হতে না-পারার অহেতুক বেদনা নিয়ে আমি
আজো বেজে চলেছি সেই বেহালাবাদকের আঙুলে- Ñঘনকুয়াশার
দিকে নিরন্তর হেঁটে যাওয়া যার অমোঘ নিয়তি
আমার জন্মধ্বনিতে কাঁপেনি আকাশÑ- উৎসবের একটাও বাতি
যায়নি নিভেÑ- কেবল কোকিল, কোকিল উড়ে গেছে দূরে...
চার
মা, তোমার বেজারমুখের প্রতিবেশী আমি এক চুপচাপ বালকÑ- নিজেকে
হারিয়ে ফেলেছি সেই কবে, নবম শ্রেণীতে- Ñনিজেকে ডুবিয়ে ফেলেছি
সেই কবে, জিল্লাল মিয়ার দিঘিতে- Ñএখনো আনানসির মতো ঘুরছি
দ্যাখো, বন্ধুর লোভে...
মা, তোমার প্রসববেদনা থেকে সেই কবে পথের শুরু- Ñহাঁটতে
হাঁটতে পৃথিবী দুপুর হয়ে গেছে- Ñতবু, বন্ধুর মতো কোনো ছায়া
নেই চারপাশে- Ñবটের ছায়াও কিনতে পাওয়া যায় না বাজারে।
পাঁচ
মায়ের কপালের ভাঁজে লুকিয়ে থাকা উৎকণ্ঠাটুকু নিয়ে এসেছি
আমারও নামের পাশে লেখা যেতে পারে ‘সম্ভাবনা’ Ñসম্ভাবনার
যে দ্বার লাঙলের খুলবার কথাÑ- তার দরোজায় আজো বসে
আছেন বাবা- Ñযার ঘোলাটে চোখে এখনো থকথক করছে
কাদাপানির সংশয়, আড়ষ্টতা...
আড়ষ্টতার হাত ধরে কতদূর যাবে মায়ের বোবা ছেলেগুলো!
আমারও উদ্দেশ্য ছিল দূরÑ- অথচ, ঘরের কাছেই বুনোফুল দেখে
থমকে দাঁড়াতে হলোÑ- দাঁড়িয়ে আছি
শুনেছি, দাঁড়াতে জানলে সকল দূরই একদিন নিকটে আসে।
ছয়
স্বপ্ন থেকে মাইল খানেক দূরে আমাদের ঘুড়ি উড়ছিল- Ñঘুড়িতে
আঁকা ছিল চোখÑ- চোখে ছিল বোকা চাউনি- Ñশেষবার নারী
থেকে বেরিয়ে আসার পথে মায়ের সঙ্গে দেখাÑ- মা তখনো
বাবা ও তার সম্পর্কের দূরত্ব মাপছিলেন- Ñমাপছিলেন
সংসার নিয়ে দেখা তার প্রথম ও শেষ স্বপ্নের পরিধিÑ- জানি না,
মায়ের সমূহ-স্বপ্নের যোগফল কত। তবু কলসি কাঁখে
কোনো এক মৃত পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা মায়ের ছবি- Ñআমাকেই
তাড়া করে- Ñআমাকেই পিপাসাবার্তা পাঠায়!
আমি আছি সেই সব মেঘের দিকে তাকিয়েÑ- বৃষ্টি না হয়ে
যারা কেবল মেঘদূত হতে ভালোবাসে।
সাত
আমার মায়ের মুখ মনে করে পৃথিবীতে শ্মশান
নেমে আসেÑ- চিড়িয়াখানার হরিণশূন্য খাঁচাটিও
এগিয়ে আসে কাছেÑ- আমি বরফ-রাজ্যের সর্বশেষ
অধিপতির মতো পায়ের তালুতে হাত রেখে মেপে
নিই পথÑ- বুঝে নিই প্রশান্তি ও মৃত্যুর তফাত
ভাবি, এবার আত্মমুখী বন্ধুরা এলে বলবো : তোমাদের
জন্য রয়েছে অবারিত শ্মশান আর গোরখোদকের
ভাবলেশহীন হাসিÑযে যার পাওনা বুঝে নিতে পারো।
আট
মায়ের মুখ মনে এলে নিজেকে রক্ষকশূন্য গোলবার মনে
হয়Ñ- মনে হয় সব কটি গোলই হয়ে যাচ্ছেÑকিছুতেই
ঠেকাতে পারছি নাÑ- অথচ, রেফারির বাঁশি যে পক্ষেই
বাজুক তারই জেতার কথা
হার-জিত প্রসঙ্গে ইদানীং মা খুব একটা কথা বলেন না,
মাঝেমাঝে দূর দীর্ঘশ্বাসের পালক ঝরাতে ঝরাতে
বলেন, ‘যারা জিততে জিততে জিততে ভুলে গেছে- Ñযারা
হারতে হারতে হারতে ভুলে গেছে- Ñতাদের সবার উচ্চতাই
সমান’
মানুষের উচ্চতা সমান ভেবেই আমাদের গান শুরু করার
কথাÑ- অথচ রেফারির বাঁশি কেবল জেতাবার জন্যই
বাজেÑ- হারাবার জন্যই বাজে!
নয়
মায়ের পান-খাওয়া ঠোঁটে যেদিন অনেক ভ্রমরের কাতরতা
ছিলো- Ñসেদিনও বাবা বিড়ির আগুনে সেলাই করছিলেন
কোনো এক বিধবার সাদাশাড়ি- Ñবিধবার শাড়ি থেকে ছড়ানো
মেঘে আর যাদের আকাশে উঠেছিলো ঝড়- Ñআর যারা
হারিয়েছিলো প্রজাপতি-শৈশবÑতাদের কেউ কেউ আমার
বন্ধুÑ- বন্ধুদের কেউ মায়ের কাছে থাকে- Ñকেউ হোস্টেলে,
কেউ বা হতাশার মোড় থেকে প্রায়ই আত্মহত্যার দুয়ার পর্যন্ত
যাওয়া-আসা করেÑ- অথচ, এসব দেখেও এখনো কোনো
কোনো বাবা মায়েদের লাল ঠোঁট উপেক্ষা করে!
আমরা মাঝেমধ্যেই রাধার বাঁধভাঙা ব্যাকুলতা নিয়ে কথা
বলিÑকথা বলি মানুষের নগ্ন হবার সহজাত প্রবণতা
নিয়েÑ- যদিও আমাদের কারো জানা নেই, কৃষ্ণ ও তার
বাঁশির মধ্যে কে বেশি প্রভাবক।
দশ
পাতা ঝরার শব্দ হতে ফুল ফোটার শব্দ পর্যন্ত হেঁটে
যেতে হবে- Ñএরকমই ইঙ্গিত ছিল হাতের- Ñহাত ছিল
নিজের কাঁধে- Ñকাঁধে ঝুলে ছিল ব্যাগÑ- ব্যাগে ছিল
মায়ের ছবিÑ- মায়ের ছিল তাকিয়ে থাকাÑ- তাকিয়ে
থাকা মানে বয়ে যাওয়া নদী
মা আমার যাচ্ছেন বয়ে, নিরবধি...
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ সকাল ১১:০২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






