রাত প্রায় ১১টা ২৫ মিনিট। হঠাৎ মুঠোফোন বেজে উঠল। রিসিভ করে সালাম দিতেই অন্য প্রান্ত থেকে রওশন ভাইয়া বললেন, ‘ইমন, কেমন আছো।’ ‘ভাইয়া, ভালো আছি। এতো রাতে...।’ ‘কাল বন্ধুসভার সবাই নন্দনপার্কে যাবে, তুমিও চলে এসো।’
মুঠোফোনের মাধ্যমে শব্দজনিত ক্ষুদ্র বার্তাটা এমনই ছিল। ক্ষুদ্র বার্তা নিয়ে বৃহৎ চিন্তার সময় ছিল না। তারপর বন্ধুসভার সঞ্জয়ের সঙ্গে স্টেশনে এসে রাতের ট্রেন ধরে কমলাপুর, সেখান থেকে গাড়ি ছাড়ার নির্ধারিত স্থান প্রথম আলো কার্যালয়। সেখানে যেতেই গাড়িতে ওঠার নির্দেশ পেলাম ।
এক এক করে সবার গাড়িতে ওঠা শুরু কিন্তু অন্যান্য বন্ধুর কাছে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তুতিমূলক বড় বড় ব্যাগের রহস্যটা তখনো আমার কাছে স্পষ্ট নয়। ঠিক তখনই আশফাক ভাই গাড়িতে উঠে আমাদের কিছু দিকনির্দেশনা দিলেন। অতঃপর নন্দনপার্ক অভিমুখে শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
গাড়ি ছাড়ার পরই পরিকল্পনামাফিক রাতের ঘুম পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বন্ধুদের চার লাইন করে দাপুটে গানের কাছে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলো। শুরু হলো আমাদের খালি গলায় বাস কনসার্ট। যে বন্ধুরা দর্শক হয়ে গান শুনছিলেন, তাঁরা বাস-গায়ক হয়ে ওঠার বিষয়টা খুব উপভোগ করছিলেন। ‘একতারা বাজাইও না...’, ‘বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম...’। ‘গাড়ি চলে না চলে না...’, ‘এখন অনেক রাত...’। যেখানে দিনের বেলায় আমাদের গাড়ি দিব্যি তার আপন গতিতে চলছিল, এরই এক ফাঁকে গানে মনোবিয়োগ করে ঢাকা মহানগরের বন্ধুসভার বন্ধুদের সহযোগিতায় আমরা নাশতার পর্বটা শেষ করে নিলাম। তারপর আবার গানে মনোযোগ।
কিন্তু হঠাৎ ‘এই যে ভাই, ভাড়া দিন, ভাড়া।’ ভাড়া না দিলে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দেওয়ার দুষ্টুমি নিয়ে হিমেল-সাদনানের নেতৃত্বে একদল বন্ধু ভাড়া তোলা শুরু করলেন। ৫, ৮, ১০, ১৫, কেউ বা ২০ টাকা দিলাম। তবে হুমকি-ধমকির ভয়ে নয়, এ ছিল বন্ধুত্বপূর্ণ ভ্রমণে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। আর সেই ভাড়ার টাকায় খাওয়ানো হলো কোমল পানীয়। আহ! সব কন্ডাক্টর যদি এমন হতো।
বাসের বাইরের পরিবেশটাও যেন বন্ধুসভার বন্ধু। আশুলিয়ার দুই পাশ বেয়ে পানিতে থইথই, হালকা বাতাস, ঢেউ... আজ পরিবেশ যেন বন্ধুদের নামে উৎসর্গকৃৎ। সবার সম্মিলিত চিৎকার, কারণ দূর থেকে আমাদের গন্তব্য দেখা যাচ্ছে। সেখানে নেমেই লাইন ধরে শুভদার কাছ থেকে টিকিট সংগ্রহ করে আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশ করতেই আর দশটা দিন থেকে আজকের দিনটা অনেক আলাদা হবে—এ ধারণাটা আমাদের মনে আরও মজবুত হলো। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি, আড্ডা, ছবি তোলার পরই ব্যাগ-রহস্যের অবসান হলো। ব্যাগ থেকে হাফপ্যান্ট, লুঙ্গি, অতিরিক্ত টি-শার্ট খুলে এর শুভ উদ্বোধন করলেন মামুন ভাই। তারপর একে একে সব বন্ধু পোশাক পরিবর্তন করে রওনা দিলেন ওয়াটার ওয়ার্ল্ডের দিকে। অন্যরা কেউ কেব্ল কারে, কেউ বা রোলার কোস্টারে উঠে দমফাটানো চিৎকার দিচ্ছিলাম, কেউ বা কৃত্রিম লেকে পা-বৈঠার নৌকা চালাচ্ছিলাম। এভাবেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নন্দনপার্ক চষে বেড়াচ্ছিলাম ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন বন্ধুসভার ২৫০ বন্ধু।
ঘোরাঘুরি ও গোসল শেষে লাঞ্চের সময় আবার পার্কের নির্ধারিত স্থানে সবাই একত্র হলাম। খাওয়া দাওয়া শেষে শুরু হলো আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আশফাক ভাইয়ের পরিচালনায় প্রতিটি বন্ধুসভার একজন করে আমাদের অনুভূতি প্রকাশ করলাম। ‘এই প্রথম অনেক বন্ধু একসঙ্গে এত মজা করলাম।’ বলছিলেন এক বন্ধু। অনুভূতি প্রকাশ শেষে সব বন্ধুকে শুভেচ্ছা ও আন্তরিক অভিনন্দন জানালেন বন্ধুসভার সম্পাদক সাইদুজ্জামান রওশন। তারপর শুরু হলো নাচ, গান, আবৃত্তি ও কৌতুক। এতে অংশগ্রহণকারী বন্ধুদের জন্য ছিল মহামূল্যবান সব বই। আর এভাবে মুখরিত ছিল সেদিন নন্দনপার্ক। তারপর আবু সাইদ অনুষ্ঠান সমাপ্তি ও বাসে ওঠার ঘোষণা দিলেন। কিন্তু ঘোষণা শুনে আমরা কেউই বিষণ্ন ছিলাম না। কারণ বাসে উঠেই আবারও শুরু হয়ে গেল আমাদের বাস-কনসার্ট। গুনগুনিয়ে হয়তো সব বন্ধুই গাইছিলেন একটি গান—এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হবে বন্ধুরা বলো তো...
আজ (১৮-০৮-১০) প্রথম আলো বন্ধুসভা পাতায় লেখাটি ছাপা হয়েছে

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




